
ফরিদপুরের নগরকান্দায় ছোট বোনকে উত্ত্যক্তের ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়ে ফেরার পথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নেত্রীর ওপর হামলা ও মারধর নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। উত্ত্যক্তের ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ ও বৈষম্যবিরোধীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। পরে এ ঘটনায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কও অবরোধ করা হয়।
গত শুক্রবার বিকেল চারটা থেকে দিবাগত রাত একটা পর্যন্ত নগরকান্দার ডাঙ্গী ইউনিয়নের ভবুকদিয়া এলাকায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে এসব ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে উত্ত্যক্ত ও মারধরের ঘটনায় ভুক্তভোগী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক বৈশাখী ইসলাম বাদী হয়ে দুটি ও পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে।
ঘটনার পর বৈষম্যবিরোধী নেত্রী বৈশাখী ইসলাম অভিযোগ করেছিলেন, বিএনপির লোকজন ওই হামলা করেন। তাঁরা আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। তবে ভবুকদিয়া এলাকায় ঘুরে এলাকাবাসী, ভুক্তভোগী ও অভিযুক্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উত্ত্যক্তের ঘটনা স্থানীয়ভাবে মীমাংসা না করে থানায় অভিযোগ দেওয়ায় ওই নেত্রীর ওপর হামলা করা হয়। পরে সালিস থেকে অভিযুক্ত ছয়জনকে পুলিশ আটক করলে এলাকাবাসীর ক্ষোভ থেকে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।
রোববার সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভবুকদিয়া বাসস্ট্যান্ডের আশপাশ এলাকা ঘুরে শুক্রবারের ঘটনা জানতে চাওয়া হয়। তবে স্থানীয় দোকানদার ও এলাকার লোকজন বেশির ভাগই বিষয়টি এড়িয়ে যাওযার চেষ্টা করেন। কেউ বলেন, ‘আমি দোকানে ব্যস্ত ছিলাম, দেখিনি কি ঘটেছে।’ কেউ বলেন, ‘আমি এলাকায় ছিলাম না।’ পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ঘটনা খুলে বলেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত বৃহস্পতিবার বিকেলে বৃষ্টির পর বৈশাখী দশম শ্রেণিতে পড়া তাঁর ছোট বোনকে নিয়ে বৃষ্টির পানি দেখতে বের হন। তখন রাস্তায় শরীফ শেখ (২১), সাগর কাজী (২৬), ফয়সাল শেখসহ (২৫) কয়েকজন ছিলেন। শরীফ শেখ দুই বোনের উদ্দেশে অশ্লীল কথা বললে বৈশাখী প্রতিবাদ করেন। পরে বৈশাখী এলাকার মুরব্বিদের কাছে বিচার দেন। শুক্রবার বিকেলে সালিসের জন্য এলাকার মাতব্বর ও নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউজ্জামান মোল্লাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে শুক্রবার দুপুরে বৈশাখী নগরকান্দা সদরে গিয়ে বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানান। তিনি থানায় গিয়ে অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিলে বৈশাখী থানায় গিয়ে শরীফ শেখের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা কয়েক যুবক তাঁর ছোট বোনকে উত্ত্যক্ত করেছেন বলে একটি অভিযোগ দেন। অভিযোগের বিষয়টি ভবুকদিয়া এলাকায় জানাজানির পর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শী দুজন জানান, নগরকান্দা থেকে ভবুকদিয়া ফিরে আসার পর বেলা তিনটার দিকে ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য সেকেন কাজী, তাঁর ছেলে সাগর কাজী, ফয়সালসহ কয়েকজন মামলা করার জন্য বৈশাখীকে মারধর করেন। সালিসের জন্য বদিউজ্জামান মোল্লা বিকেল পাঁচটায় সময় দিলেও পরে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় পুনর্নির্ধারণ করা হয়। সালিসের জন্য বিবাদীপক্ষ আগে থেকে ভবুকদিয়া বাজারে উপস্থিত ছিল। এদিকে বৈশাখীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নগরকান্দা থানা থেকে এক গাড়ি পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। তখন বৈশাখী জানান, তিনি স্থানীয় সালিস মানেন না, সমাধান পুলিশের মাধ্যমে হবে। তখন পুলিশ শরীফ শেখ (২১), আরিফ হোসেন (২৩), সজীব শেখ (২৪), রাসেল শেখসহ (১৯) ১৫ ও ১৬ বছর বয়সী আরও দুই কিশোরকে গাড়িতে তোলে।
স্থানীয় সালিস না মানায় এবং সালিসের জন্য উপস্থিত এলাকাবাসীর মধ্য থেকে ছয়জনকে আটক করায় এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এলাকাবাসী আটক ব্যক্তিদের ছেড়ে দিতে পুলিশের কাছে দাবি জানান। পুলিশ আটক ব্যক্তিদের না ছাড়লে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ফরিদপুর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা ঘটনাস্থলে যান। তাঁরা পুলিশের ওপর হামলাকারীদের ঠেকাতে গিয়ে নিজেরাও হামলার শিকার হন। পরে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও র্যাবের সদস্যরা হাজির হন। রাত ৯টার দিকে বৈশাখীর ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পরে বিচারের আশ্বাসে এক ঘণ্টা পর অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভবুকদিয়া এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘যে ঘটনা ঘটেছে, সেটিকে পারিবারিক ঘটনা বলা চলে। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। তবে পরে রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বেশি আলোচিত হওয়ার জন্য।
আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘যারা ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা সুবিধা পার্টি। বিশেষত সাগর কাজী আগে এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা জামালের রাজনীতি করতেন। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর তিনি বিএনপি নেতা বদিউজ্জামান মোল্লার ছবি দিয়ে পোস্টার সাঁটিয়েছেন। শামা ওবায়েদের সঙ্গেও তাঁর ছবি আছে। তিনি বিএনপির নেতা-কর্মী নন। যখন যে দলে সুযোগ পান, সেই দলে ভিড়ে যান।’
বৈশাখীর পরিবারটি খুবই দরিদ্র। কাঁচা ভিতের বারান্দাযুক্ত চৌচালা একটি টিনের ঘরে পরিবারের ছয় সদস্য বসবাস করেন। বৈশাখীর বাবা একজন কৃষক। বৈশাখীর মা ফাহিমা বেগম বলেন, ‘আমি রাজনীতি-টাজনীতি বুঝি না। ওরা চোরকে বলে চুরি করতে, গৃহস্থকে বলে সজাগ থাকতে। আমার মেয়েকে মারধর করা হয়েছে। আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
অভিযুক্ত শরীফ শেখের বাড়িটি সেমিপাকা। শরীফ শেখের ভাবি সোমা আক্তার দাবি করেন, বৈশাখীকে মারধর করার অভিযোগ ঠিক নয়। শরীফ উচ্চমাধ্যমিকে পাস করে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন। উত্ত্যক্তের ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘শরীফ বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিল। এক বন্ধু পেছনে পড়ে যায়। তাকে দৌড়ে আসতে বলে শরীফ। তখন রাস্তায় বৈশাখী ও তার ছোট বোনও ছিল। তারা ভেবেছে, তাদের বাজে কথা বলেছে শরীফ।’
বৈশাখীর নিজের ভাষ্য, ‘ঘটনা ঘটিয়েছে সুবিধাবাদী দল। তারা আওয়ামী লীগের সময় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে ঘুরত। এখন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় তারা বিএনপি করে। বিএনপি নেতাদের সঙ্গে তাদের ছবি আছে।’
এ বিষয়ে উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শওকত শরিফ বলেন, ‘এটি ভাবুকদিয়া গ্রামের দুই পরিবারের অভ্যন্তরীণ ঘটনা। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।’
ওই দিনের সালিসের মাতব্বর ও নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউজ্জামান মোল্লা বলেন, ‘ইভ টিজিং নিন্দনীয়। তবে এ ঘটনার সঙ্গে বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী জড়িত নয়। বৈষম্যবিরোধী নেত্রীর সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তা তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।’