Image description

বিএনপি চায় পরপর দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। পরে এক মেয়াদ বাদ দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। আর এক ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ দুবার ১০ বছরের বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী চায় না বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। শুধু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে নয়, নির্বাচন থেকে শুরু করে সংস্কারের অনেক বিষয়েই দেশের বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দল বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। দুই দলের মধ্যে এখন স্পষ্ট দ্বিমত দেখা যাচ্ছে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন চেয়েছে জামায়াত; যা বিএনপি চায় না। বিএনপি বলছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। আর জামায়াত চায় আগে স্থানীয় নির্বাচন। এ অবস্থায় ঐকমত্য কমিশনের ঐক্য প্রতিষ্ঠায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে বিএনপি-জামায়াতের অনৈক্য। দুই দলের মধ্যে অনৈক্য হলে জুলাই সনদ তৈরিতে অন্তরায় হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে নির্বাচনে। এমনকি নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সংস্কার বিষয়ে কমিশন ৩৫টি দলের কাছ থেকে মতামত পেয়েছে। গতকাল পর্যন্ত ১৮টি রাজনৈতিক দল কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছে।

বিএনপির যত চাওয়া : ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে ১৯৭১ সাল এবং ২০২৪ সালকে এক কাতারে আনার বিষয়ে বিএনপি ভিন্নমত পোষণ করেছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবেও সায় দেয়নি দলটি। বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে প্রায় সব প্রস্তাবে বিএনপি একমত। বিএনপি বলছে, অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধনী দিয়ে নির্বাচন কমিশনের হাতে ডিলিমিটেশনের এখতিয়ার রাখা হোক। রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ১৬৬টি প্রশ্নমালার যে স্প্রেডশিট পাঠিয়েছে তার মধ্যে অনেক সুপারিশে দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপি। দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের স্প্রেডশিটে ২০টির মধ্যে ১১টিতে সরাসরি একমত, ৭ থেকে ৮টিতে মন্তব্যসহ নীতিগতভাবে একমত এবং একটি প্রস্তাবে ভিন্নমত পোষণ করেছে দলটি। প্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২৬টি বিষয়ে প্রস্তাবনা আছে। সেখানে প্রায় অর্ধেক বিষয়ে একমত এবং বাকিগুলোতে নিজস্ব মতামত ও মন্তব্য দিয়েছে দলটি। এ ছাড়া সুপারিশে ১৯৭১ ও ২০২৪ সালকে এক কাতারে আনা হয়েছে। এটি সমুচিত বলে মনে করে না বিএনপি। এ ছাড়া রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন করার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করে না দলটি। ওদিকে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ক রিপোর্টে ২৭টার মতো প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে বেশির ভাগ প্রস্তাব সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। নির্বাচন কমিশন কিংবা নির্বাচন ব্যবস্থা সংক্রান্ত রিপোর্টে কিছু কিছু বিষয়ে সংবিধানের সংশ্লিষ্টতা আছে। দেখা যায়, নির্বাচনি সংস্কার নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। সেই বিষয়ে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক রিপোর্টে মতামত দিয়েছে বিএনপি। সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে মতামত চেয়ে গত ৬ মার্চ বিএনপিসহ ৩৭টি রাজনৈতিক দলকে চিঠি ও স্প্রেডশিট পাঠিয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। 

জামায়াত যা চায় : সংবিধানের মূলনীতিতে আল্লাহর প্রতি অবিচল ঈমান-আস্থা ফিরিয়ে আনতে মত দিয়েছে জামায়াত। দলটি সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন প্রক্রিয়া ও দুর্নীতি দমন কমিশনের বিষয়ে কিছু বিষয়ে দ্বিমত করেছে। দলটি বলছে, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা রিটার্নিং ও প্রিজাইডিং অফিসার যারা রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না, তাদের এড়াতে বলা হয়েছে। দলটি পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। সংবিধানে সাম্য, গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে জামায়াত। ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিলের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত নয় দলটি। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের সঙ্গে একমত হলেও পুরাপুরি একমত নয় জামায়াত। তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত মতামত দিয়েছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে জামায়াত আস্থা ভোট, বাজেট সম্পর্কে ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে সে ব্যাপারে মতামত দিয়েছে। জামায়াত জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন চায় না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর গত ৮ আগস্ট রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। বিএনপি শুরুতে সরকারকে তিন মাস সময় দেওয়ার কথা বললেও পরে দলটির নেতারা জাতীয় নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা জানান। পরবর্তীতে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। অন্যদিকে জামায়াত তাড়াহুড়ো না করে টেকসই সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে চায়। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। দীর্ঘদিন একসঙ্গে আন্দোলন করা দল দুটি এখন যেন মুখোমুখি অবস্থানে।

অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই বিএনপি ন্যূনতম সংস্কার করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবি করে আসছে। আর জামায়াত দাবি করে আসছিল সার্বিকভাবে সংস্কারের পরই নির্বাচন। দলটি অবশ্য সেই অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে এখন নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বলছে। তবে জামায়াত নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন কথা বলে কৌশলী অবস্থানে রয়েছে। দিন যতই সামনের দিকে গড়াচ্ছে ততই রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি জামায়াতের অবস্থান বাড়ছে। জামায়াত বলেছে, প্রয়োজনীয় সংস্কারের যতটা সময় প্রয়োজন হবে, সেই সময় সরকারকে তারা দেবে। আর বিএনপির অবস্থান হচ্ছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে।

তবে নির্বাচন নিয়ে জামায়াতের সুর বদলালেও বিএনপি তাদের আগের অবস্থানেই অনড় আছে।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমরা বলছি সংস্কারের জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা নয়। এরই মধ্যে সব দল তাদের সুনির্দিষ্ট মতামত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জমা দিয়েছে। এখন যেসব জায়গায় ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো জাতির সামনে প্রকাশ করে একটি নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করলেই হলো। নির্বাচন হচ্ছে মানুষের ভোটাধিকারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা। সংস্কার হচ্ছে চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচনের পর আরও বহু সংস্কার হবে এবং সেটি চলতে থাকবে। আমরা ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চাই এবং এ দাবিতে প্রায় সব দল একমত।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ভিন্ন ভিন্ন দলের ভিন্ন মত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ঐকমত্য কমিশন দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে। কাজ চলমান। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই প্রতিষ্ঠানকে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। তিনি বলেন, দেশের স্বার্থ কামনা করে দলগুলো দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার মানসিকতা থাকলে সবাই আন্তরিক হলে ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব। আমাদের সেই আন্তরিকতা রয়েছে।