
জুলাই বিপ্লবের পর রাজনীতির মাঠে বিএনপি জোরালো অবস্থান নিয়ে সভা-সমাবেশসহ দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। এর আগে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন করতে গিয়ে চরম বাধার সম্মুখীন হয় দলটি। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা ও তার সরকারের চরম রোষানলের শিকার হয় দলটি।
দলের হাইকমান্ড থেকে তৃণমূলের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের স্টিম রোলার। হামলা-মামলা, খুন-গুম, কেন্দ্রীয় কার্যালয় অবরুদ্ধ ও তালাবদ্ধ রাখাসহ এমন নির্যাতন নেই, যা করা হয়নি। হাইকমান্ড থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ৪৩ হাজার মামলায় প্রায় ৬০ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়।
হাসিনার নিষ্ঠুরতায় সে সময় ক্রসফায়ার ও পিটিয়ে হত্যা করা হয় ৪ হাজার ৭৭১ নেতাকর্মীকে। গুম করা হয় ১ হাজার ২০৪ জনকে। গত বছরের জুলাই বিপ্লবেই নিহত হয়েছেন ৪২২ নেতাকর্মী। খালেদা জিয়ার নামে মামলা ছিল ৩৬টি এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৩৫টি।
খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ ও তারেক রহমানকে দেশছাড়া
ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাসের মইনুল সড়কের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছেন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ টোকেনমূল্যে ঢাকা সেনানিবাসের মইনুল সড়কের ২ একর ৭২ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত বাড়িটি খালেদা জিয়ার নামে বরাদ্দ দেন। অবশ্য জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে আগে থেকেই ওই বাড়িটি তার নামে বরাদ্দ ছিল।
এই বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর সে সময় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছিলেন, তার বেড রুমের দরজা ভেঙে টেনে-হিঁচড়ে তাকে বের করে দেওয়া হয়। তার সত্যতা মেলে শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যে। ক্ষমতায় থাকাকালে ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘বহু আগে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার। যেদিন সময় পাব বের করে দেব। বের করে দিয়েছি।’
সেদিন মিথ্যা নাটক সাজিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে তার ৩৮ বছর বসবাস করা বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়।
খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পর তার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যেন বাংলাদেশে আর ফিরতে না পারেন সে জন্য একেক পর এক ‘মিথ্যা মামলায়’ হয়রানি করা হয়। এক-এগারো সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য সপরিবারে যুক্তরাজ্য যান তারেক রহমান। এরপর আর দেশে ফিরতে পারেননি। এ সময়ের মধ্যে তার বিরুদ্ধে একে একে ১৩৫টি মামলা দেওয়া হয়। নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করতে গণমাধ্যমে তার বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
গুমের শিকার ৪২৩, এখনো নিখোঁজ ২৮ জন
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুমের শিকার হন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ (দীর্ঘদিন ভারতে কারাভোগের পর সম্প্রতি দেশে ফিরে এসেছেন), সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী, নির্বাহী কমিটির সদস্য চৌধুরী আলম, সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হীরু, বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির পারভেজ, তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদল সভাপতি আমিনুল ইসলাম জাকির, তেজগাঁও থানা বিএনপির নেতা সাজেদুল হক সুমন, সাজেদুলের খালাতো ভাই জাহিদুল করিমসহ ৪২৩ জন। বর্তমানে তাদের মধ্যে ২৮ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
শেখ হাসিনার অবৈধ ক্ষমতা নিয়ে কেউ যাতে প্রশ্ন করতে না পারেন সেজন্য বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, জেল-জুলুম, ক্রসফায়ার ও আয়নাঘরে বন্দি করে নির্যাতনের পথ বেছে নেওয়া হয় বলে মনে করছেন ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনরা। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ার’-এর মতো বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন অনেকে।
ক্রসফায়ারে হত্যা ২২৭৬
বিএনপির নেতাকর্মীদের গুম, খুন ও মামলা সংক্রান্ত নথি নিয়ে কাজ করছে বিশেষায়িত একটি সেল। এ সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিন খান জানান, ২০০৭ সাল থেকে ’২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের মাধ্যমে বিএনপির ২২৭৬ জন নেতাকর্মীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। তার মধ্যে শুধু কক্সবাজার জেলায় নিহত হয়েছে ২০০ নেতাকর্মী ও সমর্থক। এছাড়া ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শেখ হাসিনা দেশের ৬৪ জেলায় যাকে হুমকি মনে করেছেন তাকেই হয় ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যা, না হয় পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
বিএনপি নেতাকর্মীদের ক্রসফায়ারের বিষয়ে দলটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, দেশের জনগণের অধিকার হরণ করে কর্তৃত্ববাদী শাসন সুবিন্যস্ত করার জন্য শেখ হাসিনা গুম ও খুনের পথ বেছে নেন। তারই অংশ হিসেবে তিনি ক্রসফায়ারের নাটক শুরু করেন।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যে দলটির ৪২২ নেতাকর্মী ও সমর্থক রয়েছেন। এছাড়া গুরুতর আহত হন কয়েক হাজার।
মামলায় পর্যুদস্ত বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বসহ কর্মীরা
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের তথ্যমতে, ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেন ও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত এক লাখ ৪২ হাজার ৯৮৩টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ৫৯ লাখ ২৯ হাজার ৪৯২ জনকে। এসব মামলায় নেতাকর্মীরা জামিন ও হাজিরা নিয়ে আদালতপাড়ায় নিয়মিত দৌড়াচ্ছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন মামলায় সাজা হয়েছে দেড় হাজারের মতো নেতাকর্মীর, যার ৯৯ ভাগই মিথ্যা ও রাজনৈতিক হয়রানিমূলক।
এর মধ্যে দলটির প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা দেওয়া হয়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয় ১৩৫টি। আর মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয় ৬৪টি।
বিএনপি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিএনপি চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিব ছাড়াও অন্য নেতাদের মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে সাতটি, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের চারটি, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে তিনটি, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার ১৯টি, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৪৮টি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ৩২টি, ড. আবদুল মঈন খানের একটি, নজরুল ইসলাম খানের ছয়টি, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ছয়টি, সালাহউদ্দিন আহমেদের ৩৫টি, বেগম সেলিমা রহমানের চারটি ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা দেওয়া হয়।
চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে আমানউল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ১৩৪টি, মিজানুর রহমান মিনুর ১৮টি, জয়নুল আবদিন ফারুকের ১২টি, প্রফেসর জয়নাল আবেদীনের (ভিপি) সাতটি, মনিরুল হক চৌধুরীর তিনটি, হেলালুজ্জামান তালুকদার লালুর ১৪টি, হাবিবুর রহমান হাবিবের বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা রয়েছে। এছাড়া সদ্য মৃত্যুবরণ করা ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে তিনটি, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম পাঁচটি, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরীর ১১টি, বরকত উল্লাহ বুলুর ১৩৫টি, মো. শাহজাহানের ১৭টি, আবদুস সালাম পিন্টুর ১৯টি, মোসাদ্দেক আলী ফালুর ৯টি, আবদুল আউয়াল মিন্টুর চারটি, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনের ১৭টি, শামসুজ্জামান দুদুর ১১টি, অ্যাডভোকেট আহমদ আযম খানের ছয়টি, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীনের ১৮টি, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৯টি মামলা দেওয়া হয়েছে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম ৪৯টি, এম কে আনোয়ার ১৯টি, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ ৪১টি ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ২৮টি, ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন চারটি ও সাদেক হোসেন খোকা ২৭টি মামলা নিয়েই মৃত্যুবরণ করেছেন।
দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ১৮০টি, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শিমুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ১১৯টি, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার এম মাহবুব উদ্দিন খোকনের ১৫টি, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির বিরুদ্ধে ১০০, অ্যাডভোকেট মজিবুর রহমান সরোয়ার ১৪টি, অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ২৫৪টি, খায়রুল কবির খোকনের ২১টি, হাবিব উন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৪৫১টি, হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে ১৪টি, ফজলুল হক মিলনের বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা।
যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদের বিরুদ্ধে ৪১টি, মাহবুবের রহমান শামীমের বিরুদ্ধে ৯টি, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ৪৭টি, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুর ১৯টি, আসাদুল হাবিব দুলুর ১৪টি, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সের তিনটি, অ্যাডভোকেট বিলকিস জাহান শিরিনের ১৭টি ও শামা ওবায়েদের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা।
ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপনের বিরুদ্ধে দুটি, প্রচার সম্পাদকের বিরুদ্ধে সাতটি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদারের ১১টি, আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামালের চারটি, তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলালের ১৭টি, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমিনুল হকের বিরুদ্ধে ১৫টি, সাংস্কৃতিক সম্পাদক আশরাফ উদ্দিন উজ্জ্বলের তিনটি, প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক এ বি এম মোশাররফ হোসেনের ৯টি, কৃষিবিষয়ক সম্পাদক শামসুজ্জোহা খানের সাতটি, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরফত আলী সপুর ৮৭টি, গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভূইয়ার পাঁচটি, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এবং বিএনপির বন ও পরিবেশ সম্পাদক মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের ১৬টি, পল্লী উন্নয়ন সম্পাদক গৌতম চক্রবর্তীর সাতটি, গ্রামসরকার সম্পাদক আনিসুজ্জামান খান বাবুর পাঁচটি, কারাবন্দি প্রকাশনা সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিবের ৩৮টি, শিশু সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকীর ছয়টি, ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক আমজাদ হোসেনের চারটি, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মুহাম্মদ মুনির হোসাইনের বিরুদ্ধে ২৫টি, সহসাংগঠনিক সম্পাদক শাহিন শওকতের পাঁচটি, সহসাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিমের বিরুদ্ধে ২১টি, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল হক নান্নুর ৪০টি, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরবের বিরুদ্ধে ১২৬টি মামলা দেওয়া হয়।
অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতার মধ্যে সহসম্পাদক সাইফুল ইসলাম শিশিরের বিরুদ্ধে ৯টি, অ্যাডভোকেট সৈয়দা আসিফা আশরাফী পাপিয়ার ১১টি, আবু সাঈদ চাঁদের ১৪টি, বজলুল করিম চৌধুরী আবেদের ২২টি, মেজর হানিফের পাঁচটি, আকবর আলীর ১০টি, এ কে এম সেলিম রেজা হাবিবের ছয়টি, মাহমুদুল হক রুবেলের ৯টি, অ্যাডভোকেট খোরশেদ আলমের সাতটি, অ্যাডভোকেট খন্দকার আব্দুল হামিদ ডাবলুর তিনটি, হাসান উদ্দিন সরকারের ৯টি, আমিনুল ইসলামের ২৫টি, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান মিন্টুর ১৪টি, তারিকুল আলম তেনজিংয়ের পাঁচটি, আবদুস সাত্তার পাটোয়ারীর ১৩টি, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ফজলুর রহমান খোকনের ২১টি, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামলের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা দায়ের করা হয়।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দফায় দফায় হামলা-ভাঙচুর
বিএনপি দপ্তরের দাবি, নেতাকর্মীদের যেভাবে হত্যা নির্যাতন করা হয়েছে, তেমনি বিএনপির রাজনীতি নিশ্চিহ্ন করার জন্য দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শতাধিকবার হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে। ভেতরে বোমা রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে অভিযান চালানো, অভিযানের নামে অফিস থেকে দলটির গুরুত্বপূর্ণ নথি ও দলের সদস্যদের দেওয়া চাঁদার টাকা লোপাট করা হয়েছে।
সবশেষ ২০২২ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের মধ্যে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপের অভিযোগে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তখনকার ডিবি প্রধান (বর্তমানে পলাতক) হারুনুর রশীদের পরিকল্পনায় নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বোমা রাখা হয়। বোমা উদ্ধারের নামে অভিযান পরিচালনা করে টানা ৭৪ দিন কার্যালয় বন্ধ করে দেয় পুলিশ।
সে সময় জানানো হয়, সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট বিএনপি কার্যালয়ের সামনে স্টিকার দিয়ে ঘেরাও করে তদন্ত চালায়। তখন পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, ‘ক্রাইম সিন’ লিখে বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখার অর্থ, তা পেরিয়ে বিএনপি কার্যালয়ে কেউ প্রবেশ করতে বা বের হতে পারবেন না।
বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১/১১-র সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত সাব-জেলে ৩৭২ দিন কাটানোর পর ১১ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এই পুরোটা সময় গ্রেপ্তার আতঙ্কে বন্ধ ছিল বিএনপি কার্যালয়। এরপর আর কখনো এত দীর্ঘসময় বন্ধ ছিল না কার্যালয়টি। এরপর ২০০৯ সালের পর কয়েকবার বিএনপি অফিসে পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। এসব তল্লাশির পর ১-২ দিন করে কখনো কখনো বিএনপি কার্যালয় বন্ধ ছিল।
সবশেষ ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর পুলিশ বিএনপি কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে ভাঙচুর করে এবং দলের প্রায় পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে। সে সময় চার দিন কার্যালয়টি বন্ধ করে রেখেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গণহারে মামলা ও নির্যাতনের বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি আমার দেশকে বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা তার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গুম, খুন ও মামলার রাস্তা বেছে নেন।
বিশেষ করে যেসব নেতাকে ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে হুমকি হিসেবে মনে করতেন, তাকে মামলা দিয়ে বা গুম করে ফেলতেন, নতুবা ক্রসফায়ারে দিয়ে হত্যা করতেন। এ ধরনের অমানবিক নির্যাতন আর গুম-খুনের ভয়কে উপেক্ষা করে সাড়ে ১৫ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যান হাসিনা।
শহীদ উদ্দিন চৌধুরী আরো বলেন, হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার দোসরা এখনো দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের লুট করা টাকা দিয়ে এখনো দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছেন। বিএনপি নেতাকর্মীদের গুম-খুনের দায়ে গুরুত্ব বিবেচনায় হাসিনার বিচার করা ও দোসরদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা।
জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন একটি ঐতিহাসিক দলিল উল্লেখ করে একে সংরক্ষণ করে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান বিএনপির এই যুগ্ম মহাসচিব। পাশাপাশি গুম-খুন হওয়া নেতাকর্মীদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা ও দলের হাইকমান্ড থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সবার মামলা প্রত্যাহারে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।