Image description
গত সপ্তাহে সচিবালয়ে অবস্থান নেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সম্ভাব্য সুপারিশ ঘিরে বেশ অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে। একদিকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ও অন্যদিকে বাকি ২৫টি ক্যাডারের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়ে এরই মধ্যে সরকারের মধ্যে বেশ অস্বস্তিও দেখা যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, "যারা আন্দোলনের নামে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এবং সেটি এক সপ্তাহের মধ্যেই নেওয়া হবে।"

এরপরই প্রশ্ন উঠেছে, সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে চাকরি বিধি অনুযায়ী কি ব্যবস্থা নেওয়া যায়? সেটি সম্ভব কি না?

সরকারি চাকরি বিধিমালার বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী, সরকারের কোনও সিদ্ধান্ত বা আদেশের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ বা বিরোধিতা করলে আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পর সরকার কি ব্যবস্থা নিতে পারে, এমন প্রশ্নে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "কোনও ধারায় যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে শোকজ করার বিধান আছে। তবে সেটি করার আগে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান করা যেতে পারে।"

এরই মধ্যে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে বাকি ২৫ ক্যাডারের সমন্বয়ে গঠিত আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ আগামী তেসরা জানুয়ারি ঢাকায় একটি সমাবেশের ডাকও দিয়েছে।

এর আগে জনপ্রশাসন সংস্কারের কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা সংবাদ সম্মেলন, সারা দেশে কলম বিরতিসহ কিছু কর্মসূচিও পালন করেছে।

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "আমরা হালকা কর্মসূচি দিয়ে সারা দেশের কর্মকর্তাদের শান্ত করেছি। চেষ্টা করছি যাতে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি না হয়।"

তবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বা বিএএসএ বলছে, আপাতত তারা কোনও কর্মসূচি পালন করবে না। এখনও সরকারের দিকে তাকিয়ে তারা।

 

সরকারের হুঁশিয়ারি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন চলতি মাসের মাঝামাঝি তাদের সম্ভাব্য কিছু সুপারিশের কথা তুলে ধরে সাংবাদিকদের কাছে।

সেখানে উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের ৫০ শতাংশ এবং অন্য সব ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কোটা রাখা কিংবা উপসচিব পদে পদোন্নতিতে পরীক্ষা চালু এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারে না রেখে আলাদা কমিশন করার কথাও জানানো হয় সম্ভাব্য সুপারিশে।

গণমাধ্যমে এসব খবর আসার পর থেকেই প্রশাসন ক্যাাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকে। সংস্কার কমিশনের সাথে বৈঠকও করে তারা।

সাবেক ও বর্তমান আমলারা ঢাকায় একটি সমাবেশ করে সেখান থেকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধানের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণও দাবি করেন।

কোনও রকম আলোচনা ছাড়াই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জানিয়ে প্রতিবাদে নামে বাকি ২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত 'আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ'।

এরই মধ্যে তারা কলম বিরতি, সংবাদ সম্মেলন-সহ বেশ কিছু কর্মসূচিও পালন করেছে।

প্রশাসন ও অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের এই প্রতিবাদের পর সরকারের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়।

যারা এই ধরনের আন্দোলনের নেমেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি দেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।

শুক্রবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা মি. ইসলাম বলেন, "যারা আন্দোলনের নামে চাকরি বিধি লঙ্ঘন করছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমলাদেরকেও আমরা বলছি, এখন সময় জনগণকে সেবা দেওয়ার। আমাদের গণতান্ত্রিক ট্রানজিশন সেটাকে সঠিকভাবে করতে সহায়তা করার।"

সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ঘিরে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে তিনি এসময় বলেন, "একটা সংস্কারের মত নিয়ে আসলে তারা যে রিঅ্যাকশনটা দেখিয়েছে এটা আমরা মনে করি নৈতিকভাবেও ঠিক হয়নি। এবং তারা বিধিও লঙ্ঘন করেছে।

"বিগত রেজিমেও যে আমলারা লুকিয়ে আছে নানাভাবে এখনো, তাদেরকেও আমরা চিহ্নিত করেছি। এবং বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এসেছে, তাদের বিরুদ্ধেও খুবই দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে" যোগ করেন মি. ইসলাম।

 

কী ব্যবস্থা নিতে পারে সরকার?

সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্যের পর প্রশ্ন উঠছে এসব সরকারি সিদ্ধান্তর প্রতিবাদ জানালে তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়?

বাংলাদেশের সরকারি চাকরিজীবীদের আচরণ বিধিমালায় বেশ কিছু ধারা রয়েছে। যেখানে সরকারের সিদ্ধান্ত বা আদেশের বিরোধিতা করলে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় সেটি নিয়েও বলা রয়েছে।

বাংলাদেশের সরকারি চাকরিজীবীদের কর্মচারি (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯- ৩০ এর এ ধারা অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীরা সরকার বা কর্তৃপক্ষের কোনও আদেশ বা সিদ্ধান্ত পরিপালনে প্রকাশ্যে বিরোধিতা বা কোনও উপায়ে ব্যহত করতে পারবে না।

একই অনুচ্ছেদেরে বি উপ-ধারায় বলা আছে, সরকার বা কর্তৃপক্ষের কোনও আদেশ বা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোনও অসন্তোষ বা ক্ষোভ প্রকাশ বা আন্দোলনে অংশগ্রহণ বা অন্যদের অংশগ্রহণে সহায়তা করা যাবে না।

সি উপধারায় বলা আছে, সরকার বা কর্তৃপক্ষকে কোনও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, রূপান্তর, সংশোধন বা বাতিলের জন্য অসঙ্গত প্রভাব বা চাপ প্রয়োগ করা যাবে না।

এছাড়াও সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বা সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন অংশের অভ্যন্তরে কোনও উপায়ে অসন্তোষ, ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি বা সৃষ্টির চেষ্টা করা যাবে না।

একই চাকরি বিধিমালার ৩২ ধারায় বলা আছে, এই বিধি ভঙ্গ করলে তা আইন অনুযায়ী অসদাচরণ বলে গণ্য হবে এবং এ জন্য তারা শৃঙ্খলামূলক কার্যক্রমের আওতায় আসবেন।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, "এখন সরকারি কর্মকর্তারা যা করছেন সরকার চাইলে তাদের অসদাচরণের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করতে পারে। বিভাগীয় মামলায় করে যে কোন দণ্ডও দিতে পারেন।"

তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এখনই সে পর্যন্ত যাওয়ার যাওয়ার প্রয়োজন নাও হতে পারে বলে মনে করেন মি. মিয়া।

 

পাল্টাপাল্টি অবস্থান

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বক্তব্যের পর পদ-পদোন্নতি-সহ চাকরি সংক্রান্ত নানা দাবিতে এখন পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

যে কারণে এসব বিষয় নিয়ে সরকারি চাকরিতে আন্ত:ক্যাডার দ্বন্দ্বও বাড়ছে।

এরই মধ্যে ২৫টি ক্যাডারের সমন্বয়ে গঠিত আন্ত:কাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ কিছু কর্মসূচি পালন করছে। আগামী তেসরা জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশের ডাকও দিয়েছে তারা।

তবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সংস্কার ইস্যুতে সচিবের সাথে বৈঠকের পর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সাথেও বৈঠক করেছেন গত ২৬শে ডিসেম্বর।

সাবেক ও বর্তমান আমলারা ঢাকায় একটি সমাবেশ করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধানের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণও দাবিও করেছিলেন।

তবে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের হুঁশিয়ারির পর বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, তারা নতুন করে কোনও ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করবে না।

এই সংগঠনটি অভিযোগ করছে, বাকি ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা সমাবেশ-সহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে চায়।

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আমরা আন্দোলন বা কোনও কর্মসূচি পালন করছি না। তবে বাকি ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা সিবিএ'র মতো মোর্চা তৈরি করে আন্দোলনে নেমে বিশৃঙ্খলা করছেন।"

ক্যাডার বৈষম্য দূর করার দাবিতে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ এরই মধ্যে ঢাকায় মহাসমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করলেও এই সংগঠনটি মনে করছে সরকারের উপদেষ্টা মি. ইসলাম যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে সেটি প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যেই দিয়েছেন।

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক ড. মুহাম্মদ মফিজুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আমরা এ পর্যন্ত সরকারের সাথে কোনও দ্বন্দ্বে যাইনি, যাবোও না। আমার মনে হয় যারা হুমকি দিয়েছে কটুকথা বলেছে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে আল্টিমেটাম দিয়েছে, উপদেষ্টা তাদের উদ্দেশ্য করে হুঁশিয়ারি দিয়েছে!"

"আমাদের বিশ্বাস, আমরা চাকরিবিধি লঙ্ঘন করি নাই", বলছিলেন মি. রহমান।