
মামলার ১ নম্বর সাক্ষী (বাদী) কোনো সাক্ষ্য দেননি। বিচারকের হাতে ছিলো না দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীর মূল কপি। কথিত ‘অভিযুক্ত’ তারেক রহমান এবং ডা: জুবাইদা রহমানও ছিলেন অনুপস্থিত। এছাড়া তারেক রহমানের জমা দেয়া প্রকৃত সম্পদ বিবরণী নিশ্চিত না হয়েই ঘোষণা করা হয় ডা: জুবাইদা রহমানের কারাদ-। আইনজ্ঞদের দৃষ্টিতে যা নজিরবিহীন। বিচারের নামে প্রহসন। যেনতেন প্রকারে জিয়া পরিবারের এই নিরপরাধ গৃহবধূকে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করাই ছিলো যেন হাসিনা সরকারের মূল উদ্দেশ্য। কারণ একটাই। তিনি শেখ হাসিনার প্রধান রাজনৈতিক দুশমন বেগম খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ। তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তথা শেখ হাসিনার নির্দেশনা। জিয়া পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করতে হবে। কারাদ- দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। ডা: জুবাইদা রহমান শেখ হাসিনার তেমনই ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার। দ-াদেশ দিতেই হবে। ‘বিচারক’ নামের বিতর্কিত জুডিশিয়াল ক্যাডার মো: আছাদুজ্জামান বিচারক পরিচয় ভুলে গিয়ে করলেন আওয়ামী লীগের মেঠো রাজনীতি। কোনো ধরনের অপরাধ খুঁজে না পেলেও ডা: জুবাইদা রহমানকে দেন ৩ বছরের কারাদ-। জরিমানা করা হয় ৩৫ লাখ টাকা। আজকে হাসিনামুক্ত বাংলাদেশে ২০২৩ সালের ২ আগস্ট দেয়া ৫০ পৃষ্ঠার রায় পর্যালোচনার দাবি রাখে বৈকি।
মামলাটিতে দুদকের পক্ষে ডা: জুবাইদা রহমানকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের অনুরোধ জানিয়েছিলেন স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল। যিনি ছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানকালে ছাত্র-জনতা হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন আনিসুল হক। পলাতক রয়েছেন অ্যাড. মোশাররফ হোসেন কাজল। তবে বিচারক মো: আছাদুজ্জামান গত বছর ৮ ফেব্রুয়ারি স্বাভাবিক অবসরে গিয়ে নির্বিঘœ জীবন যাপন করছেন।
বাদীর সাক্ষ্য ছাড়াই কারাদ- : মামলার বাদীর সাক্ষ্য ছাড়াই কারাদ- দেয়া হয়েছিলো ডা: জুবাইদা রহমানকে। অথচ রায়ে বাদী সাক্ষ্য দিয়েছেনÑ মর্মে উল্লেখ করেন বিচারক মো: আছাদুজ্জামান। মামলার আসামি ছিলেন মোট ৩ জন। অথচ এজাহারে বর্ণিত আসামি তারেক রহমানের অংশটিতেই শুধু এজাহার পাঠ করেছিলেন বাদী। সেটিকে ধরা হয় ‘সাক্ষ্য’ হিসেবে। পক্ষান্তরে, ডা: জুবাইদা রহমানের অংশে কোনো সাক্ষ্যই দেননি।
রায়ের ৩ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়, মামলাটি রুজু হওয়ার পর তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দুদকের (তৎকালীন) সহকারী পরিচালক মো: তৌফিকুল ইসলাম তদনান্তে আসামি তারেক রহমান, জুবাইদা রহমান খান ও সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪-এর ২৬(২) ও ২৭ (১) ও তৎসহ পেনাল কোডের ১০৯ ধারায় অপরাধের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে উল্লেখে প্রতিবেদন তথা চার্জশিট দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষ্য নেয়া হয় ৪২ জনের। রায়ে আসামিপক্ষের সাক্ষীর বিষয়ে উল্লেখ করা হয়, আসামিপক্ষ পলাতক থাকায় তাদের পক্ষে আদৌ কোনো দালিলিক, মৌখিক ভাব বস্তুগত সাক্ষ্য উপস্থাপিত হয়নি।
রায়ের ৭ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘সাক্ষ্য’ প্রসঙ্গে বলা হয়, প্রসিকিউশন পক্ষে উপস্থাপিত উক্ত সাক্ষীগণের মধ্যে ১নং সাক্ষী মো: জহিরুল হুদা জবানবন্দীতে তার এজাহার সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন। উক্ত জবানবন্দীতে তিনি এই মর্মে উল্লেখ করেন করেন যে, তিনি ১৮-০৬-২০০৮ খ্রি: তারিখে দুদকের উপ-পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। ওইদিন দুদকের স্মারক নং-দুদক ১২৪-২০০৭ (অনু-২)-২৭৫১, তারিখ ১৪-০৬-২০০৭ খ্রি: মূলে প্রদত্ত আদেশ মোতাবেক আসামি তারেক রহমান, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব, বিএনপি’র দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী যাচাইয়ের জন্য তাকে হাওলা করা হয়।’
তবে রায়ে উল্লেখিত এই ‘১ নং’ সাক্ষী আদালতে কোনো সাক্ষ্য দেননি বলে দাবি করেন তদন্ত কর্মকর্তা। দৈনিক ইনকিলাব প্রতিবেদকের কাছে মুখ খোলেন আলোচিত এ মামলার বাদী পরিচালক (তৎকালীন উপ-পরিচালক) ড. মোহাম্মদ জহিরুল হুদা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই ছাত্রদল নেতা আলাপচারিতায় বলেন, মামলার আসামি ছিলেন তিন জন। তিন জনের বিরুদ্ধেই আমার সাক্ষ্য পাঠ করার কথা। কিন্তু আমি কেবলমাত্র তারেক রহমানের অংশটুকুন পাঠ করেছি। ডা: জুবাইদা রহমান এবং সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর বিরুদ্ধে এজাহারে বর্ণিত ঘটনা সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করিনি।
তিনি বলেন, বাদী হিসেবে আমি এজাহার-পূর্ববর্তী অনুসন্ধানকালে টাস্কফোর্স কর্তৃক সংগৃহীত আলামত এবং রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে টাস্কফোর্স কর্তৃক যে অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয় সেই প্রক্রিয়ায় আমি একজন সদস্য মাত্র। মামলাটি দুদক সম্পর্কিত হওয়ায় দুদকের প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে সাক্ষর করতে হয়েছিলো।
মেট্রো: বিশেষ মামলা নং-৩৪১/২০২২। কাফরুল থানা মামলা নং-২২, ২৬-০৯-২০০৭। যে মামলাটি দুর্নীতি দমন কমিশনে তৎকালীন ওয়ান-ইলেভেন সরকার আমলে উদ্ভব হয়। মামলাটি (নং-৫২) তখন মোহাম্মদ জহিরুল হুদাকে দিয়ে রুজু করানো হয়। আসামি করা হয় বিএনপি’র তৎকালীন যুগ্ম-মহাসচিব (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) তারেক রহমান, তার স্ত্রী ডা: জুবাইদা রহমান খান এবং ডা: জুবাইদার মা সৈয়দা ইকবালমান্দ বানুকে। ধারা প্রয়োগ করা হয় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪-এর ২৬(২) ও ২৭ (১) এবং দ-বিধির ১০৯।
মামলা প্রসঙ্গে বাদী মোহাম্মদ জহিরুল হুদা বলেন, এজাহারে বিষয়বস্তু যা কিছুই থাকুক না কেন, পরবর্তীতে মামলাটি ২০২৩ সালের মে মাসে আমাকে সাক্ষ্যের জন্য ডাকা হয়। আমি উপস্থিত হই। সাক্ষী হিসেবে আমি শুধু মামলাটির এজাহার পাঠ করেছি মাত্র। মামলাটির প্রথমাংশে বিএনপি’র বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জনাব তারেক রহমানের বিষয়টি এজাহারে যেভাবে লিপিবদ্ধ ছিলো সেভাবেই পাঠ করে এসেছি। কোনো প্রশ্ন আসেনি। কোনো ধরনের জেরা না থাকায় আমাকে কোনো প্রশ্নের উত্তরও দিতে হয়নি। এজাহারের অংশটি পাঠ করেছি শুধু। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে যেখানে ডা: জুবাইদা রহমানের অংশ রয়েছেন যেখানে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো, তার অংশটিতে আমি আমি কোনো প্রকার সাক্ষ্য দেইনি। কারণ, ডা: জুবাইদা রহমানের মা (সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু) তার মেয়েকে টাকা দিয়েছিলেনÑ এ বিষয়টি নিয়ে তিনি হাইকোর্টে গিয়েছিলেন। তিনি যে ডা: জুবাইদা রহমানকে টাকা দিয়েছিলেন এটি হাইকোর্ট গ্রহণ করেছেন। ফলে ডা: জুবাইদা রহমানের মায়ের অংশের মামলাটি হাইকোর্ট কোয়াশ হয়ে যায়। এতে জুবাইদা রহমানের যে ৩৫ কোটি টাকা ‘অবৈধ’ হিসেবে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছিলো সেটি আর ‘অবৈধ’ থাকে না। হাইকোর্টের রায়ের বিপরীতে আই.ও. হিসেবে আমার যেহেতু কোনো বক্তব্যই থাকতে পারবে না, তাই আমি ডা: জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য উপস্থাপনই করিনি। এজাহারও পাঠ করিনি। কিন্তু পরবর্তীতে দেখতে পাই যে, এ মামলার রায়ে আমি ডা: জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিÑ মর্মে উল্লেখ করে তাকে কারাদ- দেয়া হয়েছে। এটিকে আমি একটি ‘বিচারিক গর্ভপাত’ বলে মনে করি।
প্রকৃত সম্পদ বিবরণী কোনটি : দুর্নীতি ও গুরুতর অপরাধ দমন সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের প্রধান ছিলেন সেনাবাহিনীর সিনিয়র একজন মেজর। তার সঙ্গে ছিলেন একজন আয়কর বিভাগের উপ-কর কমিশনার, পুলিশের একজন এএসপি। তারেক রহমান কর্তৃক কারাকর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাঠানো সম্পদ বিবরণী ফরম যাচাই করার দায়িত্ব ছিলো ওই টাস্কফোর্সের। টাস্কফোর্স সম্পদ বিবরণী যাচাই শেষে একটি অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করে। সেটির আলোকে কমিশন অনুমোদিত মামলাটি থানায় রুজু করা হয়। সেই মামলা তদন্ত করেন দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক মো: তৌফিকুল ইসলাম। মামলা তদন্ত শেষে মূল সম্পদ বিবরণীসহ সব আলামত বিচারার্থে আদালতে দাখিল করা হয়। মামলার বাদী হিসেবে ২০২৩ সালের মে মাসে মোহাম্মদ জহিরুল হুদা যে সাক্ষ্য দেন, সেখানে দুদকের স্পেশাল পিপি মোশাররফ হোসেন কাজল আলামত হিসেবে তারেক রহমানের মূল সম্পদ বিবরণী আদালতে জহিরুল হুদাকে দিয়ে উপস্থাপন করান। রাত প্রায় ৮টার দিকে এ আলামত (মূল সম্পদ বিবরণী) উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতি দুদকের তৎকালীন কোর্ট ইন্সপেক্টর (প্রসিকিউশন) মো: আমিনুল ইসলাম এবং মোশাররফ হোসেন কাজল দুর্নীতি দমন কমিশনে অফিসিয়ালি চিঠি লিখে দুদক থেকে পুনরায় তারেক রহমানের দাখিলকৃত ‘মূল সম্পদ বিবরণী’ এনে দাখিল করেন। তাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কোন্টা ‘মূল’ সম্পদ বিবরণী? আগে দাখিলকৃত বিবরণী? নাকি পরবর্তীতে চিঠি দিয়ে দুদক থেকে নেয়া দ্বিতীয় সম্পদ বিবরণী?
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাড. মো: দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, কোনো ফটোকপির ওপর ভিত্তি করে বিচার হতে পারে না। যদি ফটোকপির ওপর রায় থাকে তাহলে বিচারককে এর ব্যাখ্যা দিতে হবে। যদি সি.ডি. ‘লস্ট অ্যান্ড মিসড’ হয়ে থাকে তাহলে পুরো রেকর্ড পুনর্গঠন হবে। ফটোকপি কখনো মূল কপি হতে পারে না।
এমন গুরুতর প্রশ্ন ধামাচাপা দিয়েই ডা: জুবাইদা রহমানকে দেয়া হয় ৩ বছর কারাদ-। ৩৫ লাখ টাকা জরিমানা।