Image description
দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পালিয়েছেন ফারুক

রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী নেতা ওমর ফারুক চৌধুরী। ছিলেন রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের চারবারের সংসদ-সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী। অপরিসীম ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য, হেরোইন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোহারা, সরকারি দপ্তরের অর্থ আত্মসাৎ, হাট-ঘাট ও বালুমহাল দখলসহ বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। রাজশাহীতে ফারুকের রয়েছে শতকোটি টাকার বিলাসবহুল ভবন। রয়েছে বাড়ি-গাড়ি, শপিংমল, বাগান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কিনেছেন তিনশ বিঘা জমি। ঢাকায় রয়েছে ফ্ল্যাট ও দামি প্লট। বেপরোয়া ফারুক বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সেখানেও রয়েছে তার বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

অবাক করার বিষয়-দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ফারুক মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে ঢাকা ছেড়ে ভারতে পালিয়েছেন। সেখান থেকে ফোনে ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এদের মধ্যে একজন যুগান্তরের কাছে বিষয়টি স্বীকার করেছেন। আত্মগোপনে থাকা ফারকের অঢেল সম্পদ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আগলে রেখেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় অর্থবিষয়ক সম্পাদক রশিদুজ্জামান মিল্লাতের ছেলে শাহাদাত বিন জামান শোভন। মিল্লাত জামালপুর থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ-সদস্য।

ফারুকের বড় মেয়ে নাজিফা হক চৌধুরীর সঙ্গে শোভনের বিয়ে হয়েছে। ফলে সম্পর্কে ফারুকের বেয়াই মিল্লাত। ৫ আগস্টের পর রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বাড়িঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ফারুকের অঢেল সম্পদে কেউ ফুলের টোকাও দিতে পারেননি। বাড়ি, ব্যবসা, মূল্যবান জমি, বাগান, পুকুরসহ সব সম্পদ শোভনের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।

দুদকের মামলা ও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা : জুলাই অভ্যুত্থানে হামলার ঘটনায় ফারুকের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। এছাড়াও বিপুল পরিমাণ ‘অবৈধ সম্পদ’ এবং বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগে ফারুক ও তার স্ত্রী নিগার চৌধুরীর বিরুদ্ধে মার্চে দুদক ঢাকায় দুটি মামলা করেছে। দেশত্যাগেও এ দম্পতির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

থিম ওমর প্লাজার ভাড়া তুলছেন শোভন : রাজশাহীতে ফারুক চৌধুরীর ‘থিম ওমর প্লাজা’ নামে শতকোটি টাকার একটি দশতলা ভবন রয়েছে। এ ভবনের অর্ধশতাধিক দোকান এবং ২০টি ফ্ল্যাট থেকে প্রতিমাসে অর্ধকোটি টাকা ভাড়া তুলছেন শোভন। মহানগরীর সাগরপাড়ায় সাড়ে তিন বিঘার বিশাল বাড়িটিও শোভনের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে শতকোটি টাকার জমি। এগুলোও দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন শোভন।

শোভনের তত্ত্বাবধানে গ্রামের বাড়ি, জমি, পুকুর ও বাগান : তানোরের চৌড়খৌড়ে ফারুকের গ্রামের বাড়ি। এখানে তার তিনশ বিঘার ফলের বাগান রয়েছে। রয়েছে আড়াইশ বিঘা আবাদি জমি। আর অর্ধশত বিঘার পুকুর। আব্দুর রশিদ নামের একজন প্রতিবেশী গ্রামের সম্পদের কেয়ারটেকার। তিনি বলেন, গ্রামে ফারুক চৌধুরীর অন্তত ছয়শ বিঘা জমি রয়েছে। ফারুকের মেয়ে নাজিফা ও তার স্বামী শোভন খোঁজখবর নিতে মাঝেমধ্যে আসেন। এছাড়া মোবাইল ফোনে কল দিয়ে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান করেন শোভন।

শীর্ষ হেরোইন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায় : ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে ফারুককে মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে উল্লেখ করা হয়। হেরোইন চোরাচালানের আন্তর্জাতিক রুট রাজশাহীর গোদাগাড়ী। এ এলাকার অন্তত দেড় ডজন শীর্ষ হোরোইন ব্যবসায়ীর সঙ্গে ছিল ফারুকের হট কানেকশন। তাদের মধ্যে গোদাগাড়ী পৌরসভার মাদারপুরের চার ভাই মনিরুল, মেহেদী, সোহেল ও টিপু ফারুকের কথিত ভাগিনা ছিলেন। টিপুর কাছ থেকে প্রায় ৩২ লাখ টাকা মূল্যের একটি হাইয়েস মাইক্রোবাস উপহার নেন ফারুক। বিষয়টি নিয়ে ২০২২ সালের ২৭ জুলাই যুগান্তরে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে শুরু হয় তোলপাড়। গোদাগাড়ীর মাদকসম্রাট তারেক ও তার ভাই শাহাবুদ্দিনের সঙ্গেও ফারুকের সখ্য ছিল। সম্প্রতি তারেক ৬ কেজি হেরোইনসহ গ্রেফতার হয়েছে।

এছাড়া উল্লেখযোগ্য শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে গোদাগাড়ী পৌরসভার সিএন্ডবির জাব্বার, আনিকুল, মাদারপুরের নাজিবুর ও ইসরাইল, মহিষালবাড়ির ভোদল, ডাঙাপাড়ার বীরু, মাটিকাটার ইউপি সদস্য বাবু, আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ওরফে দারোগা, আসাদুল ও শিবসগারের হেলালসহ আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে ফারুকের মাসোহারার সম্পর্ক ছিল।

আত্মগোপনে থাকা রাজশাহী জেলা যুবলীগের একজন শীর্ষ নেতা যুগান্তরকে জানান, ফারুকের হেরোইন মাফিয়াদের সঙ্গে মাসোহারা আদায়ে মধ্যস্থতা করতেন আওয়ামী লীগ নেতা ওয়েজ উদ্দিন বিশ্বাস, রবিউল আলম ও যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর। ফারুক মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

ফারুকের আরও যত সম্পদ : ফারুক এমপি থাকাকালে অন্তত তিনশ বিঘা জমি কিনেছেন। তানোরের চৌড়খৌড়ে ফারুকের গ্রামের বাড়ি। এ গ্রামের ৮০ বছর বয়সি একজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ফারুক সম্পদশালী হওয়ার জন্য মরিয়া ছিলেন। তিনি চৌড়খৌড়, শালবাড়ি, এনায়েতপুর, বাউড়ি ও চাকুত মৌজায় অন্তত ২৭৫ বিঘা জমি কিনেছেন। এর দাম বর্তমানে প্রায় সাড়ে চারশ কোটি টাকা। এছাড়া গোদাগাড়ীর যগপুর মৌজায় ফারুক কিনেছেন ৩০ বিঘা জমি। এ জমি কিনতে সহায়তা করেন আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ আব্দুল আউয়াল রাজু। রাজু বর্তমানে কয়েকটি মামলার আসামি। এ বিষয়ে জানতে তার মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগে ফারুক ১০ থেকে ২৫ লাখ টাকা নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অবৈধ খাত থেকে আসা টাকার হিসাব রাখতেন আলাউল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। এ ব্যাপারে আলাউল বলেন, আমি ফারুক চৌধুরীর চেম্বারে একসময় কাজ করতাম। তবে এখন এসব বিষয়ে কথা বলব না।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ফারুক ঢাকার তিনশ ফিট এলাকায় ১১ কাঠা জমি কিনেছেন। এ জমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা। এছাড়া লালমাটিয়ায় রয়েছে ৫ কাঠার প্লট। তিনি হুন্ডির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানে তার রয়েছে বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

শ্বশুর ফারুক চৌধুরীর সম্পদ তত্ত্বাবধানের বিষয়ে জানতে বিএনপি নেতা মিল্লাতের ছেলে শোভনকে বেশ কয়েকবার ফোনে কল দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি প্রতিবারই সংযোগ কেটে দেন। তবে ফারুকের বড় মেয়ে নাজিফা বলেন, আমার স্বামী শোভন বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করেন না। ফ্ল্যাট ও শপিংমলের ভাড়া আমরাই উত্তোলন করি। শোভনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হচ্ছে তা ভিত্তিহীন।

এ বিষয়ে জানতে রোববার বিকালে বিএনপি নেতা রশিদুজ্জামান মিল্লাতের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে পরিচয় দিয়ে মেসেজ পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

ভারতে পালিয়েছেন ফারুক : মাত্র এক সপ্তাহ আগে ফারুক ভারতে পালিয়েছেন। বুধবার গোদাগাড়ীর আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে তিনি মোবাইল ফোনে কথা বলেন। আজাদ যুগান্তরকে বলেন, খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ফারুক চৌধুরী আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। এক সপ্তাহ আগে ভারতে গেছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি অসুস্থ, চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর বেশিকিছু বলেননি। ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে যে ফোন নম্বরে কথা হয়েছে, সেটি চাওয়া হলে তিনি +৬০ ১১-২৬৩৮ ৮৪০০ হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটি দেন। পরে এ নম্বরে কল দেওয়া হলে ফারুক চৌধুরী রিসিভ করেন। তিনি কোন দেশে আছেন জানতে চাইলে বলেন, কোন দেশে আছি সেটা এখন বলা যাবে না। তার মেয়ের জামাই তার সম্পদের দেখভাল করছেন কি না জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চান না জানিয়ে সংযোগ কেটে দেন।