Image description

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর বিভক্তি এখন দৃশ্যমান। বিভিন্ন ইস্যুতে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে বিএনপি, জামায়াত ও অভ্যুত্থানের পর জন্ম নেওয়া দল এনসিপি। এর মধ্যে একাত্তর ইস্যুতে জামায়াত ও এনসিপির নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য নিবন্ধন না থাকা দল দুটির মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছে। আর বিএনপির সঙ্গে নতুন করে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে এনসিপি।

বিএনপি দ্রুত জাতীয় নির্বাচন চায়। পক্ষান্তরে এনসিপি চাচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। দল দুটির নেতারা একে অপরকে দোষারাপ করতে কোনো কমতি রাখছে না। এনসিপির নেতারা বলছেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের জায়গায় অবস্থান নিচ্ছে। আর বিএনপি নেতাদের দাবি, আওয়ামী লীগ নেতাদের দলে ভেড়াচ্ছে এনসিপি। সঙ্গে যোগ করেছে, দুর্নীতির অভিযোগও।

ঢাকা দক্ষিণে মেয়র পদে বিএনপি নেতা ইশরাককে বসানোর ইস্যুতে দুই রাজনৈতিক দলের দূরত্ব বহুদূর গড়িয়েছে। আদালত থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়া ইশরাকের সমর্থক ও বিএনপির নেতাকর্মীদের দাবি, ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়ার কারণে মেয়র হিসেবে শপথ নিতে পারছে না ইশরাক। তারা দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও করছে। অন্যদিকে, এনসিপির নেতাকর্মীরা আইন উপদেষ্টাসহ বিএনপিপন্থি হিসেবে পরিচিত তিন উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি করছে।

নির্বাচন, ইশরাক ইস্যু ছাড়াও সংস্কার, রাখাইনে মানবিক করিডর এবং চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া নিয়ে বিএনপি ও এনসিপির পালটাপালটি বক্তব্য পরিস্থিতিকে জটিল এক সমীকরণের পথে নিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমানে রাজনীতির মাঠের অন্যতম শক্তি বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির এ রকম বিরোধকে খুবই দুর্ভাগ্যজনক বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, এ বিরোধের পেছনে কোনো তৃতীয় শক্তি কাজ করে থাকতে পারে। যারা দেশকে স্থিতিশীল দেখতে চায় না। তবে এভাবে চলতে থাকলে পতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সুযোগ নেবে। যা গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এজন্য সরকারের উচিত কোনো ষড়যন্ত্রকে সুযোগ না দিয়ে দেশকে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাওয়া। নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে বেশি মনোযোগী হলে সবার জন্য মহাবিপদ ডেকে আনতে পারে।

তারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর আন্দোলন করেছে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। সর্বশেষ ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে। তাদের মূল চেতনা ও স্বপ্ন ছিল গণতন্ত্র ও একটি নির্বাচিত সরকার। ভোটে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে, বাকি সংস্কার করবে নির্বাচিত সরকার। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে একে অপরকে শত্রু মনে করে নানাভাবে বিষোদগার ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলেন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে যারা রক্ত দিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের কেউ ক্ষমতার ভাগ নিতে চাননি। জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসে দেশ পরিচালনা করেছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। কিন্তু এবার এর বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। দেশের মুক্তিকামী জনতার প্রত্যাশা অনুযায়ী এক ধরণের প্রত্যাশা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলেও পরে ভিন্ন প্রেক্ষাপট সামনে আসে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী মনে করেন, জাতীয় ঐক্য না হলে কোনো দেশ গুরুত্বপূর্ণ সংকটের সমাধান করতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য, গণঅভ্যুত্থানের সময়ে যে ঐক্য ছিল, তা এখন নেই। দলগুলো একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি। তাদের মধ্যে একেবারেই ঐক্য ভেঙে পড়েছে। আবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও একটা ঢিলেঢালা ভাব, গড়িমসি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সরকার ১০ মাসে পড়েছে, অথচ সংস্কারে কোনো অগ্রগতি নেই। শুরু থেকেই সরকারের ম্যান্ডেটই ছিল দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দেশকে নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাবে। সরকার তো সেটিও করছে না। সব কিছু মিলিয়ে মনে হয়, বাংলাদেশের রাজনীতি একটা টালমাটাল অবস্থায় চলে যাচ্ছে।

এনসিপির কথা টেনে সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘নতুন রাজনৈতিক দল তাদের কর্মকাণ্ডে মনে হয়, জাতীয় নির্বাচনটাকে তারা বিলম্বিত করতে চায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে-নির্বাচনটা বিলম্বিত করাই তাদের মূল উদ্দেশ্যে। সুতরাং এ মুহূর্তে দেশ নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছি না। তবে এ সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো সবার ঐক্য। এর বাইরে সমাধান খোঁজা বোকামি। কেননা, নানা রকম দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রও এখন বড় ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এসব প্রতিরোধ করতে হবে।

এদিকে আশার কথা, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য তৈরি হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চায় বিএনপিসহ অন্তত ৫০টি রাজনৈতিক দল। দ্রুত সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের দাবি জানিয়ে আসছে দলগুলো। তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন চায় না। তবে নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও গণপরিষদ নির্বাচনসহ আরও কয়েকটি দাবি জানিয়ে আসছে। আবার জামায়াতে ইসলামীও চায় আগে স্থানীয় নির্বাচন।

চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মনে করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। বুধবার ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে অফিসার্স অ্যাড্রেসে নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সেনাপ্রধান আরও স্পষ্ট করে বলেন, তিনি ২০২৬ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের হাতে দেখতে চান। ফলে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের দাবির সঙ্গে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের মধ্যে সহমতের আভাস রয়েছে। এ বিষয়টি ইতিবাচক বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ৯ মাস পার হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী কিছু হচ্ছে না। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে সবকিছু অস্পষ্ট করে রাখা হয়েছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষের মতামত উপেক্ষা করে নির্বাচন পেছানো হচ্ছে। তিনি বলেন, আকাঙ্ক্ষা থাকা দোষের না। তবে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে নিজেদের অবস্থানকে অনেকে বিবেচনায় নিয়ে রাতারাতি অনেক কিছু হতে চাইছেন। সমস্যাটি এখানেই। তিনি বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে-১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০- এর গণ-অভ্যুত্থানে যারা রক্ত দিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের কেউ ক্ষমতার ভাগ নিতে চাননি। কিন্তু এখন আমরা ভিন্ন চিত্র দেখতে পারছি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাবেক সচিব আবু আলম শহিদ খান বলেন, এখন জনগণের কাছে অনেক বার্তা যাচ্ছে। একাত্তর, নব্বই ও চব্বিশকে মিলিয়ে জনগণ যে আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের পরিণতি দেখতে চেয়েছিলেন সেখানে এখন যা দেখছেন তাতে তারা হতাশ। তাদের স্বপ্নটা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। এটা খুব স্বাভাবিক। তাই রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, এনসিপি আন্দোলন করছে স্থানীয় নির্বাচন আগে দিতে হবে, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। কিন্তু এ নির্বাচন কমিশন তো এই সরকারই বানিয়েছে। এই দুটি দাবির সঙ্গেই তো অনেকে একমত হবেন না। বিশেষ করে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবির সঙ্গে বড় দল বিএনপি কখনোই একমত হবে না। কারণ বিএনপি জানে স্থানীয় নির্বাচন আগে হওয়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। আগের স্বৈরশাসনের সময়েও হয়েছে-নতুন রাজনৈতিক দলকে শক্তি জোগানের জন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করা হয়েছে। সেখানে বিএনপি ফিরে যাবে কেন? এনসিপিকে চিন্তা করতে হবে তারা কি কি বিষয়ে একটা বড় ঐকমত্যে পৌঁছাবে।