
উচ্চ আদালতের রায়ের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়ানো এখন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। বিষয়টি ফয়সালা করতে বিএনপি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় উভয়পক্ষই ইতিবাচক। তবে আইনি বাধা এখনো আছে মনে করে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে মন্ত্রণালয়। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির অপেক্ষা কবে শপথ নেবে ইশরাক হোসেন। এদিকে এক ফেসবুক বার্তায় ইশরাক হোসেন নিজেকে জনতার মেয়র দাবি করে বলেছেন, শপথ কেবল ফরমালিটি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে উচ্চ আদালত ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে শপথ পড়াতে রায় দেন। রায় ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর ওইদিন বিকেলেই ইশরাক হোসেন কাকরাইলে ঢাকাবাসীর প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে তাকে শপথ পড়াতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে সবাইকে রাজপথ ছাড়ার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশ মেনে কয়েক হাজার ঢাকাবাসী সঙ্গে সঙ্গে রাজপথ ছেড়ে যার যার ঘরে ফিরে যান। আজ শনিবার বিকেল ৫টায় ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম শেষ হচ্ছে।
জানা যায়, ইশরাক হোসেনের শপথের বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আইনগত বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। তাকে মেয়র পদে শপথ করালে আইনগত কোনো সমস্যা হয় কি না বা মেয়র পদে বসালে তিনি কতদিন দায়িত্ব পালন করতে পারবেন এবং তার মেয়াদকাল শেষে নির্বাচন কিভাবে হবে এসব বিষয়ে আইনবিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া হচ্ছে। নানা জটিলতার পর এখন শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলে মেয়র হিসেবে তিনি কতদিন দায়িত্ব পালন করতে পারবেন সে প্রশ্ন উঠেছে। তার আগে অবশ্য দেখার পালা কবে শপথ নিচ্ছে ইশরাক। বিএনপি নেতাকর্মীরাও সেই অপেক্ষাই করছেন।
সিটি কর্পোরেশন আইন অনুযায়ী নির্বাচিত মেয়রের মেয়াদকাল ৫ বছর। তবে ৫ বছর মেয়াদ পূর্তির আগের ১৮০ দিনের (৬ মাস) মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার বিধান রয়েছে। তবে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের ৫ বছর মেয়াদ শুরু হয় প্রথম বোর্ড সভার দিন থেকে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে মেয়র নির্বাচিত করা হয়। যদিও ওই নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে ইশরাক হোসেন তাকে মেয়র নির্বাচিত করতে নির্বাচন ট্রইব্যুনালে মামলা করেন।
ওই মামলা তখন আমলে না নিয়ে ফজলে নূর তাপসকেই মেয়র ঘোষণা করে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন। ওই বছর ১৬ মে শপথ নিয়ে মেয়রের দায়িত্ব নেন ফজলে নূর তাপস। এর পর ২০২০ সালের ৩০ জুন সিটি কর্পোরেশনের প্রথম বোর্ড সভা হয়। সে মোতাবেক এই সিটি কর্পোরেশনের পাঁচবছর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী ২৯ জুন।
আইন অনুসারে ২৯ জুনের আগের ১৮০ দিনের মধ্যে যে কোনো দিন নির্বাচন হওয়ার কথা। এ জন্য নির্বাচনের ৪০ থেকে ৪৫ দিন আগে তফসিল হওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ইশরাক হোসেন মেয়র হিসেবে শপথ নিলেও ২৯ জুনের পর আর মেয়র থাকতে পারবেন না বলে আইনজীবীদের মধ্যে কেউ কেউ বলছেন। আবার কেউ বলছেন, উচ্চ আদালতের রায়ের বিশ্লেষণে কি নির্দেশনা আছে সেটি দেখলে বোঝা যাবে তিনি কতদিন মেয়রের চেয়ারে থাকতে পারবেন। যদি ইশরাক হোসেন যেদিন শপথ নেবেন সেদিন থেকে ৫ বছর থাকার নির্দেশনা আদালত দিয়ে থাকেন তাহলে সেই রায় কার্যকর হবে। তা না হলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আইন অনুসারে যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটিই চূড়ান্ত হবে। সেক্ষেত্রে কি সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে সেটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার।
এদিকে উচ্চ আদালতের রায় পাওয়ার পর ইশরাক হোসেন মেয়রের দায়িত্ব পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি ইতিমধ্যেই সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে সিটি কর্পোরেশনের কর্মপরিধি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন এবং কোন কোন কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে সে বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। এ বিষয়ে তার প্রয়াত পিতা সাদেক হোসেন খোকা মেয়র থাকা অবস্থায় যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী নগর ভবনে দায়িত্ব পালন করেছেন তারাই ইশরাক হোসেনকে বেশি সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার ইশরাক হোসেনের পক্ষে উচ্চ আদালতের রায় ঘোষণার পর এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে শপথ করাতে উচ্চ আদালতের রায়ে জনগণের বিজয় হয়েছে। উচ্চ আদালত আইনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে যেটা হওয়া উচিত সেই ধরনের রায় দিয়েছেন। এটাতে নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের আরেকটা বিজয়। আমরা জানি যে, ইশরাক হোসেন যখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন তখন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার জোর জবরদস্তি করে ফলাফল কেড়ে নিয়েছিল। তবে জনতার মেয়র হিসেবে ঢাকাবাসীসহ দেশের জনগণ ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করেছিল। তাই আমি আশা করব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আর কোনো সমস্যা তৈরি না করে দ্রুত ইশরাক হোসেনের শপথের ব্যবস্থা করবেন এবং পরিস্থিতিকে সহজ করে তোলার চেষ্টা করবেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গতবছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশেনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এসব জায়গায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে প্রশাসক। তবে আগের করা মামলার রায়ে গতবছর ১ অক্টোবর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে শাহাদাত হোসেনকে মেয়র হিসেবে রায় ঘোষণা করে আদালত। এর পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় শপথ পড়ানোর পর শাহাদাত হোসেন চট্টগ্রামের মেয়র পদে বসেন। আর এ বছর ২৭ মার্চ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করে রায় দেন আদালত। একই দিন নির্বাচন কমিশন গেজেটও জারি করে। কিন্তু আইন জটিলতার কারণ দেখিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়াতে কালক্ষেপণ করে। এক পর্যায়ে আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে ব্যাখ্যা চায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
ইশরাক হোসেকে মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায় এবং ইসির গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে মামুনুর রশিদ নামে সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী ১৩ মে হাইকোর্টে রিট করেন। পরদিন ১৪ মে থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র পদে বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়িয়ে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে নগর ভবনে তালা ঝুলিয়ে লাগাতার আন্দোলন শুরু করেন ‘আমরা ঢাকাবাসী’ ব্যানারে বিএনপির নেতাকর্মীরা। আদালতে মামলার শুনানি শুরুর পর নগর ভবনের পাশাপাশি মৎস্য ভবন ও কাকরাইল মোড়েও অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে তারা। বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের রায়ে ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে শপথ পড়াতে নির্দেশ জারির পর ৯ দিনের আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করে বিএনপি নেতাকর্মীরা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে ইশরাক হোসেনের শপথের বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কি পদক্ষেপ নিতে পারে এটি নিয়ে এখন চলছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা। কেউ বলছে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আর কোনো ঝামেলায় যাবে না। আবার কেউ বলছে আইনগত বিবেচনায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় চাইলে শপথ নাও পড়াতে পারে। তবে অভিজ্ঞ মহলের মতে এ বিষয়টি উভয় পক্ষের ইতিবাচক ভূমিকায় শীঘ্রই শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন জানান, উচ্চ আদালতের রায়ে যে নির্দেশনা দিয়েছে সেটিই চূড়ান্ত। আর এটিই আইনগত সমাধান। তাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আইন মেনে ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়াবে।
বৃহস্পতিবার এক ফেসবুক বার্তায় ইশরাক হোসেন বলেন, আদালতের রায়ের পর এখন আমি জনতার মেয়র। জনতার মেয়র হিসেবে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসন ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করব। শপথ কেবল একটা ফরমালিটি। জনতার মেয়র হিসাবে আমার দায়িত্ব বর্তায় আসন্ন কোরবানির ঈদের আগে যাতে বর্জ ব্যবস্থাপনার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকে। আমি ঢাকাবাসীকে নিশ্চিত করছি, পরিচ্ছন্নকতার্মীদের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করব। দক্ষিণের সাবেক কাউন্সিলর ও বিগত নির্বাচনের প্রার্থীদের সমন্বয় করে একটি জোনভিত্তিক মনিটরিং টিমের অনুমোদন দেব। ঈদের দিন বিকেলের মধ্যে একটা স্বস্তিদায়ক পরিবেশ তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করব। দক্ষিণ পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সঙ্গে আমি নিজেও থাকব।