
সীমান্তে ভারতের নতুন উসকানিমূলক আচরণ পুশ ইন (ঠেলে পাঠানো)। দেশটিতে অবস্থান করা বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জোর করে শূন্যরেখা পার করে দিচ্ছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
তাদের সঙ্গে নিজ নাগরিকদেরও ঠেলে পাঠাচ্ছে তারা। গত মে মাসে শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী এ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে প্রতিবেশী দেশটি। আর যাদের পাঠানো হচ্ছে, তাদের অধিকাংশ ব্যক্তিকেই অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে শূন্যরেখা অতিক্রমে বাধ্য করা হয়েছে। এই উসকানিমূলক আচরণের মাধ্যমে মূলত জাতিগত দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা চলছে বলে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ এ পর্যন্ত প্রায় ৬০০ জনকে জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে বিএসএফ। এর মধ্য দিয়ে ভারত ‘এক্সপালশনস অব অ্যালায়েন্স ইন ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ল, ওএইচসিএইচআর ডিসকাশন পেপার, জেনেভা কনভেনশন-২০০৬’সহ আন্তর্জাতিক সব আইন ও রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে মোদি সরকার।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুশ ইন নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করেছি। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনারও আমাদের অফিসে এসেছিলেন। আমরা তাকে বলেছি, কোনো বাংলাদেশিও যদি ভারতে অবৈধভাবে থাকে তাদেরও বৈধ উপায়ে পাঠাতে হবে। কিন্তু এভাবে জঙ্গলে, নদীতে বা ঝোপঝাড়ে ফেলে যাওয়া কোনো সভ্য দেশের আচরণ হতে পারে না।’
সম্প্রতি বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেছেন, বাংলাদেশি নাগরিকের নামে সুপরিকল্পিতভাবে ভারত রোহিঙ্গাসহ শত শত বিদেশিকে বাংলাদেশে পুশ ইন করছে, যা ন্যক্কারজনক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক লে. কর্নেল (অব.) দিদারুল আলম আমার দেশকে বলেন, পুশ ইন ভারতের আগ্রাসী নীতির বহিঃপ্রকাশ। এটি বন্ধে সীমান্তে ব্যবস্থা নিতে হবে, প্রতিহত করতে হবে। জোর করে পাঠানো ব্যক্তিদের গ্রহণ না করে ভারতে ফেরত পাঠাতে হবে। বিজিবিকে বিএসএফের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হবে।
মওলানা ভাসানি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ওমর ফারুক আমার দেশকে বলেন, পুশ ইন একটি উসকানিমূলক আচরণ, এটি ভারতের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ মনে হচ্ছে। তারা চায় আমাদের দেশ থেকে হিন্দুদের ভারতে পাঠানোর বিষয়ে আওয়াজ উঠুক। ক্রমান্বয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হোক। তাহলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার মিথ্যা অভিযোগ তুলতে পারবে প্রতিবেশী দেশটি। তাদের দেশে ও বহির্বিশ্বে প্রচারণা চালাতে পারবে। চূড়ান্তভাবে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধানোর দিকে নিয়ে যেতে পারবে।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ভারতীয় নাগরিকদের পুশ ইনের বিষয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং গণমাধ্যমকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করা দরকার; যাতে ভারতের অন্যায্য আচরণ দুনিয়ার কাছে প্রকাশ করে দেওয়া যায়।
আইন কী বলে
আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি অনুসারে এভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে মানুষকে ঠেলে দেওয়া অবৈধ। ইন্টারন্যাশনাল কোভেনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর) বা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ১৩ নম্বর আর্টিকেল অনুযায়ী, কোনো দেশে বৈধভাবে থাকা ব্যক্তিকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়া সেই দেশ থেকে বের করে দেওয়া যায় না। এ আর্টিকেল শুধু বৈধ নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য হলেও জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটির মতে, এই বিধান বৈধ নাগরিকদের পাশাপাশি যাদের বৈধ নাগরিকত্বের কাগজপত্র নেই, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কোনো দেশে বসবাস করছেন, তাদের জন্যও প্রযোজ্য। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশই এই আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুস্বাক্ষর করেছে। ফলে ভারত তার নিজ দেশে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী বাংলাভাষি নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে সরাসরি এই আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করছে।
অন্যদিকে কনভেনশন অন দ্য প্রটেকশন অব দ্য রাইটস অব অল মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স অ্যান্ড মেম্বারস অব দেয়ার ফ্যামিলি বা অভিবাসী শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের অধিকারের সুরক্ষা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির ২২ ধারা অনুযায়ী, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে কোনো অভিবাসী শ্রমিক ও তার পরিবারের সদস্যদের কোনো দেশ থেকে বহিষ্কার করা যাবে না। তাদের গণহারে বহিষ্কারও করা যাবে না, সবার আইনগত বৈধতার বিষয়টি আলাদা আলাদা পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এ ছাড়া ইউরোপীয় কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটসের ৪ নম্বর প্রটোকলের আর্টিকেল ৪, আমেরিকান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটসের আর্টিকেল ২২(৯), আফ্রিকান চার্টার অন হিউম্যান অ্যান্ড পিপলস রাইটসের আর্টিকেল ১২(৫) এবং আরব চার্টার অন হিউম্যান রাইটসের আর্টিকেল ২৬(১) অনুযায়ী বিদেশি নাগরিকদের আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া গণহারে বহিষ্কার করা যায় না।
এ পর্যন্ত যত পুশ ইন
২০০২–০৩ সালের দিকে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ক্ষমতায় থাকার সময় ভারত থেকে মাঝে মধ্যেই পুশ ইনের ঘটনা ঘটত। দুই দশকের বেশি সময় পর সম্প্রতি পুশ ইনের মতো উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করে নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। চলতি বছরের মে মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ছয়শ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে।
পুশ ইনের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে শুধু ভারতের আসাম রাজ্যের ৩৩০ জনেরও বেশি নারী-পুরুষ রয়েছেন। গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা গত ৯ জুন পুশ ইনের এ তথ্য জানান। হিমন্ত বলেন, ‘আসামের অভিবাসনবিষয়ক বিশেষ আইনের আওতায় আসামের জেলাগুলোর প্রশাসকদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের জোরালো অভিযান চলমান থাকবে।’