
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। একই দাবি যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোরও। এরপর নির্দিষ্ট করে চলতি বছরের জুনে না হলে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জোর দাবি জানায় বিএনপি। এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন না দিলে মাঠে নামার ইঙ্গিত দিয়ে দলটির নেতারা বেশ গরম গরম বক্তব্যও দিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, এ বিষয়ে বিএনপি ধীরে চলো নীতিতে চলছে। ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং এ দাবিতে আন্দোলনের বিষয়ে কৌশলে এগোচ্ছে বিএনপি। হঠাৎ করে ধীরে চলা নিয়ে রাজনীতিতে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। কেউ বলছেন—নির্বাচন ইস্যুতে হয়তো বিএনপি-জামায়াত-সরকার ত্রিমুখী সমঝোতা হয়েছে। কিংবা, রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে ধৈর্য ধরে ধীরে চলছে বিএনপি। এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ না খুললেও বিএনপি নেতারা বলছেন—দেশের তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা ও রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনকে প্রাধান্য দিচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি এর মাধ্যমে মূলত তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক হতে চান, যারা দ্রুত নির্বাচন হলে ‘ধান্ধা খোঁজেন’। যেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণঅভ্যুত্থানের ফসল, সেহেতু তিনি তাড়াহুড়ো কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলতে চান না। আবার নির্বাচনের দাবিতে চুপ থাকবেন, সেটিও নয়। প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন না হলে এই দাবিতে আবারও স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যাবে বিএনপি।
জানা গেছে, এ মুহূর্তে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা রূপরেখা নিয়ে জেলা পর্যায়ে সেমিনার করছে বিএনপি। গতকালও রংপুর বিভাগের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলায় ৩১ দফা নিয়ে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। একই সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন দলের লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা। বৈঠকে ঢাকায় সম্মিলিতভাবে একটি সমাবেশের প্রস্তাব এসেছে, যা শিগগির সবার মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত করা হবে। পরে প্রতিটি জেলায় অনুরূপ সমাবেশের আয়োজন করা হবে। তবে আগামী ১ মে আন্তর্জাতিক মে দিবস উপলক্ষে ঢাকায় সমাবেশের মাধ্যমে ব্যাপক শোডাউনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। তা ছাড়া নির্বাচন প্রশ্নে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে লিফলেট বিতরণ করা হবে। বিএনপি ও শরিক দলের নেতারা আলাপকালে কালবেলাকে এসব তথ্য জানান। বিশ্লেষকরা বলছেন—নির্বাচন কখন হবে, সেটি নিশ্চিত না হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যে সময়সীমার কথা বলেছেন তাতে হয়তো বিএনপি খুশি। সেজন্যই তারা কৌশল অবলম্বন করছে।
জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পলায়ন ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ওঠে। একই সঙ্গে বিএনপিও যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের দাবি তোলে। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে সর্বশেষ গত ১৬ এপ্রিল বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন। যদিও বৈঠকের ফল নিয়ে বিএনপি অসন্তোষ প্রকাশ করে। সেদিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন যে, সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তারা পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন। এর পরই করণীয় নির্ধারণে গত ১৯ এপ্রিল থেকে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক জোট ও দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি। এ পর্যন্ত ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, সিপিবি, বাসদ, লেবার পার্টি এবং গণঅধিকার পরিষদ, গণফোরাম, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) এবং গতকাল বৃহস্পতিবার বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য এবং বাংলাদেশ জনঅধিকার পার্টির সঙ্গে বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে। রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত এসব বৈঠকে প্রায় সব দলই ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন। আগামী সপ্তাহে আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য বরকতউল্লাহ বুলু গতকাল বৃহস্পতিবার কালবেলাকে বলেন, নির্বাচনের দাবিতে আমাদের এ মুহূর্তে কোনো কর্মসূচি নেই। তবে ২ বছর আট মাস আগে আমরা ৪২টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের যে ৩১ দফা রূপরেখার ঘোষণা দিয়েছি, সেটি নিয়ে আমরা মানুষের কাছে যাচ্ছি। আগামী দিনে রাষ্ট্র সংস্কার বা মেরামত কিংবা সরকারের রূপরেখা এগুলো আমরা তুলে ধরছি। তিনি বলেন, আমরা এই বিষয়ে জনসভা করবো এবং ইউনিয়ন পর্যায়েও যাবো।
বরকতউল্লাহ বুলু বলেন, শরিক দলগুলো আমাদের সঙ্গে বলছে যে, সংস্কার বিষয়ে যেখানে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো সংস্কার করে অবিলম্বে নির্বাচনটা হয়ে যাক। সাহাবুদ্দিনের (সাবেক বিচারপতি) মতো ব্যক্তি তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে দিয়েছিলেন। তিনিও তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ছিলেন। সে সময়ও সেনাবাহিনী জনগণের পক্ষে ছিল, এখনো সেনাবাহিনী জনগণের পক্ষে আছে।
তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব হলো যেখানে যেখানে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো সংস্কার করে নির্বাচনটা দিয়ে দেওয়া। কেননা, সংবিধান সংস্কার তো অনির্বাচিত কোনো ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। এটাই হলো এখন মূল দাবি। আমাদের সঙ্গে প্রায় ৬২টি রাজনৈতিক দল আছে। সব দল একই অবস্থানে রয়েছে। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১ মে আমাদের ঐতিহাসিক শ্রমিক সমাবেশ হবে। পাশাপাশি সব দল একটি সম্মিলিত সমাবেশের প্রস্তাব দিয়েছে।
গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক গতকাল কালবেলাকে জানান, তারা এ মুহূর্তে বড় কোনো কর্মসূচি বা ঘেরাও-বিক্ষোভের চিন্তা করছেন না। বরং অনেকগুলো সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা করছেন। জনগণের জরুরি দাবিতে স্বাভাবিক রাজনীতির কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকায় কিংবা সারা দেশে সমাবেশ হবে। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচন, সংস্কার ও গণহত্যাকারীদের বিচার তথা গোটা প্রক্রিয়াটাকে ত্বরান্বিত করার আলোচনাটা আসবে। সমাবেশগুলোয় সংস্কার এবং নির্বাচন কিংবা গণহত্যাকারীদের বিচারকে জোরদার করার কথা তুলে ধরা হবে। অর্থাৎ সংস্কার ও বিচার দ্রুত শেষ করে নির্বাচন দিতে সরকারকে তারা চাপ দিতে চান। তিনি বলেন, সংস্কারের গতি বাড়ানো, প্রয়োজনে আরও একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠন ও জনবল বৃদ্ধির মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়াকে দৃশ্যমান করার দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে আমরা মনে করি আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা সম্ভব। কেননা, নির্বাচন কমিশন তো নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। বাকিটা সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। সদিচ্ছা থাকলে ডিসেম্বর বা তার আগেও নির্বাচন করা সম্ভব।
১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা গতকাল কালবেলাকে বলেন, তারা ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চান। প্রয়োজনে কোনো কর্মসূচির সিদ্ধান্ত হলে তারা অতীতের মতোই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকবেন। তারা এরই মধ্যে সংস্কার শেষে বিএনপির সঙ্গে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান গতকাল কালবেলাকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ওপর সবার আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে যে, তিনি এমন কিছু করবেন না, যেটা তার সঙ্গে যায় না। তিনি অবশ্যই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে দৃঢ় পদক্ষেপ নেবেন। এক্ষেত্রে তিনি গণহত্যার বিচারে যেমন গুরুত্ব, তেমনই ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংস্কার করবেন এবং রাষ্ট্র সংস্কারে একটি সনদ করবেন যেখানে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষর থাকবে। পরবর্তী সময়ে যেই ক্ষমতায় আসুক না কেনো তিনি যেন সেটি বাস্তবায়নে বাধ্য থাকেন। তিনি আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত ডিসেম্বরের মধ্যেই সব রাজনৈতিক দল নির্বাচন প্রত্যাশা করছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য এবং বাংলাদেশ জন অধিকার পার্টির সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সংস্কারের জন্য অপেক্ষা নয়’, নির্বাচন কমিশন বলেছে। নির্বাচন হচ্ছে মানুষের ভোটাধিকারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে গণতান্ত্রিক অর্ডার ফিরিয়ে আনা। সংস্কার হচ্ছে চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচনের পর আরও বহু সংস্কার হবে এবং সেটি চলতে থাকবে।
সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশ্লেষক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান গতকাল কালবেলাকে বলেন, নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির সুর নরম, বিষয়টি ঠিক তেমন নয়। বরং বিএনপি সরকারকে সময় দিচ্ছে এবং সঠিক পথেই আছে। একই সঙ্গে নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। কেননা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও নাগরিক অধিকার রক্ষায় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি ১৭ বছর ধরে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। তিনি বলেন, বিএনপি তো কখনো নির্বাচনের দিন-তারিখ স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। সুতরাং যখন মনে করবে যে সরকারকে আর সময় দেওয়া উচিত হবে না, তখন বিএনপি তার স্বাভাবিক এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নির্ধারণ করবে।