Image description

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ঘোষিত সেই ‘অক্সিলারি ফোর্স (সহায়ক পুলিশ)’ রাজধানীর ৪৮টি থানায় পুলিশিংয়ের দায়িত্ব পাচ্ছে। শপিংমল ও আবাসিক এলাকার বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের পাশাপাশি স্থানীয় ব্যক্তিদেরও এই ফোর্সে যুক্ত করা হচ্ছে। আপাতত ঈদ পর্যন্ত নিরাপত্তা কার্যক্রম চালাতে অন্তত ৫০০ সদস্যের অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে পরেও এই ফোর্সের কার্যক্রম চালু রাখার চিন্তাভাবনা চলছে। পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে।

গত শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স-১৯৭৬ অনুযায়ী ‘অক্সিলারি ফোর্স’ নিয়োগের ঘোষণা দেন। তিনি বলেছিলেন, এই ফোর্স পুলিশের মতোই গ্রেপ্তারি ক্ষমতা পাবেন।

বিশ্বের বিভিন্ন শহর বা নগর পুলিশে এই ধরনের সহায়ক পুলিশ নিয়োগের রীতি থাকলেও দেশে এর আগে সরাসরি পুলিশি ক্ষমতা দিয়ে বেসরকারি কাউকে পুলিশে এমন নিয়োগের নজির নেই। ফলে এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এই ফোর্সের কাজ কী? তা নিয়েও চলছে নানা আলোচনা।

যদিও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স-১৯৭৬-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে এই অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগের কথা বলা আছে। ১০ ধারায় ১ উপধারায় বলা হয়, ‘যখন মনে হবে যে বাহিনীর সহায়তার প্রয়োজন, তখন পুলিশ কমিশনার যে কোনো ব্যক্তিকে বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য সহায়ক পুলিশ অফিসার হিসেবে নিয়োগ করতে পারেন। উপধারা-২-এ বলা হয়, প্রত্যেক সহকারী পুলিশ অফিসার নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন এবং নির্ধারিত ফর্মে একটি সনদ পাবেন। ২ উপধারার (খ) তে বলা হয়েছে, অন্য যে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার মতো সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তার একই ক্ষমতা এবং দায়মুক্তি থাকবেন। পাশাপাশি একই দায়িত্ব পালনের জন্য দায়ী থাকবেন এবং একই শাস্তির জন্য দায়ী থাকবেন। তারা অন্য যে কোনো পুলিশ অফিসারের মতো একই কর্তৃপক্ষের অধীন হবেন। যদিও এই ধারায় অক্সিলারি ফোর্সের সদস্যরা গ্রেপ্তারি ক্ষমতা বা তদন্ত ক্ষমতা পাবেন কি না, তা স্পষ্ট করে বলা নেই।

অবশ্য পুলিশিং কার্যক্রম ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ধরনের নিয়োগের বিরোধিতা না করলেও তারা গ্রেপ্তারি ক্ষমতার বিষয়টি নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়েছেন। এই অক্সিলারি ফোর্স হিসেবে কারা নিয়োগ পাবেন বা তাদের কাজ কী হবে, সে বিষয়ে নীতিমালা ঠিক করারও পরামর্শ দিয়েছেন। এই নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে উদ্দেশ্য সফল হবে না বলেও সতর্ক করেছেন।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা কালবেলাকে বলেন, এই অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগের ক্ষমতা পুলিশ কমিশনারকে দেওয়া আছে। আইজিপিও এই ধরনের ফোর্স নিয়োগ করতে পারেন। তবে নিয়োগের জন্য ব্যক্তি নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ধরনের ফোর্স নিয়োগ করে সুফল পাওয়ার নজির আছে। ভেরিফাইড ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার পর তাদের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তারা যেন ক্ষমতার অপব্যবহার না করতে পারে।

তিনি বলেন, সারা দেশে রাজনৈতিক বিভাজন আছে। এই নিয়োগ যেন কোনোভাবেই রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত না হয়। যদি তা না করা হয় তাহলে মূল উদ্দেশ্য সফল হবে না।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষিত নিরাপত্তাকর্মীদের পাশাপাশি যোগ্যতাসম্পন্ন স্থানীয়দেরও এই ফোর্সে নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে এই নিয়োগের পূর্ণ এখতিয়ার ডিএমপি কমিশনারের।

ঢাকার ৫০টি থানার মধ্যে ৪৮টি থানায় এই ফোর্স নিয়োগ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, একেক থানায় গড়ে ১০ জন করে কাজ করবেন। শুধু ক্যান্টনমেন্ট ও আদাবর থানায় আপাতত এই ফোর্স থাকবে না।

তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে এই নিয়োগের কোনো মেয়াদ থাকবে না। নিয়োগকারী তা নির্ধারণ করবেন। তবে তাদের কোনো বেতন বা ভাতা দেওয়া হবে না। শুধু সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। নিয়োগ পাওয়া সদস্যরা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করবেন।

আদাবর থানাটি ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের অধীনে পড়েছে। প্রাথমিকভাবে ওই থানায় ‘অক্সিলারি ফোর্স’ নিয়োগ না দেওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. ইবনে মিজান। তিনি কালবেলাকে বলেন, এই দফায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মার্কেট এলাকা। আদাবর থানাটি অন্যান্য থানার তুলনায় বেশ ছোট এবং এই এলাকায় বড় কোনো মার্কেট বা শপিংমলও নেই। যে কারণে এই থানায় অক্সিলারি ফোর্স দেওয়া হচ্ছে না। ছোট এলাকা হিসেবে পুলিশ সদস্যরাই তা কাভার করতে পারছে।

মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক কালবেলাকে বলেন, বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান থেকে পুলিশের সহায়ক সদস্য নেওয়ার রেওয়াজ পৃথিবীর বিভিন্ন নগর বা শহর পুলিশে আছে। সেক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল পাওয়ার রেকর্ড আছে। তবে আগে এই অক্সিলারি ফোর্সের কার্যক্রমের নীতিমালা ও মানদণ্ড ঠিক করা উচিত। নইলে নিয়োগ দেওয়ার পর নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা ও নজরদারি না থাকলে ভালো কিছু হবে না।

তিনি বলেন, অক্সিলারি ফোর্সে অবশ্যই দক্ষতা, সততা, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ ছিল—এমন লোকদের সব ধরনের প্রভাবমুক্ত হয়ে নিয়োগ দিতে হবে। আগে অপরাধ বা অপরাধীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিয়োগ পেয়ে গেলে উল্টো পুলিশের দুর্নাম হবে।

যদিও গত শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী জানিয়েছিলেন, যেহেতু রাত পর্যন্ত শপিং সেন্টারগুলো খোলা থাকবে এবং আমাদের পুলিশের স্বল্পতা রয়েছে। তাই ডিএমপি অর্ডিন্যান্সের ক্ষমতাবলে তিনি অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগ দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, নিয়োগ পেতে যাওয়া পুলিশের সহায়ক এই ফোর্সের সদস্যদের হাতে একটি ব্যান্ড থাকবে, যা তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। আইন অনুযায়ী একজন পুলিশ সদস্য যে দায়িত্ব পালন করেন, সেই একই দায়িত্ব পালন করবেন অক্সিলারি ফোর্সের সদস্যরা। তাদের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা থাকবে এবং পুলিশ আইনগতভাবে যে প্রোটেকশন পায়, ঠিক একই রকম প্রোটেকশন পাবে ফোর্সের সদস্যরা।