
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কড়া শর্তের জালে ঘুরপাক খাচ্ছে। আইএমএফের পরামর্শ এবং অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্য সামনে রেখে শুল্ক ও কর কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এর ফলে কিছু খাতে নতুন করে করের বোঝা বাড়তে পারে, আবার কিছু খাতে মিলতে পারে স্বস্তি।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফের শর্তগুলোর অন্যতম হলো কর অব্যাহতি বাতিল, অটোমেশন চালু, ভ্যাটের অভিন্ন হার কার্যকর এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্কহারে সংস্কার আনা। এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়েই এবারের বাজেট প্রস্তাবনা তৈরি করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে আইএমএফের পরামর্শ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কারোপের বিপরীতে ১১০টি পণ্যের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার, ৬৫টি পণ্যের শুল্ক হ্রাসসহ মোট ৪৪২টি পণ্যের শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে আগামী বাজেটে। তবে উচ্চশুল্কের প্রসাধনী পণ্য, প্লাস্টিকের গৃহস্থালি পণ্য, অনলাইন বিক্রির কমিশন, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এবং সুতার ওপর নতুন করে বসছে করের খড়্গ। অন্যদিকে, প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর ওপর জোর দিতে গিয়ে কর ফাঁকিবাজদের ক্ষেত্রে নমনীয়তা প্রদর্শনের প্রস্তাব আসছে। অবৈধ রেয়াত গ্রহণ থেকে শুরু করে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য চালান আমদানিতে জরিমানার বিধান অর্ধেক করা হচ্ছে। মোবাইল ফোনসেট উৎপাদনকারী কোম্পানি ও ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীরা কিছু সুবিধা পাবেন।
এ ছাড়া নির্দিষ্ট কিছু অ্যাসোসিয়েশনকে সুবিধা দিতে গিয়ে প্রায় ৩৩ ধরনের সেবার বিপরীতে বাধ্যতামূলক রিটার্ন দাখিল প্রত্যাহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে, এবারের বাজেটে নতুন রিটার্ন দেওয়া করদাতা এবং গেজেটেড জুলাই যোদ্ধাদের জন্য সবচেয়ে বেশি সুখবর রয়েছে বলে জানা গেছে।
ভ্যাট ব্যবস্থায় যেসব পরিবর্তন আসছে: সূত্র জানায়, অবৈধ রেয়াত গ্রহণকারীদের জন্য সুখবর থাকছে আগামী অর্থবছরের বাজেটে। অবৈধ রেয়াত গ্রহণের জরিমানার বিধান ৫০ থেকে ১০০ শতাংশের পরিবর্তে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে যেসব কোম্পানি অবৈধ রেয়াত গ্রহণ করে আগে জরিমানা গুনেছে, তাদের ক্ষেত্রে আসছে শিথিলতা। তবে করোনা মহামারির পর থেকে দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা অনলাইন ব্যবসায় আসছে ভ্যাটের খড়্গ। আগামী অর্থবছরের বাজেটে অনলাইনে পণ্য বিক্রির কমিশনের ওপর ভ্যাটের হার ৫ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এ ছাড়া জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ক্ষেত্রে নতুন করে ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। এতে অনলাইন ব্যবসায় বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে। এ ছাড়া আগামী বাজেটে প্লাস্টিকের টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালি পণ্যে উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাটের হার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হচ্ছে।
যেসব পরিবর্তন আসছে আয়কর খাতে: সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে বাধ্যতামূলক রিটার্ন জমায়। সর্বশেষ অর্থবছরে প্রায় ৪৫টি সেবার বিপরীতে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু আগামী অর্থবছরে এর মধ্য থেকে ক্রেডিট কার্ডসহ ১২ ধরনের সেবার বিপরীতে রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক রেখে বাকি ৩৩ সেবায় প্রত্যাহার করা হচ্ছে। একই সঙ্গে রিটার্ন দাখিলের জরিমানা কমিয়ে যৌক্তিকীকরণের প্রস্তাব করা হতে পারে। আয়কর খাতের প্রায় সিংহভাগ কর আসে উৎসে কর থেকে। আগামী অর্থবছরে নতুন করে প্রতি মাসের পরিবর্তে ত্রৈমাসিক করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারি সংস্থা, কর্তৃপক্ষ, কমিশন, ইনস্টিটিউট, একাডেমিসহ অনুরূপ সংস্থা, যারা বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করে না, সেসব প্রতিষ্ঠানের রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতার বিধান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে উৎসে কর ১০ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। তবে সিকিউরিটিজের উৎসে কর ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব আসছে। এ ছাড়া ১৫২ পণ্যের অগ্রিম আয়কর ২ শতাংশ করা হচ্ছে। আর সিগারেটের বিক্রয়মূল্যের ওপর আরোপিত শুল্ক ৩ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এ ছাড়া লিস্টেড-নন লিস্টেড কোম্পানির করহারের ব্যবধান ৫ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হচ্ছে।
তবে সুখবর আসছে জুলাই যোদ্ধাদের জন্য। গেজেটেড আহত জুলাই যোদ্ধাদের করমুক্ত আয়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সুখবর রয়েছে, প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের জন্যও। তাদের করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এ ছাড়া সাধারণ করমুক্ত আয়সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে। তবে কোম্পানি করদাতাদের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না এলেও মার্চেন্ট ব্যাংকের কর হার ১০ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করার প্রস্তাব আসছে। এর বাইরে জমি বা জমিসহ স্থাপনা হস্তান্তরকালে দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গেলে মূলধনি আয়ের ওপর করারোপের বিধান আসছে। স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাদের টার্নওভার ট্যাক্সের সীমা ৩ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। অন্যদিকে, বড় সুখবর আসছে মোবাইল অপারেটরদের জন্য। তাদের টার্নওভার ট্যাক্স ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে দেড় শতাংশ করা হচ্ছে।
শুল্ক খাতে আরও যত পরিবর্তন আসছে: অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য চালান আমদানিকারকদের জন্য সুখবর থাকছে আগামী অর্থবছরের বাজেটে। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি করলে সর্বোচ্চ ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানার বিধান শিথিল করে ২০০ শতাংশ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা ট্যারিফের বিপরীতে ১১৬টি পণ্যের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার, ৬৫ পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো এবং ৯টি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হচ্ছে আগামী বাজেটে। এ ছাড়া সর্বমোট ৪৪২টি পণ্যের শুল্ককর কমানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। ট্যারিফ ও ন্যূনতম যৌক্তিকীকরণের হিসেবে ৮৪ পণ্যের ন্যূনতম মূল্য প্রত্যাহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে, ২৩টি পণ্যের ন্যূনতম মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছর শুল্ক কাঠামোর ছয়টি স্তরে নতুন করে ৩ শতাংশের একটি নতুন স্তর যোগ করা হচ্ছে। আর আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্কের ১২টি স্তরের মধ্যে ৪০ শতাংশ হিসেবে নতুন একটি স্তর যোগ করা হচ্ছে আগামী বাজেটে। বড় সুখবর আসছে বন্ডেড প্রতিষ্ঠান মালিকদের জন্য। সেন্ট্রাল বন্ডেড ওয়্যার হাউস ও ফ্রি জোন বন্ডেড ওয়্যার হাউস ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হচ্ছে। আর বিলম্বে শুল্ক পরিশোধের সর্বোচ্চ মেয়াদ দুই বছর করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। সুখবর আসছে রেফারেল হাসপাতাল নির্মাণ, ইলেকট্রিক বাইক উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিতেও। এ ছাড়া ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি এবং এপিআই তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি সুবিধা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে আগামী বাজেটে। এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে চিনি আমদানির শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। তবে খড়্গ চেপেছে প্রসাধন পণ্যের ওপর মেকআপের জনপ্রিয় প্রসাধনী লিপিস্টিকের ন্যূনতম ট্যারিফ ভ্যালু ২০ ডলারের পরিবর্তে ৪০ ডলার করার প্রস্তাব করা হচ্ছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক দশকে দেওয়া কর অব্যাহতি তুলে দেওয়া ছিল আইএমএফের অন্যতম শর্ত। ২০২৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে তিন ধাপে বিদ্যমান সব ধরনের করছাড় বাতিল করতে হবে। এ ছাড়া আয়কর আইনের ৭৬ (১) ধারা বাতিলের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে করছাড় দেওয়ার স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা বাতিলের শর্তও মানতে বলেছে সংস্থাটি।
গত পাঁচ দশকে দুইশর বেশি প্রজ্ঞাপন জারি করে বিভিন্ন খাতকে করছাড় দেওয়া হয়েছে। আয়কর ও শুল্ক খাতে কত ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে এনবিআর দুটি আলাদা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এ ছাড়া আইএমএফ দেশে একটি একক হারে ভ্যাট আদায়ের পক্ষে। বর্তমানে শূন্য থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত একাধিক হারে ভ্যাট আদায় করে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ। আর করদাতাদের হয়রানি কমাতে অটোমেশনে জোর দেওয়াসহ বেশকিছু শর্ত রয়েছে। আইএমএফের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব আসছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাস্টমসের সাবেক কমিশনার আব্দুল কাফি কালবেলাকে বলেন, বন্ডিং প্রাপ্যতা সাধারণত প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি বিবেচনায় বাড়ানো হয়ে থাকে। আগামী বাজেটে যদি প্রাপ্যতা বাড়ানো হয়, তবে তা শর্ত সাপেক্ষে হওয়া উচিত। কারণ হিসেবে এই কর্মকর্তা বলেন, এ ক্ষেত্রে রাজস্ব লিকেজের সুযোগ রয়েছে।
তবে মিথ্যা ঘোষণায় জরিমানার পরিমাণ কমানো ব্যবসাবান্ধব হতে পারে বলেও মনে করেন। আর বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিল।
অবৈধ রেয়াত গ্রহণের জরিমানা কমানোর বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, আগে অবৈধ রেয়াত গ্রহণের ক্ষেত্রে জরিমানা ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত ছিল। গত বাজেটের আগে এটা কমিয়ে ১০০ শতাংশে আনা হয়েছে।
তবে যেহেতু অবৈধ রেয়াত প্রমাণিত হলে সরকারি কোষাগারে অর্থ আসে, সে হিসেবে বিষয়টি এত বেশি নেতিবাচক হবে না বলেও অভিমত এই কর্মকর্তার।