
ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতির হাতেখড়ি শাহ মো. আবু জাফরের। রাজনৈতিক জীবনে ফরিদপুর থেকে আওয়ামী লীগ, বাকশাল, জাতীয় পার্টি (জাপা) ও বিএনপির সংসদ সদস্য ছিলেন। সর্বশেষ গত বছর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। আবার দল পরিবর্তন করে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নতুন দল জনতা পার্টি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন তিনি।
রাজনৈতিক জীবনে অন্তত আটবার দল পরিবর্তন করলেন শাহ মো. আবু জাফর। নতুন দলে যোগদানের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা বলছেন, ‘রাজনীতি তাঁর প্রধান উপজীব্য নয়, মূল লক্ষ্য ক্ষমতা।’ তবে শাহ জাফরের দাবি, জনগণের কল্যাণের জন্য তিনি রাজনীতি করেন। ব্যক্তিগত স্বার্থে তিনি কোনো দলে যোগদান করেননি।
গত শুক্রবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে সভাপতি ও বিএনপির বহিষ্কৃত সহসভাপতি সাংবাদিক শওকত মাহমুদকে সাধারণ সম্পাদক করে ‘জনতা পার্টি বাংলাদেশ’ আত্মপ্রকাশ করে। ওই দলের প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন শাহ জাফর। তিনি ফরিদপুর-১ (মধুখালী-বোয়ালমারী-আলফাডাংগা) ও ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা-চরভদ্রাসন-সদরপুর একাংশ) আসনের একাধিকবারের সংসদ সদস্য ছিলেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতি শুরু করেন শাহ জাফর। ১৯৭০ সালে রাজেন্দ্র কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ১০ মার্চ ফরিদপুর জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা হিসেবে তিনি ফরিদপুরে কয়েক হাজার ছাত্র-জনতার সভায় পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে চলে যান এবং দেরাদুন সামরিক একাডেমিতে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেস-বিএলএফের (মুজিব বাহিনী) সদস্য হিসেবে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ফরিদপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে বাকশাল, ১৯৮৮ সালে জাপা ও ২০০৫ সালের উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে ফরিদপুর-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে জাপা, ২০০১ সালে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), ২০০৯ ও ২০১৮ সালে বিএনপি এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে বিএনএমের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন।
ফরিদপুর-১ আসনে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী কৃষক দলের সহসভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য খন্দকার নাসির বলেন, শাহ জাফর ৮ বার নয়, ১১ বার দল পরিবর্তন করেছেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক বিষয় মানুষ ভুলে গেছে। রাজনীতির মূলব্রত দেশ ও মানুষের কল্যাণ। শাহ জাফরের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, রাজনীতি তাঁর প্রধান উপজীব্য নয়, মূল লক্ষ্য ক্ষমতা। ওনাকে যাঁরা দলে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন, তাঁদের নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
দীর্ঘ দুই দশক বিএনপির রাজনীতি করেছেন শাহ জাফর। একবার সংসদ সদস্যও ছিলেন। জানতে চাইলে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদাররেছ আলী বলেন, ‘জনতা পার্টিতে যাঁদের দেখলাম, সবাই চিহ্নিত ও বিতর্কিত। শাহ জাফরও সেই দলে শরিক হয়েছেন। তাঁদের কর্মকাণ্ডে ওয়েস্ট (আবর্জনা) ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না।’
এ বিষয় শাহ মো. আবু জাফর প্রথম আলোকে বলেন, ‘দল পরিবর্তনে আমার একটা ইতিহাস আছে। আমি ইচ্ছা করে দল পরিবর্তন করিনি। কেউ প্রমাণ করতে পারবে না আমি নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে অর্থ-বিত্ত নিয়ে দল পরিবর্তন করেছি। আমি জীবনে কোনো ট্রেড লাইসেন্স করিনি। আমার নিজস্ব কোনো ব্যবসা নেই। আমি নিঃস্বার্থভাবে জনগণের জন্য যেটি ঠিক মনে করেছি, সেটাই করেছি।’ তিনি বলেন, এলাকার উন্নয়নে তিনি এরশাদকে এলাকায় নিয়ে গেছেন। খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকেও নিয়ে গেছেন। এ জন্য তাঁর এলাকায় যত উন্নয়ন হয়েছে, কোনো মন্ত্রীর এলাকায়ও তত উন্নয়ন হয়নি।
দল পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিয়ে শাহ জাফর বলেন, ‘আমি প্রথমে আওয়ামী লীগ করতাম। আওয়ামী লীগের মধ্যে যখন ডিভিশন হয়, দল ভাইঙ্গা কোথাও যাই নাই। বঙ্গবন্ধুর পরে আব্দুর রাজ্জাককে আমার নেতা মনে করতাম। তিনি যেখানে গেছেন, আমিও তাঁর সঙ্গে ছিলাম। এরপর আব্দুর রাজ্জাক যখন ইলেকশন করলেন না; তখন সরদার আমজাদ সভাপতি আর আমি বাকশালের মহাসচিব হয়ে ইলেকশন করলাম। ইলেকশন করার পর সরদার আমজাদ জাতীয় পার্টিতে গেলেন। আমি তখন পার্লামেন্ট মেম্বার। আমাকে এক্সপেল্ড করার উদ্যোগ নেওয়া হলো। বাধ্য হয়ে আমি এরশাদের সাহেবের কাছে গিয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিলাম। দীর্ঘদিন ছিলাম। জাতীয় পার্টি ডিভিশন হলে আমি নাজিউরের গ্রুপে পড়ে যাই। পরে বেগম জিয়ার আহ্বানে বিএনপিতে গেলাম। বেগম জিয়া আমাদের এলাকায় গেলেন লক্ষাধিক লোকের সমাগম হলো। পরে আমি দীর্ঘদিন বিএনপি করলাম। বিএনপি যখন নির্বাচন করল না, আমি মনে করলাম নির্বাচন করা উচিত। তখন ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আমি নির্বাচন করলাম। এই হলো বিএনপি ত্যাগের ইতিহাস।’
শাহ জাফর বলেন, ‘আমি বিএনপি থেকে বের হয়ে গেছি, কিন্তু বিএনপির কোনো লোককে নিয়ে যাইনি। যারা আমার সাথে সহমত পোষণ করেছে, তারা আমার সাথে বিএনএম করেছে। এটাই আমার রাজনৈতিক দল পরিবর্তনের ইতিহাস। বিএনএম যখন নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল, সেই প্রেক্ষাপটে আমার জনতা পার্টির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া।’