
সরকার পরিবর্তনের পর ১৪টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে তারল্য সহায়তা। এতেও কিছু ব্যাংক এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। খুঁড়িয়ে হাঁটছে হাফ ডজন ব্যাংক। আমানত পেতে উচ্চ সুদ হাঁকাচ্ছে অনেকে। তার পরও তেমন সাড়া মিলছে না। অন্যদিকে কোনো রকম প্রচার ছাড়াই আমানত উপচে পড়ছে কিছু ব্যাংকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, এখন আমানতের গড় সুদহার ৬.১৪ শতাংশ। আমানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ সুদ দিচ্ছে বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক। এক বছরের নিচে এফডিআর করলে এই হারে সুদ দেবে ব্যাংকটি। কিন্তু তথ্য বলছে, উচ্চ সুদ দিতে চাইলেও গত জানুয়ারিতে ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি আগের বছরের একই সময়ের তুলানায় ৫.৭৫ শতাংশ কম। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। এ ছাড়া সিটিজেনস ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক সাড়ে ১১ শতাংশের বেশি সুদ অফার করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, আমানতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ঋণের সুদহারও। বর্তমানে ব্যাংকঋণের গড় সুদহার ১১.৯৪ শতাংশ। ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ গ্লোবাল ইসলামী (১৬.৩৫%) ও পদ্মা (১৬.১২%) ব্যাংকের সুদ। অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ (৯.৮৩) ও প্রাইম (৯.৯৫) ব্যাংকের ঋণের সুদহার সর্বনিম্ন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি শেষে বেশির ভাগ ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। তবে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে তৃতীয়াংশ ব্যাংকের। ঋণের সুদহার ১৬ শতাংশ ছাড়ানোর পরও আগের বছরের তুলনায় ৩৮.৩৩ শতাংশ বিতরণ বেড়েছে। কারণ জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মো. তালহা (চলতি দায়িত্ব) কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন নতুন আমানত আসছে না ঠিকই, তবে বকেয়া আদায় হচ্ছে। সেখান থেকেই আমরা অল্প অল্প করে ঋণ বিতরণ করছি। এখন এসএমই খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য ঋণের তুলনায় এসএমই ঋণের সুদহার একটু বেশিই হয়। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়ানোর কারণে সব ব্যাংকেরই সুদহার বেড়েছে। প্রতিকূল পরিবেশেও আমরা নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যদি কিছু আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায়, তাহলে আমরা খুব উপকৃত হব।’
জানুয়ারি শেষে পদ্মা ব্যাংকের আমানত ছিল পাঁচ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের (২০২৪) জানুয়ারির চেয়ে ১.১ শতাংশ কম। অর্থাৎ ব্যাংকটির আমানত প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। কিন্তু ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৮.৩৩ শতাংশ। সুতরাং নতুন করে আমানত না পেলেও ঋণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে ব্যাংকটির।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য একটি প্রতিবেদনের তথ্য মতে, পদ্মা ব্যাংকের এসএমই ঋণের সুদের হার ১৬.২৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বৃহৎ শিল্পের ঋণের সুদহার ১৫.৭৩, কৃষি ঋণে ১০.৯৬ এবং সামগ্রিক গড় সুদহার ১৬.১২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এখন বাংলাদেশে ৬১টি ব্যাংক। কোনো ব্যাংকে ঋণের সুদহার ১৬ শতাংশ ছাড়ালে অন্য আরো অনেক ব্যাংক আছে যাদের সুদহার কম। চাইলে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ আছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান। তিনি বলেন, ‘বাজার অর্থনীতিকে কেউ সুদহার নির্ধারণ করে দিতে পারে না। কেউ উচ্চ সুদে ঋণ বিতরণ করলেই সে মার্কেট ম্যানুপুলেট করতে পারবে, বিষয়টা এমন নয়। গ্রাহক চাইলেই কম সুদের ব্যাংক থেকেও ঋণ নিতে পারে। সুতরাং বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ আছে।’
তিনি বলেন, ‘গত ১০ এপ্রিল আইএমএফের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে গভর্নর জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন দুই অঙ্কের ঘরে থাকা মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। গত মার্চে মূল্যস্ফীতি নেমেছে ৯.৩৫ শতাংশে। আগামী জুনের মধ্যে ৮ শতাংশে নামার আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের পর সুদহার কমানোর কথা ভাববে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা যত দিন থাকবে, সেখানে নতুন বিনিয়োগ হবে না। একদিক দিয়ে বিনিয়োগের টাকা নেই। আরেক দিক দিয়ে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। এই দুই সমস্যার সমাধান যত দিন না হবে, বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা তত দিন খুবই কম।’
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, ‘আমাদের বর্তমান সময়ের যে প্রবৃদ্ধি, আমাদের বিনিয়োগ হার—সব কিছুই এমন এক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যা সুখকর নয়। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের জন্য পরিবেশটা অনুকূল নয়। তাদের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য পরিবেশটা প্রতিকূল। যেহেতু সুদের হারটা বেশি, তাই সেটাও বিনিয়োগ কমার কারণ হিসেবে কাজ করতে পারে। ’