বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে আমার সরাসরি তেমন একটা পরিচয় নেই। সামনাসামনি দেখা হয়েছে মাত্র দুবার। একবার বহু আগে মরহুম কর্নেল আকবর হোসেনের কার্যালয়ে এবং দ্বিতীয়বার তা-ও বেশ কিছুদিন আগে কাদেরিয়া বাহিনীর তার এক শিষ্য মরহুম আশরাফ গিরানীর স্মরণসভায়। সেখানে সামান্য কথাও হয়েছিল। ব্যস, ওই পর্যন্তই। কিন্তু তার প্রতি আমার ভালো লাগার অনুভূতি অনেক আগের। না দেখেই দূর থেকে ভালো লেগে যাওয়া দুই বীর পুরুষের একজন তিনি। অপরজন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, যার সেই ঐন্দ্রজালিক কণ্ঠস্বর এখনো আমার কানে বাজে- 'আমি মেজর জিয়া বলছি'...। বঙ্গবীর যে রাজনীতি এক সময় করতেন, কখনো সে রাজনীতির সঙ্গে ছিলাম না; কিন্তু তার সাহস ও বীরত্বে আমি মুগ্ধ ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে তার কাদেরিয়া বাহিনীর বীরত্বগাথা ইতিহাসের অন্তর্গত হয়েছে। দল-মত-নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে দেশমাতৃকার মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার তার অসাধারণ গুণ ও হৃদয়ের বিশালতার নানা কাহিনী এক সময় শুনেছি ভিন্নমতাবলম্বী বাম রাজনীতির অনুসারী কবি বুলবুল খান মাহবুব ও আশরাফ গিরানীর কাছে। তারা দুজনই ছিলেন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটির সঙ্গে যুক্ত এবং তাদের রাজনৈতিক গুরু ছিলেন কাজী জাফর আহমেদ। আমাদের এলাকা কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নন-আওয়ামী লীগার মুক্তিযোদ্ধাদের আওয়ামী লীগ যেভাবে জ্বালিয়েছে কাদের সিদ্দিকী তা করেননি। তার কাছে 'কজ' (cause) এবং 'কজ'-এর প্রতি আনুগত্যটাই ছিল বড়। তাই তিনি তার বাহিনীতে সব মতের যোদ্ধাদের একোমোডেট করতে পেরেছিলেন। এটা দুর্লভ এক রাজনৈতিক এবং নেতৃত্ব গুণ। দ্বিতীয়ত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের জাঁদরেল জাঁদরেল নেতারা যখন নীতি-আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের কথা ভুলে মুজিবকোট বাদ দিলেন এবং আসকান-শেরওয়ানি গায়ে চাপিয়ে মোশতাক মন্ত্রিসভাকে 'আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা' হিসেবে আলোকিত করলেন; কেউবা জান বাঁচানোর জন্য 'ইঁদুরের গর্তে' ঢুকলেন, তখন এক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীই সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সহযোদ্ধাদের নিয়ে দ্রোহের পতাকা উড়িয়ে দিলেন। তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী তা বিবেচনা না করেই তার পিতৃতুল্য নেতার প্রতি নিখাদ ভালোবাসা ও আনুগত্য দেখে আমি অভিভূত হয়েছি। আমার ধারণা ছিল, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগে তিনি বীরের মর্যাদাই পাবেন। শেখ হাসিনা তার মূল্য দেবেন। কিন্তু তিনি সেই মূল্য পাননি। গত ১৯ আগস্ট বাংলাদেশ প্রতিদিনে তার এক লেখায় সেই অন্তজ্বালার প্রকাশ দেখেছি। কিন্তু তাতে ক্ষুব্ধ কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল না। তবে একাত্তর টিভি চ্যানেলে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে জাসদ গণবাহিনীর নেতা মইনুদ্দিন খান বাদলের ভূমিকার প্রশংসা করে অনুষ্ঠানের সঞ্চালিকার সমালোচনা করে যে প্রকৃত সত্য তিনি তুলে ধরেছেন তা যথার্থ বলেই মনে করি। প্রসঙ্গক্রমে তাকে ধন্যবাদ জানাই, সেদিনের প্রকৃত প্রতিবাদী আরেক পুরুষ আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুব নেতা এস এম ইউসুফের প্রশংসিত ভূমিকা উল্লেখ করায়। এর একটা কারণ আছে। ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনের সময় ইউসুফ ভাই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আর আমি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে (আমাদের সংগঠনের সভাপতি আবদুল্লাহ-আল নোমান তখন কারারুদ্ধ) তার সঙ্গে আমার একটা আবেগের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুজনের কেউ-ই এখন সক্রিয় রাজনীতিতে নেই (দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারিনি বলে হয়তো), তবে আমাদের সম্পর্ক ও ব্যক্তিগত যোগাযোগে এখনো ভাটা পড়েনি। বঙ্গবীরের মুখে-কলমে তার স্বীকৃতিটা ভালো লাগল। মইনুদ্দিন খান বাদলের ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য(!) খুবই প্রয়োজনীয় শুধু নয়, 'অপরিহার্য' মিত্রশক্তি ইনু জাসদের হাসানুল হক ইনুর কথা এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে জাসদ গণবাহিনীর সামরিক কমান্ডার কর্নেল (অব.) তাহেরের কথাও যৎকিঞ্চিৎ উল্লেখ করেছেন তিনি। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ১৯ আগস্ট বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত তার ক্রন্দসী 'দীর্ঘশ্বাসনামায়' উল্লেখ করেছেন- এই কর্নেল (অব.) তাহের বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনের সমালোচনা করে বলেছিলেন, তার লাশ সাগরে ফেলে দেওয়া উচিত ছিল। ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার যে অভ্যুত্থানের গর্ভে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের দর্শনের বিপরীতে প্রবল স্রোতের আরেক রাজনৈতিক ধারা ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিকল্প দর্শনের আকর্ষণীয় উন্মেষ ঘটেছিল, সেদিন সামরিক বাহিনীর ট্যাঙ্কের ওপর লীগ সরকারের বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর একটি ছবিও লেখার সঙ্গে ছাপানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মইনুদ্দিন খান বাদল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছেন এ কথা শোনার পর যারা তাদের তখনকার ভূমিকার কথা জানেন তারা হেসেছেন; কিন্তু কাদের সিদ্দিকীর তো তাতে কষ্ট লাগারই কথা। তাই তার কিছু কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। মইনুদ্দিন খান বাদল নিজেই অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'আমরা সরকারের বিরুদ্ধে একটা সময় সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলাম।' বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, 'উপস্থাপিকা হয়তো বুঝতে পারেননি যে, তারা যে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন সে সরকার ছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার। তারা বঙ্গবন্ধু সরকারের উৎখাত চেয়েছেন, নেতা-এমপিদের হত্যা করেছেন। সেই বঙ্গবন্ধুর সরকার উৎখাত হলে তারা তার প্রতিবাদ করেন কী করে? তাদের তো খুশি হওয়ার কথা। ... তখন খুনি ফারুক, রশীদ, ডালিমের চেয়ে বরং জাসদের গণবাহিনীকে আওয়ামী লীগের লোকেরা বেশি ভয় করত। বগুড়ার খসরু সরাসরি খুনিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবন দিয়ে প্রতিবাদী হলো না, চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ হলো না, প্রতিবাদী হলো হত্যাকারীরা- ভাবতেই যেন কেমন লাগে। মেয়র মহিউদ্দিনের কী হবে, কী হবে যুবলীগ নেতা এস এম ইউসুফ, এনামুল হক দানুসহ অন্যদের? এমন ইতিহাস বিকৃতি আর দেখিনি বা শুনিনি।' বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর এ এক নিঃশব্দ কান্না। বঙ্গবীর সিদ্দিকী তার বুকের ভিতর থেকে গুমরে ওঠা এই বোবা কান্নার শব্দ কাকে শোনাতে চান তার বিনীত প্রার্থনায় তা অনুমান করা যায়। তার লেখাটা একাধিকবার পড়ে মনে হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভাইবোনের সম্পর্কের তারটা তিনি এখনো রক্ষা করে চলেছেন নিজের দিক থেকে। বোনের বিপদ দেখলে কোনো ভাইয়ের অন্তরাত্দা কেঁদে না ওঠে! তাই হয়তো কাদের সিদ্দিকীর মুখে এমন সত্য পাঠ।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতার বাইরে থাকলে দলীয়ভাবে, ক্ষমতায় থাকলে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালন করে আওয়ামী লীগ। এবারই প্রথম স্পষ্ট ও সরাসরিভাবে দুটি বিষয় সামনে চলে এসেছে। ১. অন্য সময় অন্যরা বললেও এবারই প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জিয়া জড়িত। এমনও প্রচার করা হয়েছে যে, মামলা হওয়ার আগেই প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হওয়ায় তাকে মামলায় আসামি করা হয়নি। ২. বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে ক্ষমতাসীন সরকারের অন্যতম পার্টনার জাসদ, গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, একই সঙ্গে কর্নেল (অব.) তাহের ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর ভূমিকা।
জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। শোনা যায়, 'উনি বলেছেন, তিনি তার কাছে বলেছেন, অমুক তমুকের কাছ থেকে শুনেছেন' ইত্যাকার কথাবার্তা। এবার নতুন করে বলা হয়েছে, প্রমাণ নাকি আছে। কিন্তু প্রমাণ দেওয়া হচ্ছে না- না দল থেকে, না সরকার থেকে। অনেকে মনে করেন, এই অভিযোগের পেছনে আছে স্রেফ হিংসাশ্রয়ী রাজনীতি। জিয়াউর রহমানকে ডিফেইম করে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত করাই এর উদ্দেশ্য। লীগ সরকার বা শাসকলীগের লোকজন কী কখনো ভেবে দেখেছেন এতে তারা কী লাভবান হচ্ছে? জনগণ কী প্রমাণহীন কোনো 'মিথ' বিশ্বাস করছে? বরং এই মর্মর্ন্তুদ ও স্পর্শকাতর ইস্যুতে সরকারের ক্ষমতার অংশীদার সরকারি জাসদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ নতুন প্রজন্ম পরখ করছে এবং এ ব্যাপারে সরকারের রহস্যময় নীরবতায় বিস্ময় প্রকাশ করছে। জাসদের ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে প্রথম প্রশ্ন উত্থাপন করেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমানে এরশাদ জাপার এমপি কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনিও জাসদ গণবাহিনী কর্তৃক লীগ নেতাদের হত্যার অভিযোগ করে বলেছেন, তারা সেদিন ওই ভূমিকা পালন না করলে খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাহস পেত না। সেদিন সরকারি জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু সংসদে ছিলেন। কিন্তু কোনো কথা বলেননি। বলেছিলেন তাদের কার্যকরী সভাপতি মইনুদ্দিন খান বাদল। অভিযোগ খণ্ডন করতে পারেননি তিনি। বলেছেন, 'সরকারের একটি শরিক দলকে মহানন্দে জবাই করা হচ্ছে'। তাই বলে কী সত্য গোপন রাখতে হবে? এ ব্যাপারে বড় বোমাটি ফাটিয়েছেন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায়। তার '৭ নভেম্বরের সাত-সতেরো' শিরোনামে প্রকাশিত লেখা দেশ-বিদেশে ঝড় তুলেছে। তাতে বেরিয়ে এসেছে অনেক অজানা কাহিনী। সরকারি জাসদের নেতা-নেত্রীদের কথা-বার্তায় কারও কারও কাছে মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর শোকে তারা আওয়ামী লীগারদের চেয়েও বেশি কাতর। প্রধানমন্ত্রী কত পুরস্কার দিলেন তাদের। কর্নেল তাহেরের এক ভাইকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বানানো হয়েছে। আরেক ভাই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে পুরস্কৃত করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বানিয়ে। মহিউদ্দিন আহমেদের লেখায় বেরিয়ে এসেছে তিনি 'বোমারু আনোয়ার'। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি 'নিখিল' বোমা ফাটানোর ব্যবস্থা করেছিলেন পরদিন ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কর্মসূচি পণ্ড করে দেওয়ার জন্য। আনোয়ার হোসেন ছিলেন ঢাকা নগর গণবাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জাসদের এই অংশটির জড়িত থাকার বিষয়টি সামনে চলে আসায় এখন পর্যবেক্ষকরা বলছেন যে, 'উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে' চাপানোর সুযোগ থাকছে না।
লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, "১৫ আগস্ট সকালে মুহসীন হলের ছাত্র নূর মোহাম্মদ ঢাকা নগর গণবাহিনীর উপপ্রধান আবুল হাসিব খানের কাছে ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেনের একটা চিরকুট নিয়ে আসেন। চিরকুটে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদের অফিসে ঢাকা নগর গণবাহিনীর জরুরি সভা হবে বলে উল্লেখ ছিল। সভা শুরু হলে আনোয়ার হোসেন উপস্থিত সবাইকে বলেন, 'ভাইজান (লে. কর্নেল আবু তাহের) সকালে রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলেন। তিনি মেজর ডালিমকে বকাঝকা করে বলেছেন, '... এর মেজর হয়েছ, এখন পর্যর্ন্ত একটা মার্শাল ল' প্রক্লেমেশন ড্রাফট করতে পারলে না। জানো কাল ইউনিভার্সিটিতে কারা বোমা ফাটিয়েছিল? দে আর মাই বয়েজ।'
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের মেজর রশীদের অনুরোধে সকাল ৯টায় ঢাকা বেতারকেন্দ্রে যান। সেখানে তিনি খোন্দকার মোশতাক আহমদ, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, মেজর ডালিম ও মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে দেখতে পান। তার পরামর্শে ডালিমরা সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধানকে বেতার ভবনে নিয়ে আসেন অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে বিবৃতি দেওয়ার জন্য। তিনি খোন্দকার মোশতাককে পাঁচটি প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবগুলো ছিল- ১. অবিলম্বে সংবিধান বাতিল করতে হবে; ২. সারা দেশে সামরিক আইন জারি এবং এর প্রয়োগ করতে হবে; ৩. দল-নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে; ৪. বাকশালকে বাদ দিয়ে একটি সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে; ৫. অবিলম্বে একটি গণপরিষদ তথা পার্লামেন্টের জন্য সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
সামরিক শাসন জারির দাবি ছিল তাহেরের একান্ত নিজস্ব। এ বিষয়ে তিনি গণবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ড কিংবা জাসদের পার্টি ফোরামের সঙ্গে আলোচনা করেননি এবং এসব প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য পার্টি তাকে কোনো ম্যান্ডেট দেয়নি।"
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কর্নেল তাহেরের ঘৃণার মনোভাব প্রকাশ করে নিবন্ধের লেখক উল্লেখ করেছেন, '... দুই দিন পর ১৭ আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নঈম জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় যান পরিস্থিতি সম্পর্কে অাঁচ করতে। ১৯৭১ সালে নঈম ১১ নম্বর সেক্টরে তাহেরের সহযোদ্ধা ছিলেন এবং প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন। তাহের আক্ষেপ করে নঈমকে বললেন, 'ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া। কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই মো. আনোয়ার হোসেনের (অধ্যাপক) তৎকালীন ভূমিকা সম্পর্কেও লেখায় উল্লেখ আছে। তাতে বলা হয়, 'পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন- এ রকম একটি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। ... বিপ্লবী গণবাহিনী ঢাকা নগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা তৎপর হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আগমন উপলক্ষে একটি শক্তির মহড়া দেওয়ার চিন্তা করা হয়। ... চুয়াত্তরের নভেম্বরে বোমা বানাতে গিয়ে তরুণ জাসদ নেতা ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রপ্রকৌশল বিভাগের লেকচারার নিখিল রঞ্জন সাহা নিহত হন। তার নামে এই বোমার নামকরণ হয় 'নিখিল'। নিখিলের প্রস্তুত প্রণালী ছিল স্থূল। ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন 'নিখিল' ইমপ্রুভাইজ করেন। আনোয়ার হলেন গণবাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার লে. কর্নেল (অব.) তাহেরের ছোট ভাই। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের লেকচারার হিসেবে কর্মরত। রসায়ন তিনি ভালো বোঝেন। তার বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্সেলরের আগমন যাতে নির্বিঘ্ন না হয় সে জন্য তার নির্দেশে গণবাহিনীর সদস্যরা ১৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তিনটি 'নিখিল' ফোটায় (মহিউদ্দিন আহমেদের 'তাজউদ্দীন খুনিদের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন', প্রথম আলো, ১২ আগস্ট ২০১৪)।
উল্লিখিত দৈনিকের ঈদ সংখ্যা বেরিয়েছে জুলাইর প্রথমে- প্রায় দেড় মাস আগে। দ্বিতীয় লেখাটিও ছাপা হয়েছে নয় দিন আগে। লেখার বিষয় মিথ্যা হলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানোর কথা। জাসদ (ইনু) দলীয়ভাবে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি। ২১ আগস্ট মো. আনোয়ার হোসেন (অধ্যাপক) 'তাহেরকে নিয়ে কেন মিথ্যাচার' নামে একটি লেখা প্রকাশ করেছেন। তাতে তিনি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যা বলেছেন এবং মহিউদ্দিন আহমেদ যা লিখেছেন সে সব বক্তব্য খণ্ডন করার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু তার যুক্তি এত দুর্বল যে, বক্তব্য খণ্ডন তো হয়ইনি বরং তাদের প্রতি অবিশ্বাস সন্দেহ আরও গভীর হয়েছে।
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের আতঙ্কটা ফুটে উঠেছে তার লেখার শেষ বাক্যে। তাতে তিনি লিখেছেন, 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে এমন শক্তি, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও জাসদ যে আজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তাকে ভেঙে ফেলা এবং জিয়াউর রহমানকে মহিমান্বিত করার এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মহিউদ্দিনের এই প্রকল্প ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, সময়ই তা বলে দেবে।' কিন্তু কোথায়? মহিউদ্দিন আহমেদের প্রকাশিত লেখায় কোথাও তো জিয়ার প্রশস্তি নেই। এমন কি তিনি বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তেমন কোনো কথাও তো নেই। এমন কি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তার লেখায় যে সত্যের ছবি অাঁকলেন তাতেও তো জিয়া বন্দনা নেই। তাহলে এসব জিয়াউর রহমানকে মহিমান্বিত করার প্রকল্প হয় কী করে? জিয়া তো স্বমহিমায় এতটাই উজ্জ্বল যে, ফরমায়েশ দিয়ে নতুন কোনো ইতিহাস প্রকল্প তৈরির প্রয়োজন নেই। মুক্তিযোদ্ধা ও একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে কর্নেল (অব.) তাহেরকে জাতি বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে। কিন্তু বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতির পরিমণ্ডলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি টিকে আছে এবং চলছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি ও মহিমাকে পুঁজি করে। এখানে কর্নেল তাহেরের নামগন্ধও নেই।
শেষে একটা কথা উল্লেখ করার তাগিদ অনুভব করছি। মহিউদ্দিন আহমেদের লেখায় একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, কর্নেল (অব.) তাহের এবং তার লোকজনের চিন্তাভাবনা ও অ্যাকশনের সঙ্গে জাসদের পার্টি ফোরাম ও গণবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ড সব সময় একমত ছিল না। যেমন মোশতাকের কাছে সামরিক শাসন জারির দাবি ছিল তাহেরের নিজস্ব। জিয়াউর রহমানকে সামনে রেখে অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রস্তাবেও সায় ছিল না আখলাকুর রহমানসহ কারও কারও। লেখায় তাহের-ইনু একপক্ষে ছিলেন বলে ধারণা করার সুযোগ আছে। অনেকের মতে, জাসদের এই গ্রুপটি পঁচাত্তরে সাপ হয়ে দংশন করে এখন ওঝা হয়ে ঝাড়ছে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন