|
মুহাম্মদ রুহুল আমীন
|
|
পাকিস্তানে সরকারবিরোধী আন্দোলন কি সফল হবে?
03 Sep, 2014
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পতনের দাবিসহ অন্যান্য দাবি নিয়ে পিটিআই ও পিএটি যুগান্তকারী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে সরকারবিরোধী এ কর্মসূচির নানা দুর্বলতার কারণে প্রশ্ন উঠেছে, নওয়াজবিরোধী আন্দোলন আদৌ সফল হবে কি না। এ আন্দোলনের একপর্যায়ে সেনাশাসন অবধারিত হয়ে উঠবে কি না।
প্রথমেই আমরা সংকটের সূচনার ওপর একটু দৃষ্টিপাত করব। গণতন্ত্রায়নের নানা আন্দোলন কর্মসূচির সিঁড়ি বেয়ে গত সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের ক্ষমতায় আরোহণ করে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ। ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে নির্বাচনটিকে শান্তিপূর্ণ হিসেবে প্রচার করে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা হিসেবে নওয়াজ শরিফের প্রধানমন্ত্রিত্বের পথচলা শুরু হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই নির্বাচনের ভোট জালিয়াতি ও কারচুপির অভিযোগ উঠতে থাকে। এ সুযোগ গ্রহণ করেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খান ও পাকিস্তান আওয়ামী তেহরিক (পিএটি) পার্টির নেতা ডক্টর তাহির-উল-কাদরি। কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা নওয়াজ শরিফের সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে সরকারবিরোধী রটনা-সমালোচনা সরকার পতনের আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। পিটিআই ও পিএটি এখন মূলত চারটি দাবিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো হলো- (ক) সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন; (খ) স্বাধীন নির্বাচন কমিশন; (গ) গত নির্বাচনে কারচুপিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিদান; (ঘ) প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পদত্যাগ।
পিটিআই ও পিএটি ১৪ আগস্ট থেকে ওই দাবিগুলো বাস্তবায়নের চাপ সৃষ্টি করে ব্যাপক আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করে আসছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের মূল নেতা ইমরান খান এরই মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তানে সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থান ইসলামাবাদের গুরুত্বপূর্ণ লোহিত এলাকায় (Red Zone) অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে পিএটির শীর্ষ নেতা তাহির-উল-কাদরিও কর্মী বাহিনী নিয়ে যোগদান করেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সাড়া জাগানো এ দুই নেতা ১৯ আগস্ট সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে লোহিত এলাকায় হাজার হাজার নেতা-কর্মী নিয়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়। যেকোনো জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী ও অভিজাত সেনারা প্রস্তুত হয়ে ওঠেন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে রাজনীতিবিদদের প্রতি 'ধৈর্য, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা' সহকারে পরিস্থিতি মোকাবিলার অনুরোধ জানানো হয়। পাকিস্তানের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের ইতিহাসের নিরিখে অনেকে সেনাশাসনের পদধ্বনি শুনতে পায় সেনাবাহিনীর সেই আহ্বানে, সাধারণ মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে সামরিক শাসনের ভয়ংকর ছোবলের অজানা আশঙ্কায়।
পাকিস্তানে সরকারবিরোধী আন্দোলন কি সফল হবে?
আগেই বলেছি, ইমরান খান পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে তরুণসমাজের মধ্যমণি হিসেবে বিকশিত হয়েছেন। গত জুনে পাকিস্তানের সর্বত্র সফর করেছিলাম অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিয়ে। তখন দেখেছি, একটু শান্তির আশায়, গণতন্ত্রের লক্ষ্যে, সুন্দর দেশ গড়ার স্বপ্নে যুবক-যুবতীরা কিভাবে ইমরানের পাশে উপচে পড়ছে! আরেক বিশাল ব্যক্তিত্বের নেতা তাহির-উল-কাদরি। দুই বছর ধরে হঠাৎ করেই যেন পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাহিরের আগমন যেন ধূমকেতুর আগমন। তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি ও তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়ে ক্যারিশমা গড়েছিলেন তাহির-উল-কাদরি। লাখ লাখ লোকের সমাগম ঘটিয়ে তিনি নিজেকে পাকিস্তানের এক ধর্মীয়-রাজনৈতিক নেতার অবিসংবাদিত চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ দুজন হঠাৎ আবির্ভূত অথচ শক্তিমান নেতৃত্বের আহ্বানে এবারকার নওয়াজবিরোধী আন্দোলন সফল হবে, প্রথম দিকে এমন ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনের দুই সপ্তাহ পর স্পষ্ট হচ্ছে এ পথের নানা বাধা-বিপত্তি।
গত নির্বাচনে যে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে সে সম্পর্কে ২৪ আগস্ট এক টিভি সাক্ষাৎকারে নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মুহাম্মদ আফজাল খান স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচনে জনগণের অধিকার চুরি করা হয়েছে। এতে জড়িত ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরী ও তাসাদ্দুক জিলানি। ডন এবং পাকিস্তান ট্রিবিউনের খবরে এমন বক্তব্য ছড়িয়ে পড়লে সরকারবিরোধী আন্দোলন বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। কিন্তু সত্বর এর নানা দুর্বলতাও আন্দোলনের সাফল্য সম্পর্কে সন্দেহের জন্ম দিতে থাকে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক ব্যাখ্যায় ইমরান খানের আন্দোলনের ব্যর্থতার নানা কারণ তুলে ধরা হয়েছে। তিনি প্রথম দিকে বেশ জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে মানুষকে আন্দোলনের চেতনায় উজ্জীবিত করতে সক্ষম হলেও খুব কম লোককে তিনি শেষ পর্যন্ত জমায়েত করতে পেরেছেন। বিশেষত ইমরান খানের বক্তৃতার ভাষা, উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি বিরোধী রাজনীতিবিদসহ তাঁর নিজের দলের অনেকের মধ্যে ঘৃণা ও শত্রুতার জন্ম দিয়েছে। পাকিস্তানের 'দ্য ন্যাশন' পত্রিকায় 'বাড়ি ফিরে যাও ইমরান' শীর্ষক শিরোনাম দিয়ে কলাম ছাপা হয়েছে। অন্য একজন কলামিস্ট ইমরান খানকে 'পাকিস্তানের সারাহ পলিন' হিসেবে ব্যর্থ রাজনীতিক রূপে চিত্রিত করেছেন। পাকিস্তানি সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদদের বিশাল অংশকে ইমরান খান অসন্তুষ্ট ও ক্ষিপ্ত করে তুলেছেন। তিনি নওয়াজ শরিফকে বিদ্রূপ করে এমন সব মন্তব্য করেছেন, যা পাকিস্তান রাজনীতির শিষ্টাচারবহির্ভূত। অধিকন্তু তিনি নিজেকে মহাত্মা গান্ধী ও ইসলামী জেনারেল তারিক বিন জিয়াদের সঙ্গে তুলনা করে হাস্য-কৌতুকের জন্ম দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, সরকারবিরোধী আন্দোলনের কৌশল সম্পর্কে ইমরান খান তেমন স্পষ্ট, যুক্তিপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিতে পারেননি। কেবল বিশৃঙ্খল বক্তৃতা, জনসমাগমের মাঝ দিয়ে পাকিস্তানের মতো একটি দেশের সরকার পতনে যে সক্ষম হওয়া যায় না, তা সম্ভবত অচিরেই ইমরান উপলব্ধি করতে পারবেন।
তৃতীয়ত, পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পাশে থাকবে বলে ঘোষণা করেছে। তা ছাড়া বর্তমান পার্লামেন্টের ১২টি দলের মধ্যে ১১টিই নওয়াজ শরিফের দলের সঙ্গে রয়েছে, যা ইমরান খানের আন্দোলনের বিপক্ষেই স্পষ্ট বার্তা বহন করছে। অধিকন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিটিং করে সর্বাবস্থায় দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় সরকারকে সহায়তা করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। ২৬ আগস্ট এক বিবৃতিতে দেশের সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ ও নওয়াজ শরিফের বৈঠকের কথা তুলে ধরা হয় বলে 'দ্য ডন' প্রকাশিত এক খবরে তথ্য দিয়েছে।
চতুর্থত, পাকিস্তানের বর্তমান ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি আরো ধাক্কা খাবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। এরই মধ্যে আইএমএফ পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অজুহাতে পাকিস্তান সফর বাতিল করেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পাকিস্তানে বিনিয়োগ করার উৎসাহও হারাচ্ছেন। এমতাবস্থায় দেশটির ব্যবসায়ীকুল কোনোভাবেই ইমরান খান ও তাহির-উল-কাদরির আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতো মানসিকতা তৈরি করতে পারবে বলে অনুমিত হয় না। সর্বোপরি, বর্তমান বিশ্বের একক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সরকারকে স্পষ্ট সমর্থন জানিয়েছে।
ওয়াশিংটন কোনো অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন সমর্থন করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। সংবিধান ও গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তানে 'শান্তিপূর্ণ' ও 'গ্রহণযোগ্য' নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়েছে, যা অসাংবিধানিকভাবে নস্যাৎ করা যায় না।
পাকিস্তানে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনের পথে ওপরের অন্তরায়গুলো সত্ত্বেও সরকারবিরোধীরা সফল হতে পারে, যদি তাদের অভ্যন্তরীণ ঐক্য অটুট থাকে। ইসলামাবাদের 'লোহিত এলাকায়' প্রবেশ করার স্পর্ধা থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের যে শাণিত চেতনা সৃজিত হয়েছে, তা সফলতার স্বার্থোদ্ধারে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায় হলো আন্দোলনকারীদের অভ্যন্তরীণ ঐক্য এবং এক ও একক গন্তব্য। দুর্ভাগ্যবশত ইমরান খানের নিজ দলের মধ্যেই বেশ অনৈক্য লক্ষ করা যাচ্ছে। সেই অংশটির মতে, ইমরান খান বেশ বড় একটি ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছেন। পিএটি ছাড়া অন্য কোনো দল ইমরানের সঙ্গে নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পিটিআই নেতা ডনকে বলেছেন, 'আমরা যদি পার্লামেন্টের ভেতর ও বাইরের সবাইকে শত্রু বানিয়ে ফেলি, তাহলে প্রয়োজনের সময় রাজনৈতিক মিত্র কোথায় পাব?'
এমনই এক কণ্টকাকীর্ণ পথে ইমরান খান ও তাহির-উল-কাদরি পাকিস্তানের সরকারবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। ঘটনাটি পাকিস্তানের রাজনীতিতে যুগান্তকারী মোড় সৃষ্টিতে অবদান রাখবে- এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বিশেষত, পাকিস্তান সরকার যদি দমননীতি গ্রহণ করে এবং লোহিত এলাকায় অবস্থানরত বিরোধী নেতা-কর্মীদের ওপর আক্রমণ চালায়, তাহলে হয়তো 'রেড জোনের' এ অবস্থানই ইমরান খান ও তাহির-উল-কাদরির পিটিআই ও পিএটিকে পাকিস্তানের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপিত করবে। এবারকার আন্দোলনে বিরোধীরা ব্যর্থ হলেও পাকিস্তানের গণতন্ত্রায়নের ইতিহাসে তা একটি 'শিক্ষা' হিসেবে লিখিত থাকবে। ভবিষ্যতের কোনো নির্বাচনে হয়তো কোনো পক্ষ 'ভোট জালিয়াতির' মতো গণতন্ত্রবিধ্বংসী পথে পা বাড়াবে না। সেদিক বিবেচনা করলে ইমরান খান ও তাহির-উল-কাদরির নাম পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ইতিহাসে অন্যতম মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত থাকবে দীর্ঘকাল ধরে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন