Image description
বিপন্ন শিশুরা। ধর্ষণের শিকার ৫৩৯ শিশুর বয়স ৬ বছরের কম। খুন ৪ হাজার ৩৮৯ শিশু। ‘আইনশৃঙ্খলার পতন ঘটায় বেড়েছে অপরাধ’। সামাজিক সচেতনতায়ও জোর বিশেষজ্ঞের।

মাগুরায় বোনের বাড়িতে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার ৮ বছরের এক শিশুর ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনায় ফুঁসে উঠেছে সারা দেশ। প্রতিবাদে পথে নেমেছেন নারীসমাজ ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। এর মধ্যেই গাজীপুরে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮ বছরের আরেক শিশুশিক্ষার্থী। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব বলছে, দেশে এভাবেই প্রতিনিয়ত নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে শিশুরা। শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে বলেও জানিয়েছেন মানবাধিকারকর্মীরা। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কেউই শিশুকে নিরাপত্তা দিতে পারছে না বলে মনে করেন তাঁরা।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আট বছরে দেশে সহিংসতার শিকার হয়েছে অন্তত ৯ হাজার ৬৭৭ শিশু, অর্থাৎ যাদের বয়স ১৮ বছরের কম। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক, ৪ হাজার ৮০১ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গত আট বছরে ধর্ষণের শিকার শিশুদের মধ্যে অন্তত ৫৩৯ জনের বয়স ছয় বছরের কম। আর ১ হাজার ২৮ জনের বয়স সাত থেকে বারো বছরের মধ্যে।

আসকের (আইন ও সালিশ কেন্দ্র) তথ্য বলছে, গত আট বছরে ৪ হাজার ৩৮৯ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত ৯৯৯ জনের বয়স ছিল ছয় বছরের কম। আর ৯২৯ জনের বয়স সাত থেকে বারো বছরের মধ্যে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৪০ শিশুকে। এদের মধ্যে ৩৩ শিশুর বয়স ছয় বছরের কম। আর ৯৮ জনের বয়স সাত থেকে বারো বছরের মধ্যে।

মানবাধিকারকর্মী জিনাত আরা হক মনে করেন, সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে শিশুদের প্রতি সহিংসতা আরও বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের আইনশৃঙ্খলার পতন ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা মানুষকে সাহস জোগাচ্ছে না। শিশু নিপীড়ন বেড়ে গেছে। বছরের পর বছর ধরে এটা বেড়েই চলেছে। নিপীড়কের কাজ হলো, যে দুর্বল ও প্রান্তিক তাকে নির্যাতন করা। শিশু, নারী, বৃদ্ধ, ট্রান্সজেন্ডাররা যেহেতু প্রান্তিক এবং দুর্বল, তাই তাদের ওপর নিপীড়ন হচ্ছে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র– তিনটি জায়গা থেকে নিপীড়কদের সমর্থন দেওয়া হচ্ছে। দুর্বৃত্তায়ন আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে যাচ্ছে।’

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) বলছে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেশে কমপক্ষে ৬ হাজার ৩০৫ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৪৭১ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে, যা মোট ঘটনার ৫৫ শতাংশের বেশি।

শাস্তির অভাবে বাড়ছে নিপীড়ন

শিশু নিপীড়নের ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রবণতা কম। অধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা মনে করেন, এটা শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ার একটি বড় কারণ। আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আট বছরে অন্তত ৯ হাজার ৬৭৭টি শিশু সহিংসতার শিকার হলেও মামলা হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ১৫৯টি। অর্থাৎ প্রায় ৪০ শতাংশ ঘটনায় শিশুর পরিবার বা অন্য কেউ আইনি পদক্ষেপ নেয়নি।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না এ বিষয়ে বলেন, ‘যেকোনো অপরাধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হয়। অন্যথায় অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।’

মানবাধিকারকর্মী জিনাত আরা হক বলেন, ‘বিচারে বিলম্ব, বিচার না হওয়া এবং বিচার হলেও শাস্তি কার্যকর না হওয়ার ফলেই নারী ও শিশু নির্যাতন বাড়ছে।’

শিশু নিপীড়ন ও হত্যার মতো অপরাধ করেও সাজাপ্রাপ্ত আসামি জামিন পেয়ে যাচ্ছে। ধর্ষক, নিপীড়কদের ফুলের মালা দিয়ে থানা থেকে বের করে আনা হচ্ছে। এটা অন্য নিপীড়কদের সাহস জোগাচ্ছে।’

অগ্রগতি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা

ইউনিসেফ বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, দেশে শিশুর (০-১৭ বছর) সংখ্যা ৫ কোটি ৬৯ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশেরও বেশি। তার কমবেশি অর্ধেক মেয়ে শিশু। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে দেশের স্বাভাবিক অগ্রগতি ব্যাহত হবে বলে মনে করেন অধিকারকর্মীরা। শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে মত দেন তাঁরা।

মানবাধিকারকর্মী ও অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি শুধু আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয়। আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা এর সঙ্গে জড়িত। এই জায়গাটাতে কাজ করতে হবে। এটা দীর্ঘমেয়াদি কাজ। এ জন্য জাতীয়ভাবে দেশব্যাপী অভিযান পরিচালনা করতে হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে শেখাতে হবে নারী ও শিশুদের ওপর নির্যাতন করা যাবে না। তাদের সম্মান করতে হবে। প্রতিটি স্কুলে এসব শেখাতে হবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে।