Image description

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে দলটির নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গত বছরের ৫ আগস্ট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে সামরিক হেলিকপ্টারে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করেন দলটির শীর্ষ নেতারা। তাদের মধ্যে অনেকে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছেন। কেউ কেউ আবার পালানোর সময় বিমানবন্দরে এবং আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের দিন কাটছে গ্রেপ্তার আতঙ্কে। বিচ্ছিন্নভাবে তারা আত্মগোপনে থেকে গ্রেপ্তার এড়াতে চেষ্টা করছেন। তাদের অনেকে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ভুল সিদ্ধান্ত ও অদূরদর্শিতাকে দায়ী করে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করছেন।       

আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বিদেশে অবস্থান ও আত্মগোপনে থাকায় গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা দলটিতে দেখা দিয়েছে চরম নেতৃত্ব শূন্যতা। সাংগঠনিকভাবে দলটি রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দেশজুড়ে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, চাঁদাবাজি, দখল, গুম-খুন এবং গণহত্যাসহ নানা অপরাধে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে আদালতের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও বিচার প্রক্রিয়া চলছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন মামলায় দলটির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে।

দিন যত যাচ্ছে আওয়ামী লীগের জন্য সংকট আরও গভীর হচ্ছে। সংকট থেকে উত্তরণে আওয়ামী লীগের চেষ্টার মধ্যে তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভেরিফায়েড পেজগুলো থেকে বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরে পোস্ট করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া কেউ কেউ আবার ছোটখাটো ঝটিকা মিছিল, দেয়াল লিখন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হচ্ছেন।

গত সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, যারা আওয়ামী লীগের লিফলেট বিতরণ করবে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি বলেন, ‘পতিত স্বৈরাচারের দোসর ও সাঙ্গপাঙ্গরা অনেক কিছু করতে চাচ্ছে। তারা লিফলেট বিতরণ করতে চাচ্ছে। যারা লিফলেট বিতরণ করবে তাদের জন্য কড়া বার্তা হলো—তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।’ 

এর আগে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে। আর উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ইতোমধ্যে বলেছেন, আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে না। এমন পরিস্থিতিতে দিশেহারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এখন দিগ্বিদিক ছুটছেন।

ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের দল এখন বিপর্যস্ত, নেতাকর্মীরা দিশেহারা। ছয়মাস কেটে গেলেও কেন্দ্র থেকে কার্যকর কোনো নির্দেশনা এখনও আসেনি। 

মোবাইলফোনেও কেউকে পাওয়া যাচ্ছে না। হামলা-মামলা সব মিলিয়ে নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।’ বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের দায়ী করছেন তৃণমূলের এই নেতা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের মধ্যম সারির এক নেতা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ছয় মাস হয়ে গেল আমরা বাড়ি-ঘরে যেতে পারছি না, পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কবে এলাকায় ফিরতে পারব, তা-ও জানি না। এলাকায় একটা বাজারে আমার দুটো দোকান ও একটা স’মিল আছে, যা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। কিন্তু, সবই দখল হয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে সামনে কীভাবে চলব, কোথায় দাঁড়াব, সেটা নিয়েই চিন্তায় আছি।’ 

ঢাকায় আশ্রয় নেওয়া ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের আরেকজন কর্মী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি, কাজকর্ম করব কী করে? আয় না থাকলে সংসারের কী অবস্থা হয়, তা তো বুঝতেই পারছেন। টাকা-পয়সা যা বাড়িতে রেখে এসেছিলাম, সব ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এখন বাজার করার মতো অবস্থাও নেই। ঘরে ছোট দুটো ছেলে, তারা কী খাবে? মোবাইলফোনে আমার স্ত্রী প্রতিদিন কান্নাকাটি করে। কিন্তু এভাবে কতদিন থাকবে? ভাবতে গেলেই কান্না আসে। মনে হচ্ছে, রাজনীতি করাই পাপ হয়েছে। তাই আর রাজনীতি করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে আরও অনেকেই এমন সিদ্ধান্তের দিকে এগোচ্ছেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের এক নেতা। খুলনা মহানগরের আওয়ামী লগের একজন নেতা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ক্ষমতা হারালে এমন অবস্থা যে হতে পারে, সেটাতো নেতাদের অজানা থাকার কথা না। তারাইতো এ অবস্থার জন্য দায়ী। ক্রিম খাইলো নেতারা, কোটি কোটি টাকা বানাইলো তারা, আর তাদের পাপের শাস্তি ভোগ করতে হইতেছে আমাদের মতো তৃণমূলের নেতাকর্মীদের।’

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের একজন কর্মী বলেন, ‘আগস্টে গা ঢাকা দেওয়ার পর ডিসেম্বরে এলাকায় ফিরেছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় এখন তারা আতঙ্কিত। ফলে আবারও ঘর ছেড়েছেন।’

রাজধানীর মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের একজন কর্মী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের কমিটি আন্দোলনের আগে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। আমরাতো ঝামেলায় ছিলাম না। যেভাবে অভিযান চলতেছে, তাতে বাসায় থাকতে পারতেছি না।’

বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেত্রী সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমার আসলে যাওয়ার জায়গা নেই। আমি কিছুই করি নাই। কারও দুই টাকা খাই নাই, কাউকে মারিও নাই। এটা সবাই জানে। আমি আমার বাসায় আছি, কিন্তু আতঙ্ক আছি।’

আতঙ্ক বিরাজ করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের মধ্যেও। ইতোমধ্যে জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই দেশ ছেড়েছেন। তবে পালানোর সুযোগ না পেয়ে দেশে রয়ে গেছেন যে কাউন্সিলররা, তারা আতঙ্কে আছেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের এক সমর্থক বলেন, ‘আমার কোনো পদ নেই। মারামারিতেও ছিলাম না, কিন্তু আমার নামে মামলা দিয়েছে। কয়েকদিন বাসায় থাকলেও এখন আর পারছি না।’

দলীয় সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রেপ্তার এড়াতে এক জেলার নেতারা আরেক জেলায় অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা ঢাকায় রয়েছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একজন আত্মীয় এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নিজ এলাকা ছেড়ে ঢাকায় অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, এলাকায় ফেরার কোনো উপায় নেই। প্রতিদিনই পুলিশ বাড়িতে হানা দিচ্ছে। এ ছাড়া সম্প্রতি ওবায়দুল কাদেরের এক ভগ্নিপতিকে প্রকাশ্যে মারধর করা হয়েছে। এতে তারা এলাকায় ফেরার সাহস পাচ্ছেন না।

গভীর সংকটে পড়া ঐতিহ্যবাহী দলটির কেন্দ্র থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত পুরো সংগঠন অকেজো হয়ে পড়েছে। প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতা নেই। এমনকি, নেতাদের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনাও পাচ্ছেন না কর্মীরা। এতে ক্ষোভ রয়েছে অনেকের মধ্যে।

বিপর্যয় কাটিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে দেশ-বিদেশে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের মধ্যে গত কয়েক মাসে যোগাযোগের একটি নেটওয়ার্ক তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তারা অন্তত ভার্চুয়ালি সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছেন। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ কয়েকটি ইস্যুতে চলতি মাসে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তবে, এ নিয়ে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।