Image description

আলফাজ আনাম

 

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করেছে। দেশ এখন নির্বাচনের ট্রেনে উঠতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর জনসমর্থন নিয়ে বেশ কয়েকটি জরিপ প্রকাশ হয়েছে। এসব জরিপের উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি নিয়ে নানাভাবে প্রশ্ন তোলা যায়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মাধ্যমে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন আসছে কি না, তা নিয়েও ভিন্নমত আছে। তবে এসব জরিপ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, আগামী নির্বাচন যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। ভোটাররা বিপুলভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন।

নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, আওয়ামী লীগের প্রচারবিদ ও আশ্রয়দাতা ভারতের পক্ষ থেকে এ কথা বলার চেষ্টা করা হবে, ফ্যাসিবাদী দলটির অনুপস্থিতিতে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। একমাত্র আওয়ামী লীগকে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিলে শুধু নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত তিনটি জরিপ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। বর্তমানে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় তিনটি দল—জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রতি ভোটারদের আস্থা ফুটে উঠেছে। আওয়ামী লীগ ও তার দোসর বামপন্থিরা বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে কোনো গুরুত্ব বহন করছে না।

সম্প্রতি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ এখনো সিদ্ধান্ত নেননি, কাকে তারা ভোট দেবেন। এটি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি সতর্ক বার্তা। এবারের নির্বাচনে যেহেতু আওয়ামী লীগ থাকছে না, মানুষ স্বাভাবিকভাবে বিএনপি, জামায়াত বা এনসিপিকে ভোট দেওয়ার বিষয়টি জানাতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। কিন্তু এরপরও মানুষ তা জানাতে রাজি হচ্ছে না। ধরে নেওয়া যায়, মানুষ অপেক্ষা করছে রাজনৈতিক দলগুলো কেমন প্রার্থী দেয়, তা দেখার জন্য। অর্থাৎ এবার মার্কা না হয়ে প্রার্থীর যোগ্যতা হতে পারে ভোট দেওয়ার মানদণ্ড। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোকে বাড়তি চাপের মধ্যে পড়তে হতে পারে। প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা যাই থাকুক না কেন, এমন ব্যক্তিকে বেছে নিতে হতে পারে, যারা বিতর্কিত নন।

 

জরিপে অংশ নিয়ে যারা ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাকে ভোট দেবেন, এই প্রশ্নে ১২ শতাংশ বিএনপি, ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ জামায়াতে ইসলামী এবং ২ দশমিক ৮০ শতাংশ মানুষ জাতীয় নাগরিক পার্টিকে ভোট দেওয়ার কথা বলেছেন। এ থেকে আমরা ইঙ্গিত পাই, আগামী নির্বাচন যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে পারে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না বা একতরফা নির্বাচন হবে বলে যারা প্রচার চালাচ্ছেন, তা যে অসত্য—এই জরিপ থেকে উঠে এসেছে।

 

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জরিপের আগে গত জুলাই মাসে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এবং একশনএইড বাংলাদেশ একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে। তরুণদের মধ্যে পরিচালিত এই জরিপে দেখা যায়, নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ৩৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভোট পাবে বিএনপি। এরপর জামায়াতে ইসলামী ২১ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ ভোট পাবে।

সানেম জানায়, শুধু ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সি তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। যে মতামত এসেছে, তা শুধু বাছাই করা ওই তরুণদের মতামত। এটিকে দেশের জনগোষ্ঠীর বা অন্যান্য বয়সের মানুষের মতামত হিসেবে বিবেচনা করা উচিত হবে না।

এরপরও জরিপে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তরুণদের মধ্যে ভোট দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র। এবারের নির্বাচনে প্রায় চার কোটি তরুণ ভোট দেবে। এরা নির্বাচনি ফল নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

 

election

 

গত মার্চ মাসে উন্নয়ন গবেষণা ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা সংস্থা ইনোভিশন কনসাল্টিং বাংলাদেশের আটটি বিভাগে চালানো জরিপের ফল প্রকাশ করে। জরিপে অংশ নেওয়াদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, দেশে এই মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচন হলে কোন রাজনৈতিক দল কত ভোট পাবে? তাতে দেখা গেছে, বিএনপি সর্বোচ্চ ৪১ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পাবে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জামায়াতে ইসলামী পাবে ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট। তৃতীয় স্থানে আওয়ামী লীগ ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ। আর ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) পাবে ৫ দশমিক ১ শতাংশ ভোট।

 

নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসবে, ভোটারদের মধ্যে মেরূকরণ ঘটতে থাকবে। আমরা এর প্রমাণ পাচ্ছি মার্চ ও এপ্রিলে করা জরিপের সঙ্গে এ মাসে করা ব্র্যাকের জরিপের পার্থক্য থেকে। আমরা লক্ষ করছি, আগের জরিপের চেয়ে পরের জরিপে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে ব্যবধান কমে আসছে। অর্থাৎ নির্বাচনি এলাকাগুলোয় দুটি দলের প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে। একইভাবে নীরব ভোটারদের সিদ্ধান্তের কারণে অপ্রত্যাশিত ফল আসতে পারে। তিনটি জরিপের ফল যদি আমরা বিবেচনায় নিই, তাহলে দেখা যাবে, মানুষ একচেটিয়া কোনো দলের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে না, যা দেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য ভালো লক্ষণ।

 

গণঅভ্যুত্থানে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে, আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি প্রচারে তার কতটা প্রভাব থাকবে, তা মানুষ দেখতে চাইবে। হাসিনার দুঃশাসনে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ছাড়াও মানুষের ক্ষোভের কারণ ছিল দুর্নীতি ও ভারতের প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। এবারের নির্বাচনে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে তুলে ধরে, তা ভোটের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।

 

মনে রাখতে হবে, প্রধান তিন রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ধারণ করে। তিনটি রাজনৈতিক দলের কোনোটি ভারতপন্থি হিসেবে পরিচিত নয়। এরপরও ভারত নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হতে পারে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রধান উপাদান ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ। একইভাবে প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি কিংবা চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠলে তা ভোটের মাঠে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এ ক্ষেত্রে তরুণ ভোটাররা প্রার্থীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে।

 

অতীতের নির্বাচনের ফলের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচনের ভোটের প্যাটার্ন নিরূপণ করা হবে ভুল। এমনকি আসনভিত্তিক বিজয়ের পূর্বাভাস ভুল প্রমাণ হতে পারে। কোনো রাজনৈতিক দল যদি মনে করে, অঞ্চলভিত্তিক মার্কার ভিত্তিতে প্রার্থী বিজয়ী হবেন, তা এবার নাও হতে পারে। এর প্রধান কারণ, ভোটারদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন। আগে নৌকা ও ধানের শীষের মধ্যে মানুষ সাধারণত প্রার্থী বাছাই করতেন। এবার ভোটাররা এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে প্রার্থী কে, তার প্রভাব কতটুকু এবং ভোটারদের আকৃষ্ট করতে তিনি কী ধরনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, সেদিকে দৃষ্টি থাকবে।

 

অতীতে মূলধারার গণমাধ্যমে মানুষ প্রভাবিত হতেন আর এবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে মানুষ বেশি প্রভাবিত হবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে, জাতীয় ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ভোটাররা বোঝার চেষ্টা করবেন সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার কাছ থেকে। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এবারের নির্বাচনে এটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

 

ব্র্যাকের জরিপে আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে—অংশগ্রহণকারীরা শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, বরং নির্বাচন-পূর্ব সময়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারেরও দাবি জানান। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি দীর্ঘদিনের অনাস্থার কারণে তারা নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অসহনশীলতা দূরীকরণ, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি দমনসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে সংস্কার দেখতে চান।

 

এসব চাওয়া থেকে ভোটারদের মনোজগতে পরিবর্তনের বিষয়টি আমরা অনুমান করতে পারি। অর্থাৎ পুরোনো ধারার বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতি ভোটারদের এবার আকৃষ্ট নাও করতে পারে। এর সঙ্গে তরুণ যে চার কোটি ভোটার তারা নিজের পরিবার ও সমাজে জনমত গঠনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবেন। ফলে নীরব এই ভোটারদের সঙ্গে প্রার্থীরা কতটা সংযোগ স্থাপন করতে পারবেন, তার ওপর প্রার্থীর বিজয়ী হওয়া অনেকাংশে নির্ভর করবে। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে বলে দেশের মানুষ আশা করেন। দেড় দশকের বেশি সময় পর মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য উদগ্রীব বলে মনে হচ্ছে।

 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের অধীন আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার প্রত্যাশা করছেন ৭০ শতাংশ ভোটার। লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক নিঃসন্দেহে এই প্রত্যাশা তৈরিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া ভোটাররা বিশ্বাস করেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন নির্বাচনে ভোটারদের স্বাধীন মতপ্রকাশ নিশ্চিত হবে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সহনশীল আচরণের ওপর নির্ভর করবে সুষ্ঠু নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে, দেড় দশক পর যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তা অতীতের সব হিসাবনিকাশ পাল্টে দিতে পারে।

 

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ