Image description
বঞ্চিতদের ক্ষোভ ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতির দাবি

সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও দীর্ঘদিন পদোন্নতি পাচ্ছেন না শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষক পদের ১৬ হাজার কর্মকর্তা। বিলম্বিত পদোন্নতির এই জটিলতার কারণে কর্মস্পৃহা হারাচ্ছেন অপেক্ষাকৃত তরুণ ও উদ্যোমী এই শিক্ষকরা। যদিও সম্ভাবনার এই বাংলাদেশের নতুন দ্বার উন্মোচনে শিক্ষা সেক্টরকে পেছনে রেখে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। বর্তমান বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, অন্যান্য ক্যাডারের সাথে শিক্ষা ক্যাডারের এই কর্মকর্তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিশাল বৈষম্য। ফলে শিক্ষা দেশের বৃহৎ ক্যাডার হওয়া সত্ত্বেও সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তলানিতে রয়েছেন তারা। বাস্তবিক অর্থেই কর্মক্ষেত্রেও তারা অন্য ক্যাডারের তুলনায় দিনকে দিন পিছিয়ে পড়ছেন।

অবশ্য সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ইতোমধ্যে শিক্ষা ক্যাডারে প্রভাষকদের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত ২০ এপ্রিল থেকে দফায় দফায় বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) সভা হয়েছে। একপর্যায়ে প্রভাষকদের এসিআর নিয়ে আপত্তি তোলা হলে গত বৃহস্পতিবার আবারো সভা করেছেন কমিটির সভাপতি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের। বিষয়টি জানাজানির পর এই ক্যাডারের পদোন্নতি প্রত্যাশীদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ টায়ারে সহকারী অধ্যাপক পদে কতজন পদোন্নতি পাবেন তা নিয়ে আলোচনা ও দেনদরবার চলছে। বিগত পদোন্নতিতে বঞ্চিত অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকদেরও এই ধাপে পদোন্নতি দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে এ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) মজিবর রহমান জানিয়েছেন, আগের ডিপিসিতে বঞ্চিত অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকদের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। তাদের পদোন্নতি হলে নিচের কিছু পদ (সহকারী অধ্যাপক) খালি হবে এবং প্রভাষকদের পদোন্নতি প্রক্রিয়া আরো সহজ হবে।

এদিকে পদোন্নতিবঞ্চিত শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১৩ সালে চাকরিতে যোগদান করে শিক্ষা ক্যাডারের ৩২তম ব্যাচের কর্মকর্তারা এখনো নবম গ্রেডেই পড়ে আছেন। এই ব্যাচের ভূগোল বিষয়ের একজন শিক্ষক (বর্তমানে গবেষণা কর্মকর্তা, মাউশি) নয়া দিগন্তকে জানান, চাকরির বয়স সাড়ে ১১ বছর পার হয়েছে, কিন্তু এখনো একটি পদোন্নতিও পায়নি তার ব্যাচের কোনো কর্মকর্তা। এই ব্যাচের আরেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০১৩ সালে চাকরিতে যোগ দিয়ে তাদের ব্যাচের ৫৪জন এখনো পদোন্নতি পাননি শুধু বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতির কারণে। এখনো তিনি প্রভাষক পদে ৯ম গ্রেডে কর্মরত রয়েছেন। একই ব্যাচে এরকম আরো ৫৪জন প্রভাষক রয়েছেন। অথচ একই সময়ে প্রশাসনে ৩২-৩৭তম ব্যাচ দুই ধাপে পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে ষষ্ঠ গ্রেডে উন্নীত হয়েছে। শিক্ষা ক্যাডারের ৩৩, ৩৪ ও ৩৫তম ব্যাচেরও বহু কর্মকর্তা (যথাক্রমে ৩৬১, ৬৩১ ও ৭৪০ জন) দীর্ঘ সময় ধরে পদোন্নতির অপেক্ষায় রয়েছেন। এমনকি ৩৬ ও ৩৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারাও ৭ ও ৬ বছর চাকরি করেও পদোন্নতি পাননি। বিসিএস নিয়োগ বিধিমালা ১৯৮১ অনুযায়ী সহকারী অধ্যাপকের পদ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ হওয়ার কথা। প্রভাষকদের পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা, চাকরি স্থায়ীকরণ, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং সন্তোষজনক চাকরিজীবন বাধ্যতামূলক হলেও, এসব শর্ত পূরণের পরও দীর্ঘকাল ধরে এই ব্যাচগুলো পদোন্নতি বঞ্চিত। শিক্ষাখাত সংশ্লিষ্টরা যাকে আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের বিরল দৃষ্টান্ত বলে মনে করছেন।

অন্য দিকে মাউশির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চিত (৩২ ব্যাচ থেকে ৩৪ ব্যাচ) কর্মকর্তারা ষষ্ঠ গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন। আর ৩৫তম ব্যাচ আগামী জুলাই থেকে এই (ষষ্ঠ গ্রেড) গ্রেডে বেতন পাবেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডিপিসি সভার কার্যপত্র অনুযায়ী, শিক্ষা ক্যাডারে প্রায় ১৬ হাজার পদের মধ্যে সাড়ে ১৩ হাজার কর্মকর্তা কর্মরত। সহকারী অধ্যাপকের ৪৩৮৯টি পদের বিপরীতে মূল পদে আছেন ২৭৭৯ জন এবং ইনসিটু পদে ১২৫১ জন। বিষয়ভিত্তিক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে মোট ১১২৬টি শূন্যপদ রয়েছে। এ ছাড়াও সৃষ্ট পদের ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৪৩৯টি পদ রিজার্ভ রাখা হয়েছে। আত্তীকৃত কলেজগুলোতে আরো ১০৩০টি শূন্যপদ বিদ্যমান। সব মিলিয়ে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য মোট ২১০২ জন কর্মকর্তার নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ জন প্রভাষককে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির বিবেচনায় রাখা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি কোন পর্যায়ে দাঁড়ায় তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত রয়েছেন ডিপিসির সভাপতি।

সূত্রমতে, বিগত সময় পদোন্নতি বঞ্চনাসহ শিক্ষা ক্যাডারের নানা ইস্যুতে সোচ্চার থাকত বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। এবার পদোন্নতি নিয়ে সমিতির নিষ্ক্রিয়তায় ক্যাডারের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সাবেক মহাসচিব মো: শওকত হোসেন জানান, শিক্ষা ক্যাডারে ৩২ থেকে ৩৭তম বিসিএস পর্যন্ত পদোন্নতির দীর্ঘসূত্রতা দূর করা জরুরি। অন্য ক্যাডারে যেখানে সমব্যাচের কর্মকর্তারা দুইটা পদোন্নতি পেয়েছেন সেখানে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা ১০-১২ বছর প্রবেশ পদে রয়েছেন, এটি চরম বৈষম্যমূলক। পদোন্নতিযোগ্য সবার ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি দিতে সরকারের কাছে আহ্বান জানান তিনি।

এ বিষয়ে শিক্ষা ক্যাডারের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, শিক্ষা ক্যাডারে বিদ্যমান পদোন্নতির জট ও জটিলতা নিরসনে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে নতুন পদ সৃষ্টি করা খুবই জরুরি। যেখানে প্রশাসন ও পুলিশে পদ ছাড়াই পদোন্নতি হয়, সেখানে এই ক্যাডারের জন্য এই প্রচলন কেনো হয় না। প্রয়োজনে সুপার নিউমারারি পদ্ধতিতে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হোক। অন্যথায় সঙ্কট আরো বাড়বে। ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি দিলে এই ক্যাডারের বিদ্যমান সঙ্কট কিছুটা কমবে বলে মনে করেন তারা। জানা গেছে, ২০১৮ সালের পর থেকে শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতিতে ব্যাপক ‘শ্লথগতি’ তৈরি হয়েছে।