Image description
ভোটের ভাবনা নিয়ে যাচ্ছেন রাজনীতিকরা | দেড় দেশকের বেশি সময় পর নির্ভয়ে ঈদ কাটাবেন অনেক রাজনীতিক | আগামী নির্বাচনে নিজেদের করণীয়সহ দলীয় বার্তা পৌঁছে দেবেন তৃণমূলে | বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের সিনিয়ররা থাকবেন ঢাকায় | জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় থাকবে গুরুত্ব।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাজনীতির মাঠে সবচেয়ে ভালো সময় পার করছে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলো। ভিন্ন আবহে স্বস্তির পরিবেশে এবারের ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে যাচ্ছেন দলগুলোর নেতাকর্মীরা, যা বিগত দিনে তাদের কাছে ছিল স্বপ্নের মতো। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের দেড় দশকের বেশি সময় পর ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশে নির্ভয়ে ঈদ কাটাবেন রাজনীতিকরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় নেতাকর্মী ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করবেন তারা। সেইসঙ্গে আগামী নির্বাচনে নিজেদের করণীয়সহ দলীয় বার্তা পৌঁছে দেবেন তৃণমূলে জনসাধারণের মাঝে। থাকবে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন এবং যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর বেশিরভাগ সিনিয়র ও কেন্দ্রীয় নেতা ঢাকায় ঈদুল ফিতর উদযাপন করবেন। কেউ কেউ নামাজ আদায় করেই রওনা দেবেন নিজ এলাকায়। বিশেষ করে যারা আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান, তাদের বেশিরভাগই এখন নির্বাচনী বার্তা নিয়ে এলাকামুখী। পাশাপাশি ঈদ ঘিরে যার যার সংসদীয় আসনে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে জনসংযোগ করবেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নিজস্ব আঙ্গিকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবেন এবারের ঈদে। তাদের প্রত্যাশা, শিগগির বাংলাদেশ পূর্ণ গণতান্ত্রিক চরিত্রে ফিরবে।

এদিকে, বিগত ১৭ বছরের স্বৈরশাসনে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুম-খুনের শিকার নেতাকর্মীদের পরিবারেও ঈদ উপহার পৌঁছে দিচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। এ ক্ষেত্রে ‘জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন (জেডআরএফ)’ ও ‘আমরা বিএনপি পরিবার’- এর মাধ্যমে উপহার দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই ব্যক্তি উদ্যোগে ঈদ উপলক্ষে উপহারসামগ্রী বিতরণ করছেন। ঈদ উৎসবের মধ্যেই স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাংগঠনিক কাজকর্ম শেষ করে দ্রুতই ঢাকায় ফিরতে চান রাজনীতিকরা। বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, এবারের ঈদুল ফিতর তাদের কাছে এক ভিন্নরকম অনুভূতি তৈরি করেছে। কেননা, এর আগে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সময়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা হয় জেলে না হয় আত্মগোপনে ঈদ উদযাপন করেছেন। গত বছরের অভ্যুত্থানের পর একটা মুক্ত পরিবেশে ঈদ উদযাপন করবেন দলটির নেতাকর্মীরা।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দেশবাসীকে ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়ে গতকাল শুক্রবার কালবেলাকে বলেন, দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর একটি ভিন্ন পরিবেশে এবার ঈদুল ফিতর উদযাপন করবে মানুষ। অন্যবারের তুলনায় এবার স্বস্তিদায়ক ঈদ। নেতাকর্মীরা অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় ঈদুল ফিতর পালন করবেন। এবারের ঈদে বিএনপির বার্তা হলো—নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ঈদ উদযাপন করবেন। বিশেষ করে আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে অনেক সতর্ক থাকতে হবে, যাতে আমাদের কথাবার্তা এবং আচরণে মানুষ কষ্ট না পায়। জনগণের পাশে থাকতে হবে, এটিই আমাদের দলীয় বার্তা। সবার প্রতি আমার আহ্বান থাকবে—যেন সতর্কতার সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করেন। এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঈদ উপহার নিয়ে এরই মধ্যে তৃণমূলে ছুটছেন সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীরা। গণমাধ্যমের সম্পাদক, কূটনীতিকসহ বিশিষ্টজনের মাঝে তারেক রহমানের পক্ষ থেকে ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা কার্ড ও মিষ্টান্ন পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি আন্দোলন-সংগ্রামে গুম-খুন ও নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মীদের খোঁজ নিতে এবং তাদের পরিবারে উপহার দিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে টিম গঠন করা হয়েছে। দলের নেতাকর্মী ছাড়াও সারা দেশে অসহায়-দুস্থদের জন্য বস্ত্র ও খাবার বিতরণ করছেন বিএনপির নেতারা।

ঢাকা বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ তার নির্বাচনী এলাকা নারায়ণগঞ্জ-২ আসনে (আড়াইহাজার) পরিবার ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদুল ফিতর উদযাপন করবেন। তিনি বলেন, স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদ করে আবার ঢাকা ফিরব। এরই মধ্যে তিনি একাধিক ইফতার মাহফিল করেছেন এলাকায়। ‘আমরা বিএনপি পরিবার’-এর উপদেষ্টা ও নেত্রকোনা-৩ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রকৌশলী মো. মোস্তফা-ই জামান সেলিম কালবেলাকে বলেন, তিনি এরই মধ্যে কয়েকবার তার নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে মানুষের সঙ্গে গণসংযোগ করে তাদের খোঁজখবর নিয়েছেন। ঢাকায় ঈদ উদযাপন করে পরদিন আবারও এলাকায় গিয়ে মানুষের সঙ্গে গণসংযোগ করবেন।

জয়পুরহাট-২ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রকৌশলী আমিনুর ইসলাম বলেন, তিনি জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ, আহত এবং বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীসহ প্রায় ৭৭৫ জনের মধ্যে ঈদ উপহার বিতরণ করেছেন। তারেক রহমানের পক্ষে শুভেচ্ছা পৌঁছে দিয়েছেন। বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতারা জানান, সংস্কারের নামে যাতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিছিয়ে না যায়, সেজন্য নির্বাচনের লক্ষ্যে মাঠে থাকবে বিএনপি। ঈদ সামনে রেখে প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় সম্ভাব্য প্রার্থীরা জনসংযোগ করবেন। এই লক্ষ্যে এরইমধ্যে রোজার শুরুতে ইফতার মাহফিল ও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মাঠে ছিল বিএনপি। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান কালবেলাকে জানান, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবার চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। সেখানে বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর সহধর্মিণী এবং দুই মেয়েকে নিয়ে ঈদ পালন করবেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান ও ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন লন্ডনে, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী চট্টগ্রামে নিজ এলাকায় ঈদ করবেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির অন্যান্য সদস্য ঢাকায় ঈদুল ফিতর উদযাপন করবেন। ঈদের দিন প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে মহাসচিব শুভেচ্ছা জানাতে যাবেন।

সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকার বাসায় ও বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস নিজ এলাকা পাবনায় ঈদ করবেন। এ ছাড়া ঈদুল ফিতরের দিন সকালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ ও দোয়া মোনাজাত করবেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সিনিয়র নেতারা। এ ছাড়া দলের ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের অধিকাংশ ঢাকায় ঈদ পালন করবেন। ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমিনুল হক, সদস্য সচিব মোস্তফা জামান, দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু, সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিন ঢাকায় নিজ নির্বাচনী এলাকায় ঈদ করবেন। যুগ্ম মহাসিচব আব্দুস সালাম আজাদ নিজ এলাকা মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু শ্রীনগরে, কেন্দ্রীয় নেতা তাবিথ আউয়াল ও প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন ঢাকায় ঈদ করবেন। বিএনপির শিক্ষা সম্পাদক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, মিডিয়া সেলের সদস্য ড. মোর্শেদ হাসান খান ঢাকায় থাকবেন। এ ছাড়া নরসিংদী-৫ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা প্রকৌশলী আশরাফ উদ্দীন বকুল এবং পল্লী উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক ফরহাদ হোসেন আজাদ পঞ্চগড়ে, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মো. আনোয়ারুল হক নেত্রকোনা-৩ (সদর) নিজ নিজ আসনে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন।

জামায়াত নেতাদের ঈদ উদযাপন: জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ঢাকায় নিজ বাড়িতে, নায়েবে আমিরদের মধ্যে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান মক্কায়, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে নিজ বাড়িতে, সাবেক এমপি মাওলানা শামসুল ইসলাম চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, সংগঠনটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খুলনার খানজাহান আলী থানায় নিজ বাড়িতে, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মা’ছুম কুমিল্লার লাকসামের নারায়ণপুর গ্রামে, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় নওকৈড় গ্রামে, হামিদুর রহমান আযাদ ঢাকার বসুন্ধরায়, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের পবিত্র মক্কায়, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জম হোসাইন হেলাল বরিশালে নিজ বাড়িতে, মাওলানা মো. শাহজাহান চট্টগ্রাম মহানগরীতে, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ ঢাকার উত্তরায় পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করবেন। যুগপতের শরিক দলগুলো কে কোথায়: আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু কালবেলাকে বলেন, তিনি তার নির্বাচনী এলাকা ফেনী-২ আসনের গণমানুষের সঙ্গে ঈদুল ফিতর উদযাপন করবেন। ঈদের দিন ফেনী সদরের শ্বর্শদী স্কুল মাঠে ঈদের নামাজ আদায় শেষে স্থানীয়ভাবে কুশল বিনিময় করবেন। তিনি বলেন, দল-মত নির্বিশেষে জনগণের সঙ্গে নেতাকর্মীদের কুশল বিনিময় করে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা গতকাল কালবেলাকে বলেন, তিনি ঢাকায় ঈদের নামাজ শেষে পরদিন নিজের নির্বাচনী এলাকা নিকলী-বাজিতপুরে (কিশোরগঞ্জ-৫) যাবেন। তিনি বলেন, এবার মুক্ত পরিবেশে ঈদ উদযাপন করা হবে। আশা করি, শিগগির বাংলাদেশ তার পূর্ণ গণতান্ত্রিক চেহারা ফিরে পাবে। এই জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম কালবেলাকে বলেন, তিনিও ঢাকায় ঈদের নামাজ আদায় করে পরদিন তার নির্বাচনী এলাকায় (লক্ষ্মীপুর-১) যাবেন। সেখানে তিনি প্রতি বছরের মতো স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কুশল বিনিময় ও ঈদ পুনর্মিলনী করবেন। তিনি বলেন, এবারের ঈদ অত্যন্ত স্বস্তির। ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তিও নেই। দ্রব্যমূল্যসহ নানা কারণে জনগণ স্বস্তিতে আছে। গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ২০১৯ সাল থেকে স্বাভাবিকভাবে আমরা ঈদ করতে পারিনি। এবার মুক্ত পরিবেশে ঈদ উদযাপনের জন্য নিজ সংসদীয় আসন ঝিনাইহে আছি। রাজনীতিবিদরা যেহেতু নির্বাচন করেন, তাই তারা চাইবেন ঈদের সুযোগ কাজে লাগিয়ে মানুষের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে।