
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন থেকে পাঠানো ছয় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করছে রাজনৈতিক দলগুলো। পর্যালোচনা শেষে লিখিত আকারে তাদের মতামত কমিশনে পাঠাবে। ১৩ মার্চের মধ্যে দলগুলোকে লিখিত মতামত জানাতে অনুরোধ করেছে কমিশন।
সূত্র জানায়, বিএনপি ও জামায়াতসহ মোট ৩২টি রাজনৈতিক দলের কাছে ছয় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের হার্ডকপি পাঠিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন কমিশন। প্রতিবেদনের সঙ্গে কমিশন একটি করে চিঠিও পাঠিয়েছে দলগুলোকে। চিঠিটি মালটিপল চয়েস কোয়েশ্চেন (এমসিকিউ) ধাঁচের। এতে সুপারিশের বিষয়ে ‘একমত’, ‘আংশিক একমত’ এবং ‘ভিন্নমত’- তিনটি প্রশ্ন রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সংস্কার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও সময় সম্পর্কে পাঁচটি বিকল্প দিয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে চিঠিতে।
জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করছি। তিনি বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে-বিদেশে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। এমন একটি প্রতিবেদন দিতে সাত মাস সময় লেগেছে। তিনি বলেন, জনগণ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের কারণে দীর্ঘদিন ভোট দিতে পারেনি। সরকারের উচিত দ্রুত একটি নির্বাচনের আয়োজন করা। নির্বাচিত সরকার সামগ্রিক সংস্কার করবে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, পর্যালোচনা শেষে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে মতামত পাঠানো হবে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারওয়ার তুষার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঐকমত্য কমিশনের চিঠি পেয়েছি। সংস্কার প্রতিবেদনগুলো নিয়ে দলীয় ফোরামে পর্যালোচনা চলছে। ১৩ মার্চের মধ্যেই আমরা চিঠির জবাব দেব।
এদিকে রাষ্ট্র সংস্কারের ‘জুলাই সনদ’ আগামী নির্বাচনের আগেই কার্যকর দেখতে চায় এনসিপি। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রূপরেখা কেমন হবে, কী কী সংস্কার এই সময়ে করা হবে, কী কী সংস্কার ভবিষ্যতে করা হবে, কী কী সংস্কারের ধারাবাহিকতা থাকবে- জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কাছে তার লিখিত অঙ্গীকার করবে। নির্বাচনে যাওয়ার আগে আমরা দৃশ্যমান বিচার কার্যক্রম ও জুলাই সনদের বাস্তবায়ন দেখতে চাই।
বিএনপির মিত্র ১২-দলীয় জোটপ্রধান জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, জোট শরিকদের নিয়ে প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ১৩ মার্চের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে পারব না, এজন্য আমরা কমিশনে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছি। এরপর মতামত চূড়ান্ত করে কমিশনের কাছে জমা দেব।
গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদ সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক আবু হানিফ বলেন, কমিশনের প্রতিবেদন আমরা পর্যালোচনা করছি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমাদের মত লিখিত আকারে জমা দেব।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের আহ্বায়ক ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, শনিবার চিঠি পেয়েছি। দলীয় ফোরামে আলোচনা করে মতামত পাঠাব। প্রতিবেদন পাওয়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, হেফাজতে ইসলামসহ প্রায় সব দলের একই রকম বক্তব্য, এখন পর্যালোচনা চলছে। পর্যালোচনা শেষে মতামত দেবে। তবে কয়েকটি দলের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, সময় আরেকটু বেশি হলে ভালো হতো। জানা গেছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছে, তাতে সংস্কার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও সময় সম্পর্কে পাঁচটি বিকল্প দিয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। বিকল্পগুলো হলো-নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে, নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে, নির্বাচনের সময়ে গণভোটের মাধ্যমে, গণপরিষদের মাধ্যমে এবং নির্বাচনের পর সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে। এগুলোর মধ্যে কোনো প্রক্রিয়া ও সময় সম্পর্কে কোন দলের মতামত কী, সে বিষয়ে লিখিত জানতে চেয়েছে কমিশন।
১৩ মার্চের মধ্যে দলগুলোর কাছ থেকে মতামত পাওয়ার পর সংলাপের আয়োজন করা হবে। রোজার ঈদের আগেই দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় সংলাপে বসবে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন এ কমিশন। সেক্ষেত্রে বিএনপি, জামায়াত এবং নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) উল্লেখযোগ্য দলগুলোর সঙ্গে কমিশন এককভাবে সংলাপে বসবে। আর যেসব দল নিজেরা অন্য কয়েকটি দল নিয়ে জোটবদ্ধ, তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবেই সংলাপ হবে। সেক্ষেত্রে বিএনপির মিত্র ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সঙ্গে জোটবদ্ধ সংলাপ হবে। এ ছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চ, হেফাজতে ইসলাম ও বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ অন্যান্য জোটের সঙ্গেও জোটবদ্ধ সংলাপ হবে। যে ৩২টি দলের কাছে ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ও চিঠি পাঠানো হয়েছে সেগুলোর মধ্যে নিবন্ধিত দলের পাশাপাশি নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামী এবং এখনো নিবন্ধনহীন অনেক রাজনৈতিক দলও রয়েছে। নির্বাচন কমিশনে (ইসি) এখনো নিবন্ধন না পাওয়া দলগুলোর মধ্যে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করা তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ও (এনসিপি) রয়েছে।
জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার কমিশনের যেসব প্রস্তাব বা সুপারিশে সবাই একমত হবে, সেগুলোর ভিত্তিতেই হবে জুলাই সনদ। সেক্ষেত্রে পুলিশ, দুদক, জনপ্রশাসনসহ যেসব বিষয়ে সাংবিধানিক বিষয় বা প্রশ্ন নেই, সেগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংস্কারের উদ্যোগ নেবে সরকার। আর সংবিধান, বিচার বিভাগ ও নির্বাচন ব্যবস্থাসহ যেসব বিষয়ে সাংবিধানিক বিষয়াদি রয়েছে, সেগুলো গণভোটের মাধ্যমে সংস্কার করা যায় কি না, তা জানতে চাওয়া হবে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। আগামী সংসদ নির্বাচনের সঙ্গেই গণভোট করা যায় কি না, এ বিকল্পও প্রস্তাব করা হবে দলগুলোকে। কিছু বিষয়ে নির্বাচনের পর আগামী সংসদে সংস্কার হতে পারে বলেও বিকল্প রাখবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
প্রসঙ্গত, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে ১২ ফেব্রুয়ারি ছয় মাসমেয়াদি ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ কমিশনের সহসভাপতি। এ ছাড়া নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জনপ্রশাসন এবং পুলিশ সংস্কারবিষয়ক কমিশনের প্রধানরা ঐকমত্য কমিশনের সদস্য। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এ কমিশন ৫৪টি রাজনৈতিক দল-জোটের প্রায় ১০০ নেতার সঙ্গে প্রথমবারের মতো রাজধানীর হেয়ার রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বৈঠক করে। বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তারা তখন পর্যন্ত ছয় কমিশনের সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদনগুলো পায়নি। সেই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা প্রতিবেদনগুলো রাজনৈতিক দলসমূহকে দেওয়ার নির্দেশনা দেন। এ ছাড়া ওইদিন সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মতামত চাওয়া হবে। এরপর দলগুলোর সঙ্গে কখনো একত্রে, প্রয়োজনে আলাদা বৈঠকে বসবে কমিশন।