জুলাই গণহত্যার বিচারে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে রাজনৈতিক অনৈক্য। এর সুযোগ নেবে গুম ও খুনে জড়িতরা। ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে গতকাল শনিবার ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত ‘গুম-খুন থেকে জুলাই গণহত্যা: বিচারের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সংলাপে এই মত উঠে আসে। বক্তারা মনে করেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গুম, খুন ও গণহত্যার সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ বিচার সম্পন্ন করতে রাজনৈতিক ঐক্য খুবই জরুরি।
সংলাপে গণঅভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুম-খুন ও জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিচারে ধীরগতির অভিযোগ তোলেন কয়েকজন। তারা ১৬ বছর ধরে গুমের ঘটনায় র্যাব, সিটিটিসি ও ডিবি বিলুপ্ত করার দাবি জানান। সংলাপে গুম ও খুনে জড়িত রাজনৈতিক দলের বিচার, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের নিরপরাধ আটকদের জামিন না দেওয়াসহ আরও নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে।
রাজধানীর কেআইবি মিলনায়তনে সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কমরেড সাইফুল হক, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দসহ আরও অনেকে বক্তব্য দেন। সংলাপে গুমের শিকার দু’জন ভুক্তভোগী তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
গণঅভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুম-খুন, জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিচারে ধীরগতির অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তিনটা লক্ষ্য আছে– বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন। বিচারটা মূলত আমাদের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব, এখানে কোনো রকম কোনো গাফিলতি হচ্ছে না, হবে না।’
জুলাই-আগস্টের গণহত্যাকারীদের বিচার আগামী বিজয় দিবসের আগেই শেষ হবে বলে জানান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হলো, রাজনৈতিক মতৈক্য বজায় রাখা।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমি যখন সরকারে ছিলাম না, তখন আমিও বলতাম, এটা হচ্ছে না কেন, ওটা হচ্ছে না কেন? এই প্রশ্নগুলো থাকা উচিত। থাকলে আমরা উত্তরটা পাই। আমি নিশ্চিত করে বলতে চাই, আইন উপদেষ্টা হিসেবে আমার প্রধানতম দায়িত্ব হচ্ছে এই গণহত্যার বিচার করা। কিন্তু বিচারটা করার সময় আমাকে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় করতে হবে।’
এর আগে জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ এ-সংক্রান্ত অভিযোগটি তোলেন। অনুষ্ঠানে গুমের শিকার তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের নেতা কাজী সাইফুল অভিযোগ করেন, গুম ও নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের অধিকাংশই এখনও বহাল তবিয়তে। বড়জোর বদলি করা হয়েছে। প্রশাসনের নির্যাতনকারী কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি। তিনি র্যাব, সিটিটিসি বিলুপ্তির দাবি জানিয়ে বলেন, সিটিটিসিতে ছাত্রলীগের নেতা ছাড়া কাউকে পদায়ন করা হতো না। এটি ছাত্রলীগেরই আরেকটি শাখা ছিল।
এ সময় ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আমান উল্লাহ আমান বলেন, ছাত্রদলের ছয় শতাধিক নেতাকর্মী গুম হয়েছেন। কাউন্টার টেররিজম ছিল ছাত্রলীগের একটা ইউনিট। আর কত সময় গেলে তাদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবেন? শুধু ট্রাইব্যুনালের জন্য তো বসে থাকলে হবে না।
জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, ‘সবার মনে হতে পারে বিচারটা এত দেরি হচ্ছে কেন? এর আগে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের যে বিচার হচ্ছিল, সেখানে তো তিন মাস সময় দেওয়া হয়েছিল। সেখানে আমরা এক মাস দিয়েছি।’
আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘অনেকে দেখি বলে, যাদের হাজির করা হচ্ছে, তাদের হাতে হাতকড়া নেই, হাসিখুশি মুখে হাজির হচ্ছে। তখন প্রসিকিউটর তাজুল আমাকে বলেন, জামায়াতে ইসলামীর নেতাদেরও কারও হাতকড়া পরানো হয়নি। সে-ই তো জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের আইনজীবী ছিল। অনেক জিনিস আমাদের স্মরণে থাকে না, আমরা ইম্পেশেন্ট (অধৈর্য) হয়ে যাই।’
মতিউর রহমান আকন্দের কথার জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘বিচারের কোনো কিছুই রেডি ছিল না। বিচার যে ভবনে হবে, সেই ভবন রেডি ছিল না, বিচারক ছিল না, প্রসিকিউটর টিম ছিল না, ইনভেস্টিগেশন টিম রেডি ছিল না, শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছে। আমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পরে দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রসিকিউটর টিম করা হয়েছে। এর চেয়ে দ্রুত কি করা যায়? সাত দিনের মধ্যে বলেছিলাম, জুলাই-আগস্টের মিথ্যা মামলা সাত দিনের মধ্যে উইথড্র করা হবে। সেখানে ১০ দিন লেগেছে।’
ত্রুটিহীন বিচার প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জ তুলে ধরতে গিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা জানেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনার প্রচুর টাকা আছে, লবিংয়ের সামর্থ্য আছে, শত্রুভাবাপন্ন দেশ আছে। তাই এমনভাবে বিচার করতে হবে, যেনে তীব্র প্রশ্ন উঠতে না পারে। আমাদের সঠিক প্রক্রিয়া বজায় রাখতে হবে।’
উপদেষ্টা জানান, আইন মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত ৫১টি জেলা থেকে গায়েবি মামলার আনুমানিক হিসাব পেয়েছে। আরও ১৩টি জেলা থেকে তথ্যের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শুধু একটা গণহত্যা বা একটা মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়নি। বিদায়ী সরকারের আমলে কমপক্ষে চারটা মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে। একটা হচ্ছে জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ড, একটা হচ্ছে বিডিআর হত্যাকাণ্ড, একটা হচ্ছে শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড আর ধারাবাহিকভাবে চলা গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এই সরকার যতদিন আছে, এই চারটা গণহত্যার বিচারের জন্য যত রকম প্রচেষ্টা দরকার, তা করবে।
আসিফ নজরুল আশা প্রকাশ করেন বলেন, আমরা আগামী বিজয় দিবস গণহত্যাকারীদের শাস্তির রায়ের মাধ্যমে সেলিব্রেশন করব।
সংলাপে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জুলাই গণহত্যার বিচারে প্রধান চ্যালেঞ্জ আমার মনে হয় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের যে চেতনা, সেই চেতনায় ফাটল ধরা। বর্তমানে কেউ জমি দখলে ব্যস্ত, কেউ পদ-পদবি নিয়ে কাড়াকাড়ি ও কেউ ক্ষমতায় যেতে ব্যস্ত। এতে অনৈক্য সৃষ্টি হচ্ছে। যে ঐক্য নিয়ে আমরা রাজপথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শামিল হয়েছিলাম, সেই ঐক্যতে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, সেই ফাটলটাই প্রথম চ্যালেঞ্জ।
গত ১৬ বছরে সংঘটিত অপরাধগুলোর ‘অগণিত সাক্ষী’ পাওয়া গেছে বলে মন্তব্য করে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা স্বচ্ছ কাচের মতো সাক্ষী পেয়েছি। বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে সে বিষয়টি আপনাদের সামনে আনা উচিত না বলে বলছি না।’
তিনি বলেন, ঐক্য ছাড়া সংস্কার সম্ভব নয়। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন ও যৌক্তিক পথে বাংলাদেশকে পরিচালিত করা সম্ভব নয়।
অনুষ্ঠানে জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, গুম-খুনের বিচারের জন্য রাজনৈতিক ঐক্য খুব জরুরি। বিগত ১৬ বছরকে মাথায় রাখতে হবে। শুধু জুলাই ৩৬ নিয়ে সামনে এগোলে ঐক্যে আঘাত লেগে যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে, অপরাধগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিচার করা। সেটি আগামী এক বছরের মধ্যে শেষ করতে পারব বলে আশা করি।’
সঞ্চালক মনির হায়দার চিফ প্রসিকিউটরকে প্রশ্ন করেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যে সক্ষমতা আছে, তা গণহত্যা, গুম-খুনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের এত বড় পরিধির বিচারের জন্য কি যথেষ্ট?’
জবাবে তাজুল ইসলাম বলেন, এই ট্রাইব্যুনালের ১০ জন প্রসিকিউটর ও ১৭ জন তদন্ত কর্মকর্তা আছেন। তাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে গুম, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বাংলাদেশের মাটিতে হয়েছে, সেই অপরাধের যারা মাস্টারমাইন্ড (মূলহোতা), যারা একদম সর্বোচ্চ জায়গায় বসে থেকে অপরাধগুলো সংঘটিত করেছিলেন প্রাধান্য দিয়ে, তাদের বিচার করা। সে ক্ষেত্রে এই ট্রাইব্যুনাল হাজার হাজার মানুষের বিচার করতে পারবে না এবং সেই লক্ষ্যে অগ্রসরও হচ্ছেন না তারা।
সংলাপে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর মেনিফেস্টোতে গুরুত্বসহকারে জুলাই গণহত্যা ও গুম, খুনের বিচার করার অঙ্গীকার থাকতে হবে। এক বছরের মধ্যে অন্তত বিচারিক আদালতে এর বিচার সম্পন্ন করতে হবে। রাজপথে সে পর্যন্ত সবাইকে জেগে থাকতে হবে।
এলডিপি নেতা ড. নিয়ামুল বশীর বলেন, গত ১৬ বছরে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর ৭ শতাধিক নেতাকর্মী গুম হয়েছেন। এখনও সেই তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। তিনি র্যাব, ডিজিএফআই, সিটিটিসি ও ডিবি বিলুপ্তির জোর দাবি জানান।
সংলাপে আরও অংশ নেন ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) ভাইস চেয়ারম্যান কাজী নাহিদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক গুমের শিকার দিদারুল ভূঞা, মায়ের ডাকের আহ্বায়ক সানজিদা ইসলাম তুলি, ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আমান উল্লা আমান, ইসলামী ছাত্রশিবিরের জেনারেল সেক্রেটারি জাহিদুল ইসলাম, আইনজীবী ব্যারিস্টার তাসনুভা শেলীসহ অনেকে।