
ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে বহুমুখী তদন্ত শুরু হয়েছে। বিএফআইইউ, দ্য স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি (এসটিএআর), ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি করাপশন কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (আইএসিসিসি), যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস এবং ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাসেট রিকভারি (আইসিএআর) তদন্ত করছে। তাদের তদন্তে বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং এবং কেইম্যান দ্বীপপুঞ্জে সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত প্রাথমিক তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে শেখ হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে দেশে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার সম্পদ আটক করা হয়েছে। প্রকল্পের নামে বিদেশে ১ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা পাচার বা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। একাধিক তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৫টি দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্বাচলে রাজউকের ৬টি প্লট দখল; সূচনা ফাউন্ডেশন, সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন বা সিআরআই ও বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের দুর্নীতি; রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে ৪৮৩ কোটি ৮৪ লাখ ডলার বা প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ; যুক্তরাষ্ট্রে ৩০০ কোটি ডলার বা ৩৭ হাজার কোটি টাকা পাচার এবং ৮টি সরকারি প্রকল্প থেকে ১৭৭ কোটি ২০ লাখ ডলার বা ২২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
এসব অভিযোগে কয়েকটি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোয় এখন পর্যন্ত আদালতের মাধ্যমে দেশের ভেতরে ৮৮৭ কোটি টাকার স্থাবর সম্পত্তি এবং ১ হাজার ৪৫ কোটি ২৫ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে। অবরুদ্ধ করা হয়েছে ১ হাজার ৯৩২ কোটি ২৫ লাখ টাকার সম্পদ। এসব দুর্নীতির সপক্ষে সব ধরনের তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছে তদন্ত সংস্থাগুলো।
আদালত কর্তৃক স্থাবর সম্পত্তি সংযুক্তকরণের মধ্যে রয়েছে পূর্বাচলে ৬০ কাঠা জমি বা ৬টি প্লট, দলিল মূল্যে যার দাম ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বাজারমূল্যে ১২০ কোটি টাকা। গুলশান ও সেগুনবাগিচায় ৯টি ফ্ল্যাট, গুলশানে ১টি বাড়ি এবং খুলনার দিঘলিয়ায় ২ দশমিক ০৪ একর জমি। দলিল মূল্যে যার দাম ১৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, বাজারমূল্যে ৭৬৭ কোটি টাকা। এ দুই খাতে সম্পত্তির বাজারমূল্য ৮৮৭ কোটি টাকা। অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে ১৫৬টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এগুলোয় স্থিতি হিসাবে আছে ১ হাজার ৪৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে ৫৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে ৪৬৫ কোটি টাকা। এখন স্থিতি আছে ৬৭ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ব্যাংকের করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বা সিএসআর তহবিলের টাকা থেকে সূচনা ফাউন্ডেশনে প্রায় ৩৩ কোটি টাকার জোগান দেওয়া হয়েছে। এক্সিম ব্যাংক ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকগুলো থেকে এসব অর্থ সূচনা ফাউন্ডেশনের হিসাবে জমা করতে সহায়তা করেন। ব্যাংকগুলোর সিএসআর ফান্ডের টাকা সূচনা ফাউন্ডেশনে দিতে বিএবি থেকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগের দলীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) নামে ৩৫ কোটি ২১ লাখ টাকার এফডিআর রয়েছে। সংস্থাটির লেনদেন সম্পর্কে আরও তদন্ত হচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে আছেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ভাইস চেয়ারম্যান এবং শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এর ট্রাস্টি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সঙ্গে রয়েছেন শেখ হাসিনা, বোন শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাবে স্থিতি ১৬ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর লেনদেন নিয়ে আরও তদন্ত চলছে।
বিদেশে পাচার করা সম্পদ শনাক্ত করতে বিএফআইইউ তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাচার করা অর্থ উদ্ধারে কাজ করা আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান চারটি প্রভাবশালী সংস্থার সহায়তা নিচ্ছে সরকার। এগুলো হচ্ছে-দ্য স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি (এসটিএআর), ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি করাপশন কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (আইএসিসিসি), যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস এবং ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাসেট রিকভারি (আইসিএআর)। শেখ হাসিনা পরিবারের পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে এ সংস্থাগুলোও সরকারকে সহযোগিতা করছে। তাদের তদন্তে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং এবং কেইম্যান দ্বীপপুঞ্জে সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে আরও বিশদ অনুসন্ধান চলছে। এ প্রক্রিয়ায় সম্পদের তথ্য সুনর্দিষ্টভাবে শনাক্ত করে ওইসব সম্পদের আরও তথ্য চাওয়া এবং সম্পদ জব্দ করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে মিচুয়্যাল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট বা এমএলএআর পাঠানো হবে।
এদিকে সোমবার রাতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার বোন ও যুক্তরাজ্যের সাবেক সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিকের মা শেখ রেহানার মালিকানাধীন লন্ডনের একটি বাড়ি ফ্রিজ করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) এটি জব্দ করেছে। ভবিষ্যতে যাতে বাড়িটি বিক্রি করতে না পারে, সেজন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ১৪ বছর ধরে এটি টিউলিপ পরিবারের প্রধান বাড়ি হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। শেখ রেহানা ২০১১ সালে ১২ লাখ পাউন্ডে এটি কিনেছিলেন। পাউন্ডের বর্তমান বাজার দর ১৬৯ টাকা হিসাবে ১২ লাখ পাউন্ড বাংলাদেশি মুদ্রায় দাঁড়াচ্ছে ২০ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
এদিকে ১৭ থেকে ২১ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর লন্ডন সফর করে এসেছেন। ওই সময়ে তিনি দেশটির মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কর্তৃপক্ষ, দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেন। ওইসব বৈঠকের পর লন্ডনে বাংলাদেশিদের পাচার করা সম্পদের একটি তালিকা পাঠানো হয়। সেগুলোর বিষয়ে দেশটির সরকার এখন অনুসন্ধান করছে বলে জানা গেছে। পাচার করা সম্পদ উদ্ধার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে গভর্নর ভবিষ্যতে আবারও লন্ডন যাবেন বলে জানা গেছে। এর আগে তিনি পাচার করা সম্পদ উদ্ধারের বিষয়ে দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে সিঙ্গাপুর যেতে পারেন বলে জানা গেছে।