Image description
মেঘনা ও সোনারগাঁ

কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলার মেঘনা নদীবেষ্টিত ইউনিয়ন চালিভাঙ্গা। এ ইউনিয়নের চালিভাঙ্গা, নলচর, বড়ইয়াকান্দি মৈশারচর গ্রামে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌযান। মেঘনা নদীর বুক চিরে জেগে ওঠা চরে অবস্থিত এ গ্রাম চারটির বাসিন্দারা যেন সাক্ষাৎ যম। তারা ভয়ানক বেপরোয়া। তাদের মুখের চেয়ে টেঁটা, বল্লম আর দেশীয় অস্ত্র চলে আগে। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় সেখানে শিক্ষার আলো সেভাবে পৌঁছায়নি। এই চার গ্রামের বাসিন্দাদের প্রধান পেশা ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই এবং নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলা। মেঘনা নদী দিয়ে যে কোনো ধরনের নৌযান চলতে হলে এ গ্রামের বাসিন্দাদের দিতে হয় নির্দিষ্ট পরিমাণে চাঁদা। সার্বক্ষণিক তিনটি স্পটে স্পিডবোট নিয়ে এসব চাঁদা উত্তোলনে ওত পেতে থাকে শতাধিক ডাকাত সদস্য। কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে করা হয় মারধর। ছিনিয়ে নেওয়া হয় মোবাইল, টাকা-পয়সাসহ মূল্যবান সামগ্রী। এখানে মালবাহী নৌযানে ডাকাতি নিত্যদিনের ঘটনা। নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকলেও তারা জানায় নিজেদের অসহায়ত্বের কথা। ডাকাত ধাওয়া করে একাধিকবার গ্রামবাসীর টেঁটার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

জানা যায়, চালিভাঙ্গা ইউনিয়নের সাতটি গ্রামের মধ্যে চারটি গ্রাম পুরোপুরি সমতল থেকে বিচ্ছিন্ন বদ্বীপ অঞ্চল। এ চারটি গ্রামে প্রায় ৮ হাজার মানুষের বসবাস।

ইউনিয়ন পরিষদের সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এখানকার শিক্ষার হার ৫০ শতাংশের ঘরে। মেঘনা নদীর চরের বাসিন্দাদের পার্শ্ববর্তী মেঘনা কিংবা সোনারগাঁয়ে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌযান। গ্রামের ভেতরে আধাপাকা ও কাঁচা রাস্তা রয়েছে চলাচলের জন্য। নদীর তীরে বেড়ে ওঠা এ চার গ্রামের মানুষ ভয়ানক দুর্ধর্ষ। চুন থেকে পান খসলেই টেঁটা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে একপক্ষ অন্য পক্ষকে আক্রমণ করে। হত্যা, খুনোখুনি এ গ্রামের বাসিন্দাদের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। পার্শ্ববর্তী মেঘনা, আড়াইহাজার, গজারিয়া ও সোনারগাঁও থানার মোহনা। এ গ্রামের আশপাশে নৌপুলিশের ৩টি ফাঁড়ি রয়েছে। এগুলো হলো বৈদ্যের বাজার নৌপুলিশ ফাঁড়ি, চালিভাঙ্গা নৌপুলিশ ফাঁড়ি ও খাককান্দা নৌপুলিশ ফাঁড়ি। তবে এসব পুলিশ ফাঁড়ির কর্মকর্তারা নিজেরাই নিজেদের অসহায়ত্বের কথা জানান কালবেলাকে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট। কোনো অপরাধ হলে নিজেদের সীমানা নয় বলে দায় এড়ানোর একটা প্রবণতা রয়েছে তাদের মধ্যে।

তিন স্পটে সক্রিয় অর্ধশতাধিক ডাকাত: গত ১৬ এপ্রিল থেকে টানা তিন দিন চালিভাঙ্গা ইউনিয়নের চরে পড়া চার গ্রাম, মেঘনা নদী ও পার্শ্ববর্তী সোনারগাঁওয়ের বৈদ্যের বাজার এলাকা ঘুরে নিয়মিত ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের তিনটি হটস্পট পাওয়া যায়। স্থানগুলো মেঘনা নদীর নলচর গ্রামের মুখ। নদীর এ অংশটির ওপারে চালিভাঙ্গা ইউনিয়নের নলচর গ্রাম ও অন্য পাশে সোনারগাঁওয়ের বৈদ্যের বাজার। আর দুটি হলো মৈশাচর গ্রামের মুখ বা নুনারটেক এবং মেঘনা ব্রিজ সংলগ্ন একটি শিল্পগোষ্ঠীর চিনির মিল সংলগ্ন অংশে। এসব স্থানে ভোর ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত দিনভর প্রতিটি নৌযানে চলে চাঁদাবাজি। তিনটি স্পটে চাঁদাবাজি হওয়ায় এখানকার চাঁদাবাজদের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটি নৌযানও যেতে পারে না। তিনটি স্পটের কোনোটিতে পুলিশের টহল থাকলে, সেগুলো এড়িয়ে বাকি দুটি স্পটে চলে চাঁদা আদায়। স্পিডবোট নিয়ে একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন নৌযান থেকে চাঁদা আদায় করে ডাকাত দলের সদস্যরা। প্রতিটি বোটে ৩ থেকে ৬ জন করে সশস্ত্র সদস্য থাকে। কেউ তাদের দাবি করা অর্থ দিতে না চাইলে করা হয় মারধর। প্রতিটি নৌযান থেকে ১ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। প্রতিদিন এ নদী দিয়ে ছোট-বড় প্রায় ১ হাজারের ওপরে নৌযান চলাচল করে। দিনের চাঁদাবাজি শেষে রাতে শুরু হয় ডাকাতি। মেঘনার এ অংশ দিয়ে সবচেয়ে বেশি চলাচল করে সিলেটের নৌযান। এসব নৌযানে ডাকাতি, ছিনতাই, লুটপাট নিত্যদিনের ঘটনা।

সরেজমিন মেঘনা : ১৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৮টা। বৈদ্যের বাজার থেকে একটি ট্রলার নিয়ে সরেজমিন মেঘনা নদীতে যাই আমরা। সেখানে দেখা যায়, স্পিডবোট নিয়ে একটি বাল্কহেড থেকে অভিনব কৌশলে চাঁদা আদায় করছে দুই যুবক (ভিডিও সংরক্ষিত)। চাঁদা নিয়ে তারা এক নৌযান থেকে আবার অন্য নৌযানে যাচ্ছে। পাশেই দেখা যায় নৌপুলিশের একজন সদস্য স্পিডবোট নিয়ে টহল দিচ্ছেন। চাঁদাবাজদের দিকে না গিয়ে তারা আমাদের ট্রলারের দিকে এগিয়ে আসেন। পরে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে পুলিশ সদস্যরা চলে যান। এর মিনিট দুয়েকের মধ্যে ডাকাত সদস্যরাও উধাও হয়ে যায়। পরে ২০টির মতো ছোট-বড় জাহাজ ও বাল্কহেড চালকের সঙ্গে কথা হয়। তারা প্রত্যেকেই জানান বাধ্যতামূলকভাবে চাঁদা দেওয়ার কথা। সিলেট থেকে আসা মালবাহী একটি জাহাজের চালক হুমায়ুন কবির কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে ওরা ৩ হাজার টাকা চেয়েছে। আমরা ৫০০ টাকা দিতে চাইছি। এরপরই হাতে থাকা লোহার পাইপ দিয়ে মারধর শুরু করে। পরে ২ হাজার টাকা দিয়ে রক্ষা পাইছি।’ আর একটি জাহাজের চালক শফিকুর ইসলাম বলেন, ‘১ হাজার টাকা দেওয়ার পরও আমাকে মারধর করেছে।’ শফিকুর নিজের পায়ে মারের দাগ দেখান। মোবারক হোসেন নামের একজন বলেন, ‘ডাকাতরা কোনো কথা শোনে না। টাকা না দিলেই শুরু করে মারধর। মারধর করে টাকা-পয়সাসহ সঙ্গে যা কিছু থাকে সব ছিনিয়ে নিয়ে যায়।’ জাকারিয়া নামের আরও এক চালক টাকা দেওয়ার পরও তাকে মারধরের কথা জানান।

স্থানীয় নদীর দুই তীরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে কয়েকজন চাঁদাবাজের পরিচয় ও বাহিনী সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে কালবেলা। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে ‘পুলিন বাহিনী।’ এর পরই আছে ‘প্রধান বাহিনী’ ও ‘রবি বাহিনী’। চাঁদাবাজদের নেতৃত্বে রয়েছে নলচরের বারেক প্রধানের দুই ছেলে হাসনাত প্রধান ও মহসিন প্রধান। চালিভাঙ্গার রবি ও রবিউল ওরফে রবির ছোট বোন জামাই খলিল। এই খলিল আগে প্রবাসে থাকত। ৫ আগস্টের পর দেশে ফিরেছে। আরও রয়েছে শাহ আলী নামের দুই ব্যক্তি। তারা দুই শাহ আলী কিংবা শাহ আলী (১) ও শাহ আলী (২) হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া কথিত এক সাংবাদিকের ভাই মাহবুব, আরিফ, লিটন ওরফে চোরা লিটন ও স্বপন। সোনারগাঁও এলাকার সোহাগ নামের আরও এক যুবকের নাম পাওয়া গেছে। এই সোহাগ পতিত আওয়ামী লীগের ক্যাডার সন্ত্রাসী পলিথিন জাকিরের ডান হাত হিসেবে পরিচিত।

চাঁদাবাজদের ধরতে গিয়ে পালিয়ে আসে পুলিশ: গত ২৩ এপ্রিল বেলা ৩টার দিকে কুমিল্লায় মেঘনা নদীর নুনের টেক এলাকায় ট্রলার ও বাল্কহেড থেকে চাঁদাবাজির সময় সেখানে হাজির হয় নৌপুলিশের একটি দল। ডাকাতের আক্রমণে তারা বেকায়দায় পড়ে ১১ রাউন্ড গুলি চালিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয় পুলিশ। জানতে চাইলে অভিযানে থাকা একজন পুলিশ সদস্য কালবেলাকে বলেন, ‘নিয়মিত নদী টহলের সময় আমরা খবর পাই নুনারটেক এলাকায় একটি স্পিডবোটে থাকা ৮ থেকে ১০ জন ব্যক্তি বালুবাহী বাল্কহেড ও অন্যান্য ট্রলারে চাঁদা তুলছে। তাদের ধরতে আমরা ধাওয়া করি। ১০ থেকে ১৫ মিনিট ধাওয়া করি আমরা। এরই মধ্যে তারা ফোন করে গ্রাম থেকে লোকজন ডেকে আনে। ৩টি ট্রলার এবং ২টি স্পিডবোটে করে গ্রামের লোকজন দেশীয় অস্ত্র টেঁটা, বল্লম নিয়ে আমাদের ওপরে হামলা করে। আমরা অভিযানে ছিলাম মাত্র চারজন। পরে নিরুপায় হয়ে গুলি করতে করতে আমরা নিরাপদে পেছনে আসি। আমরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে ১১ রাউন্ড গুলি ছুড়ি।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১২ মার্চ অবৈধ বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও নদীতে চাঁদাবাজির ও ডাকাতির সীমানা নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায় স্থানীয় প্রভাবশালী রবিউল ইসলাম ও আবদুল বারেক প্রধানের অনুসারীরা। কয়েক ঘণ্টাব্যাপী চলা এই সংঘর্ষে আহত হয় অর্ধশতাধিক। এর মধ্যে গুরুতর আহত হয় অন্তত ১৫ জন। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ডাকাত ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে ৩ ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা অভিযান চালান। এ সময় দুই ডাকাতকে ধাওয়া করে নলচর গ্রামের ভেতরের একটি ক্যানেলে ঢুকে পড়েন পুলিশ সদস্যরা। গ্রামের ভেতরে ঢুকতেই গ্রামবাসীরা টেঁটা, বল্লম, ছুড়ি, চাপাতিসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে পুলিশের ওপর। সেবারও প্রাণ বাঁচাতে পিছু হটতে বাধ্য হয় পুলিশ।’

জানতে চাইলে চালিভাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আজমগীর হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘চর হওয়ায় এখানকার মানুষ খুবই দুর্ধর্ষ ও হিংস্র। এখানে আমরাই নিরাপত্তাহীন। গ্রামের কিছু লোক আমাদের ওপরে টেঁটা, বল্লম নিয়ে হামলা করে। তবুও নিজেরা নিরাপদে থেকে যতটা সম্ভব চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডাকাত সদস্যরা স্পিডবোট নিয়ে আসে। কিন্তু আমাদের স্পিডবোট নেই। আমরা ট্রলার নিয়ে যেতে যেতে তারা পালিয়ে যায়।’

বৈদ্যের বাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘নলচর গ্রামের মানুষ হিংস্র। ওই এলাকার মানুষই এদিকে এসে ডাকাতি ও চাঁদাবাজি করে। আমাদের সাধ্যমতো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। আমরা দুজনকে ধরে এরই মধ্যে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটি আসলে চার থানার সংযোগ স্থল। এখানে অপরাধীরা অপরাধ করে সহজে পালিয়ে যেতে পারে।’ তবে খাককান্তি ফাঁড়ির ইনচার্জ বলেন, ‘আমাদের ফাঁড়ির নদীর সীমানায় এমন কিছু নেই। এগুলো চালিভাঙ্গিতে হয়। নদীর সীমানা তো ঠিক রাখা যায় না। তবে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’

হাসনাত প্রধান ও মহসিন প্রধান নামের দুই ছেলের বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তাদের বাবা বারেক প্রধান বলেন, ‘কী অভিযোগ? ডাকাতি করে? আমার ছেলেদের বিরুদ্ধে কেউ যদি আপনার কাছে অভিযোগ দিয়ে থাকে, তাহলে যা মন চায় লিখে দেন।’ এরপর ছেলে হাসনাতের সঙ্গে কথা বলান তিনি। নিজের বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হাসনাত প্রধান সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। গত ১২ মার্চ রবিউল গ্রুপের সঙ্গে সংঘর্ষের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘খলিল ডাকাতদের স্পিডবোটসহ তাদের লোকজনকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়। তারা আমাদের ওপরে হামলা করে। আমরা এখন আমাদের বাড়িতেই থাকতে পারি না। গ্রামে দাঁড়ানোর মতো অবস্থান নেই আমাদের, আমরা কীভাবে চাঁদাবাজি-ডাকাতি করব।’

জানতে চাইলে বিএনপি নির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ও সোনারগাঁও থানা বিএনপির সভাপতি এবং সাবেক সোনারগাঁও উপজেলার চেয়ারম্যান আজারুল ইসলাম মান্নান কালবেলাকে বলেন, ‘এগুলো করে চালিভাঙ্গা ও নলচর এলাকার মানুষ। প্রশাসন এখানে ঠিকভাবে কাজ করে না। প্রশাসন কাজ করলে তো এগুলো হতো না। আমরা চেষ্টা করছি। তবে রাতে তো আমাদের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। প্রশাসনকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানাব আমি। তারা যেন সঠিকভাবে কাজ করে।’