
আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার পরিকল্পনার কথা বলে আসছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের কথা বলছে। আলোচনায় নির্বাচন থাকলেও প্রতিফলন থাকছে না আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট। যদিও সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী অর্থবছরেই অনুষ্ঠিত হতে পারে জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
এই নির্বাচনী বাজেটে দুই হাজার ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখছে অর্থ মন্ত্রণালয়। যদিও জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য আগামী অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৯২২ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছিল নির্বাচন কমিশন।
কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনের রোডম্যাপ সরকার ঘোষণা না করায় এখনই কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী নির্বাচনী বরাদ্দ বাড়ায়নি অর্থ মন্ত্রণালয়। নির্বাচনের রোডম্যাপ ও তফসিল ঘোষণা করলে তখন ব্যয় বাড়ানো যাবে। এ ক্ষেত্রে এখন বরাদ্দ কম রাখলেও সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে পারে অর্থ মন্ত্রণালয়। সরকার নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলে বিভিন্ন খাতের ব্যয় কমিয়ে এই খাতে খরচ করার সুযোগ আছে।
সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে ‘নির্বাচন’ খাতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন গত ফেব্রুয়ারিতে পাঁচ হাজার ৯২২ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে দুই দফা নির্বাচন কমিশন, অর্থ বিভাগ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত এ খাতে দুই হাজার ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অনুকূলে মোট ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূল বাজেটে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। তবে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের কারণে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৪ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা করা হয়।
২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় নির্বাচন না থাকায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয় খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল এক হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে এক হাজার ৪২৩ কোটি টাকা করা হয়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যয় ধরা হয় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল এক হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। এই অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে চার হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা করা হয়। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাজেটে এক হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। পরে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে এক হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা করা হয়। দেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল সাড়ে তিন কোটি টাকা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। জুন মাস আগামী অর্থবছরের শেষ মাস।
অর্থ মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে ‘নির্বাচন’ খাতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য পাঁচ হাজার ৯২১ কোটি ৭২ লাখ ৬০ হাজার টাকার চাহিদা দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। ইসির অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ জানিয়েছেন, মোট বরাদ্দের মধ্যে প্রায় দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা জাতীয় নির্বাচনের জন্য ব্যয় হতে পারে। এই ব্যয় নির্বাচন পরিচালনা ও আইন-শৃঙ্খলা খাতে ধরা হচ্ছে।
জানা যায়, স্থানীয় নির্বাচনের জন্য দুই হাজার ৭৯৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা চাওয়া হয়। এ ছাড়া ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র খাতে ৬৯ কোটি ২৫ লাখ টাকার চাহিদা ছিল।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার এরই মধ্যে জানিয়েছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকার ঘোষিত সময়সীমা ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী জুন-জুলাই মাসের মধ্যে এসংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করা হবে।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্বাচনী প্রস্তুতির অন্যতম বিষয় হলো প্রয়োজনীয় কেনাকাটা। ভোটের জন্য প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও ঢাকনা, ছবিসহ ভোটার তালিকা, ব্যালট পেপার, অমোচনীয় কালি, কয়েক ধরনের সিল, গালা, স্ট্যাম্প প্যাড, কালি, থলে, ১৭ ধরনের খাম, কাগজ, কলম, ছুরি, মোমবাতি, দেশলাইসহ অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ব্যালট পেপারের কাগজ সাধারণত নেওয়া হয় রাষ্ট্রায়ত্ত কর্ণফুলী পেপার মিল থেকে। ভোটের বেশ আগেই তাদের কাছে চাহিদাপত্র দেওয়া হয়। প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার পর ব্যালট পেপার ছাপা হয় সরকারি ছাপাখানায়। এর বাইরে অনেক সামগ্রী কিনতে হয় উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে। এ কারণে কিছুটা লম্বা সময় প্রয়োজন হয় কেনাকাটায়।
জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি সিটি করপোরেশন, উপজেলা-জেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ, উপনির্বাচনসহ অন্তত আড়াই হাজার নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হবে।
কমিশনের এক বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের সচিব আখতার আহমেদ জানান, নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রয়োজনীয় কাগজ কেনাকাটা ও মুদ্রণকাজ ভোটের আগে চার মাসের মধ্যে করার প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। তিনি জানান, নির্বাচনের প্রস্তুতি যেন পিছিয়ে না থাকে সে জন্য কাজগুলো গুছিয়ে রাখা হচ্ছে। নির্বাচনের তারিখ বা নির্বাচনের শিডিউল সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত হবে, তখন যেন আমাদের প্রস্তুতি অনুযায়ী অগ্রসর হওয়া যায়।
নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি রাখলেও মন্ত্রণালয় আগাম বরাদ্দ রাখছে না। সরকার রোডম্যাপ ঘোষণা করলেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্বাচনের ব্যয়ের জোগান দেবে বলে জানান মন্ত্রণালয়ের বাজেটসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এটি এমন ব্যয়, যে বরাদ্দ না রাখলেও অন্য খাত থেকে কমিয়ে নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহ করা যাবে।