
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিলে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা করছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের তরফ থেকে শিগগিরই সুস্পষ্ট রোডম্যাপও আসতে পারে। নির্বাচনসহ বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে
আগামী ৫ বা ৬ জুন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে পারেন ড. ইউনূস। সেই ভাষণেই উঠে আসতে পারে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ। সরকার ও রাজনীতিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ কিছু দিন ধরেই জাতীয় নির্বাচন কবে হবে, তা নিয়ে এক ধরনের উত্তেজনা চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের প্রাথমিক একটি রোডম্যাপ দিলেও তাতে সংশয় মুক্ত হতে পারছে না বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল। ফলে নির্বাচন ইস্যুটি কেবল রাজনৈতিক ঝাঁজালো কথাবার্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না; বরং সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের অংশ হিসেবে মাঠের কর্মসূচিতেও তার প্রকাশ ঘটছে। গত মাসের মাঝামাঝিতে প্রকারন্তরে নির্বাচনের দাবিতে সরকারকে চাপে রাখতেই ভিন্ন দু’টি দাবি নিয়ে লাগাতার মাঠে থেকে রাজধানী প্রায় অচল করে রেখেছিল বিএনপির নেতাকর্মীরা। ওই কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে ‘ক্ষুব্ধ’ ড. ইউনূস ‘পদত্যাগ’-ও করতে চেয়েছিলেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। ড. ইউনূস পদত্যাগ করতে পারেন এমন খবর চাউর হলে রাজনৈতিক দলগুলো একটু শান্ত হয়। পরে গত সপ্তাহের শুরুতে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক করেন ড. ইউনূস। ওইসব বৈঠকে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে আগামী নির্বাচন হোক, দলগুলোর নেতারা প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। নেতারা ড. ইউনূসকে বলেন, তারা কেউই তার পদত্যাগ চান না। তবে ওই বৈঠকে নির্বাচন কবে হবে এমন কোনো বার্তা না পাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে বিএনপি। তারা এও বলে, পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে সরকারকে সহযোগিতা করা কঠিন হয়ে পড়বে। একইসাথে দলটি দুই ছাত্র উপদেষ্টাসহ তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি তোলে।
ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ব্যক্তিগতভাবে শুরু থেকেই দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পক্ষে নন। গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে ধারণ করে প্রয়োজনীয় কার্য সম্পন্ন করে তিনি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশকে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটানোই লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছেন। এজন্যই তিনি গত বছর বিজয় দিবসের ভাষণে আগামী ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়সীমা ঘোষণা করেন।
তবে রাজনৈতিকদলগুলো বিভিন্ন আশঙ্কা থেকে নির্বাচনের এমন দীর্ঘ রোডম্যাপ নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যা সাম্প্রতিক সময়ে একরকম বাদানুবাদের পর্যায়ে রূপ নিয়েছে। সরকার বারবার জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বললেই সেটি রাজনৈতিক দলগুলোর; বিশেষ করে বিএনপির আস্থা অর্জন করতে পারছে না। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবি বিভিন্ন ফোরাম থেকে ক্রমাগতভাবে জানিয়ে আসছে বিএনপি। এটা নিয়ে দলটি তার অনড় অবস্থানও প্রকাশ করেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হতে হবে, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দলটি মনে করে নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে এ সময়ের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। ফলে আগামী বছরের জুনে নির্বাচন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের জন্য আগামী দুই মাস (জুন ও জুলাই) অপেক্ষা করবে বিএনপি। এ সময়ের মধ্যে নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দেয়া না হলে রাজপথে কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ডিসেম্বরে নির্বাচন আদায় করে নেয়ার পথে হাঁটতে পারে তারা। তবে দলটি এখনো আশা করছে, সরকার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে খুব কম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করবে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংস্কার ইস্যুতে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার জন্য বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ঐকমত্য কমিশনের সাথে আজ অনুষ্ঠেয় এ বৈঠকে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। তারা যে দ্রুততম সময়ে সংস্কার শেষ করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায়, ড. ইউনূসের সামনে তা পুনরায় তুলে ধরবে। সংস্কারের দীর্ঘসূত্রতায় কার্যত দলটি ত্যক্ত-বিরক্ত। ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাপান সফরে গিয়ে ‘দেশের সব রাজনৈতিক দল নয়, শুধু একটি দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইছে’ এমন বক্তব্য দিলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বিএনপি। বিএনপিকে বিব্রত করার জন্য সরকারের তরফ থেকে এ ধরনের কথা বলা হয়েছে বলে মনে করে দলটি।
এ দিকে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের দাবি সত্ত্বেও সরকার কেন চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দিচ্ছে না; কিংবা সরকার কেন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন দিতে চায়- সেটি নিয়ে বিএনপি এখন বিচার-বিশ্লেষণ করছে। দলটির অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এর পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে। বিএনপি প্রথমত, মনে করে সরকারের ভেতরে কারো কারো এমন শঙ্কা রয়েছে যে, নির্বাচন হলে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সুতরাং নির্বাচন প্রলম্বিত করে বিএনপিকে কিভাবে চাপে রাখা যায় এবং অন্য দলগুলোকে কিভাবে সুবিধাজনক পজিশনে নিয়ে আসা যায় তা নিয়ে সরকারের ভেতরের কেউ কেউ কাজ করছে। দ্বিতীয়ত, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না দেয়ার জন্য সরকারের ওপর ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রবল চাপ রয়েছে। যাতে করে নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য সারা দেশে তারা সংগঠনকে গুছিয়ে নিতে পারে। তৃতীয়ত, বিএনপির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে নানা ধরনের প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে, যেমন বিএনপি সংস্কারের বিরোধী; তারা সংস্কার নয়, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। এমন প্রচারণা চালিয়ে নির্বাচনবিরোধী প্লাটফর্মকে শক্তিশালী করার টার্গেট নেয়া হয়েছে।
বিএনপি মনে করে, নির্বাচনের মাঠে তাদের ইমেজকে ক্ষতিগ্রস্ত করার এটা একটা প্রয়াস। এমন অবস্থায় বিএনপি মনে করছে, সংস্কার দ্রুত শেষ করে এবং বিচারকার্য দৃশ্যমান করে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা না হলে, রাজনৈতিক দলগুলোকে সাথে নিয়ে রাজপথে কর্মসূচি দেয়া ছাড়া হয়তো অন্য কোনো পথ খোলা থাকবে না। সেই রাজনৈতিক কর্মসূচি কোন প্রক্রিয়ায়, কিভাবে, কখন পালিত হবে- বিষয়টি নিয়ে দলের সিনিয়র নেতারা ইতোমধ্যে আলোচনা শুরু করেছেন। ঈদুল আজহার পর এ প্রক্রিয়া আরো বেশি ত্বরান্বিত হবে। তবে ঈদের আগেই প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করলে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়ে যেতে পারে।