
স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক, খাদ্য, প্লাস্টিক, তুলাসহ ছয় ধরনের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করেছে ভারত। এতে বিপাকে পড়েছেন রপ্তানিকারকেরা। এমন সিদ্ধান্তে প্রতিবেশী দেশটিতে এসব পণ্য রপ্তানিতে ভাটা পড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। অর্থনীতিবিদেরা একে দেখছেন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের জন্য বড় বাধা হিসেবে।
রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্থলবন্দরের দুয়ার বন্ধ হওয়ায় এখন সমুদ্রপথে এই ছয় ধরনের পণ্য রপ্তানি করতে হবে। এতে খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি পণ্য পৌঁছে দিতে সময়ও লাগবে বেশি। ফলে কিছু ক্ষেত্রে রপ্তানি বন্ধও হয়ে যেতে পারে।
ভারত স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় বন্দরগুলোতে আটকা পড়েছে রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাক। গতকাল রোববার যশোরের বেনাপোলসহ বিভিন্ন স্থলবন্দরে আটকে দেওয়া হয় পোশাকবাহী ট্রাকের চালান। এ ছাড়া দেশের অন্যতম বড় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএলের ১৭টি পণ্যবাহী ট্রাক বুড়িমারী বন্দরে আটকে দেওয়া হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে ভারতের বিধিনিষেধ কার্যকর হয়ে গেছে। গতকাল আমাদের পণ্যের ১৭টি ট্রাক বুড়িমারী সীমান্তে আটকে দিয়েছে ভারত। এগুলো বুড়িমারী সীমান্ত পার হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি যাওয়ার কথা ছিল।’
কামরুজ্জামান কামাল আরও বলেন, ‘নতুন এ সিদ্ধান্তের পর বাড়তি খরচ ও সময় ব্যয় করে সেভেন সিস্টারভুক্ত রাজ্যের আমদানিকারকেরা পণ্য আমদানি নাও করতে পারেন। কারণ সীমান্তের ওপারে পণ্য পৌঁছানোর পর খরচ আমদানিকারককে বহন করতে হয়। যদি তাই হয়, তবে আমাদের দেশ থেকে রপ্তানি আরও কমবে।’
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, স্থলপথে পণ্য আমদানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের জন্য বড় বাধা। তাই প্রথমে জানতে হবে কেন ভারত হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপর দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ভারতের এ সিদ্ধান্তের পর স্পষ্টই বোঝা যায়, প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সহযোগিতা বিপরীত পথে চলছে। ফলে যেকোনো সময় যেকোনো অনিশ্চিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এতে দুই দেশে সাপ্লাই চেইন নষ্ট হবে। দুই দেশের মধ্যে এটা চলতে থাকলে কোনো দেশের জন্যই ভালো ফল হবে না।
ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত শনিবার হঠাৎ এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করে। শুধু ভারতের নবসেবা ও কলকাতা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে দেশটির আমদানিকারকেরা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারবেন বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরাম, পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্দা ও ফুলবাড়ী শুল্ক স্টেশন দিয়ে ফল, ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য, সুতা, সুতার উপজাত, আসবাবপত্র রপ্তানিও নিষিদ্ধ করা হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে। এর আগে গত ৮ এপ্রিল বাংলাদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে ভারত। ফলে ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে পারছে না বাংলাদেশ। অন্যদিকে প্রায় এক মাস আগে ভারত থেকে বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা, বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির সুযোগ বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
দুই দেশের বাণিজ্য চিত্রে দেখা যায়, ভারত থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, তার তুলনায় রপ্তানি করে খুবই সামান্য। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। তার বিপরীতে রপ্তানি করতে পেরেছে মাত্র ১৫৭ কোটি ডলার সমমূল্যের পণ্য। এই আমদানি-রপ্তানির প্রায় পুরোটাই স্থলপথে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে ৫৪ কোটি ৮৮ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। গত অর্থবছর ভারতে ১৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারের প্লাস্টিক পণ্য, ৩ কোটি ১৩ লাখ ডলারের তুলা ও তুলার সুতার ঝুট ও ৬৫ লাখ ডলারের আসবাব রপ্তানি হয়।
ভারতের আকস্মিক সিদ্ধান্তের ফলে বিপাকে পড়েছেন রপ্তানিকারকেরা। তাঁরা বলছেন, ‘সমুদ্রবন্দর দিয়ে এখন ভারতে তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে হলে আগে ভারতের চেন্নাই ও মুম্বাই বন্দরে পণ্য পাঠাতে হবে। সেখান থেকে স্থলপথে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের গন্তব্যে যেতে হবে। এমনকি আমাদের খুব কাছের কলকাতায় একইভাবে পণ্য পাঠাতে হবে।’
ফলে আগে যেখানে পণ্য পাঠাতে ৩-৪ দিন সময় লাগত, এখন ৭-৯ দিন সময় লাগবে। এতে আমদানি-রপ্তানি খরচও বেড়ে যাবে।
এ বিষয়ে নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এর আগে ভারত ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করার পর বাংলাদেশের মোট পোশাক রপ্তানিতে ভারতের যে অংশটুকু ছিল তার অনেকটাই কমে গেছে। তারপরও যেটুকু রপ্তানি হয়, তা করতেও এখন সময় ও খরচ বাড়বে। কারণ এখন পোশাকের চালান চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতের মুম্বাই বন্দরের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যে পাঠাতে হবে। এটি দুই দেশের পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের অংশ বলেই মনে হচ্ছে।
সীমান্তের সব শুল্কস্টেশন এবং পশ্চিমবঙ্গের চ্যাড়াবান্ধা ও ফুলবাড়ী দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, ত্রিপুরা, আসাম ও মিজোরামসহ সেভেন সিস্টার্স খ্যাত রাজ্যগুলোতে বিস্কুট, কেক, চিপস, ফলের ড্রিংকসসহ বেশ কিছু খাদ্যপণ্য রপ্তানি করত বাংলাদেশের প্রাণসহ বিভিন্ন কোম্পানি।
ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞায় বিপাকে পড়বেন এসব পণ্যের রপ্তানিকারকেরা। কারণ, ওই সব রাজ্যে এসব পণ্য পাঠাতে প্রথমে কলকাতায় পাঠাতে হবে। পরে পুরো বাংলাদেশের সীমান্ত ঘুরে আসাম, মেঘালয়, করিমগঞ্জ ও আগরতলায় পাঠাতে হবে।
স্থলবন্দর ব্যবহারে ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভারতে আমাদের আসবাব খুব বেশি রপ্তানি হয় না; সে তুলনায় পোশাকের বড় রপ্তানি হয়। আমাদের দেশ থেকে যে রপ্তানি হয়, তার মূল কারণ প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। আমরা আশা করছি, উভয় দেশের ভোক্তা ও ব্যবসার স্বার্থে এটা চলমান থাকবে।’