
সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বিদেশ যাওয়া ঠেকাতে তিন মাস আগে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) আবেদন করেছিল কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ। একই সঙ্গে জানানো হয়েছিল ঢাকা মহানগর পুলিশকেও (ডিএমপি)। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর কিশোরগঞ্জের ‘হাই প্রোফাইল’ আসামিদের তালিকা করে জানুয়ারির শেষদিকে এসবির রাজনৈতিক শাখায় আবেদনটি পাঠানো হয়। এ তালিকায় আবদুল হামিদের নাম ছিল ৩৯ নম্বরে। এসবিসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানানোর পরও কোনো বাধা ছাড়াই আবদুল হামিদ বুধবার রাতে দেশত্যাগ করেন। রাত ৩টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ব্যাংককের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন তিনি। তার সঙ্গে গেছেন ছোট ছেলে রিয়াদ আহমেদ ও শ্যালক ডা. নওশাদ খান। সাবেক এই রাষ্ট্রপতি কূটনৈতিক পাসপোর্ট নিয়েই ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
এসবিকে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজি (প্রশাসন) মতিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, কী বিষয়ে তদন্ত করা হবে তার লিস্টিং চলছে। বৃহস্পতিবার রাতেই কমিটি হয়েছে। কোন কোন লেয়ারে, কারা কারা দায়িত্বশীল ছিলেন, কার কী অবহেলা বা দায় রয়েছে, সেটা দেখা হবে।
আবদুল হামিদের দেশত্যাগের খবরে সমালোচনার মুখে পড়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর পরই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে একটি বিবৃতি পাঠানো হয়েছে। গতকাল শুক্রবার পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ফ্যাসিবাদী সরকারের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও হত্যা মামলার আসামি আবদুল হামিদের বিদেশ গমন সম্পর্কে জনমনে ক্ষোভ বিষয়ে সরকার অবগত। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনগত ব্যবস্থা নিতে সরকার বদ্ধপরিকর রয়েছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার দিনাজপুরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘তাদের (আবদুল হামিদকে বিদেশে যেতে সহায়তাকারীদের) কোনো অবস্থায় ছাড় দেওয়া যাবে না। আর যদি শাস্তির আওতায় না আনি, তাহলে আমি সে সময় চলে যাব।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এ ঘোষণার পর বৃহস্পতিবার রাতে আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার ও ইমিগ্রেশন পুলিশের এক অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করা হয়। এ ছাড়া আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে কিশোরগঞ্জের সদর থানার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার কথা জানায় পুলিশ সদর দপ্তর। একই সঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগের ঘটনা তদন্তে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজিকে (প্রশাসন) প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কমিটির প্রধান পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজি (প্রশাসন) মতিউর রহমান শেখ কালবেলাকে বলেন, কোন স্তরে, কার, কী দায় রয়েছে, তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে কিশোরগঞ্জ সদর থানায় গত ১৪ জানুয়ারি একটি মামলা হয়েছে। পেনাল কোডের ১৪৩, ৩২৩, ৩২৬, ১১৪, ৩৪ ধারাসহ বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের ৩/৪ ধারায় মামলাটি হয়েছে। মামলায় ১২৪ জনের নাম উল্লেখ করা আছে, যেখানে এক নম্বর আসামি শেখ হাসিনা, দ্বিতীয় আসামি শেখ রেহানা এবং তৃতীয় আসামি আবদুল হামিদ। মামলায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ জনকে।
কিশোরগঞ্জ সদর থানা পুলিশ জানিয়েছে, এ মামলায় এরই মধ্যে ১১ জন এজাহারভুক্ত আসামি এবং ১৩ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর কিশোরগঞ্জ জেলার ‘হাই প্রোফাইল’ আসামিদের মধ্যে যারা দেশত্যাগ করতে পারে, তাদের একটি তালিকা করে জেলা পুলিশ।
কালবেলার হাতে আসা তথ্যানুযায়ী, ৪৫ জনের তালিকাসহ গত ২৬ জানুয়ারি এসবির রাজনৈতিক শাখায় একটি আবেদন করেন কিশোরগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার। এ তালিকায় ৩৯ নম্বর নামটি ছিল আবদুল হামিদের। আবেদনে থাকা ৪৫ জনের বিদেশ গমনাগমন রোধ করতে ইমিগ্রেশন পুলিশকে অনুরোধ করা হয়। এই ৪৫ জনের বিষয়ে এসবিকে জানানোর পাশাপাশি ডিএমপিকে অবগত করে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ।
হামিদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন এসবি প্রধান
এদিকে আবদুল হামিদ দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশ একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে, যাতে বলা হয়েছে, TG340 বিমানের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ব্যাংকক যান আবদুল হামিদ। তিনি ভিআইপি টার্মিনাল দিয়ে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেন। জিডিতে বলা হয়েছে, আবদুল হামিদ ভিআইপি টার্মিনালে আসার পর ওসি ইমিগ্রেশনকে জানানো হয়, যিনি টার্মিনালের ইনচার্জ। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সকে (ডিজিএফআই) অবগত করেন। এনএসআইর সহকারী পরিচালক সানাউল্লাহ নুরী ও ডিজিএফআইর জিএসও-১ উইং কমান্ডার ফয়সাল অনাপত্তি দেন। এনএসআই ও ডিজিএফ থেকে পাওয়া অনাপত্তির বিষয়টি ওসি ইমিগ্রেশন এসএস ইমিগ্রেশন (অপারেশন), অ্যাডিশনাল ডিআইজি ইমিগ্রেশন ও ডিআইজি ইমিগ্রেশনকে জানানো হয়। অ্যাডিশনাল ডিআইজি ইমিগ্রেশন এসবি চিফের রেফারেন্সে ওসি ইমিগ্রেশনকে আবদুল হামিদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন। ওসি ইমিগ্রেশন সিনিয়র অফিসারদের নির্দেশ, এনএসআই, ডিজিএফআই থেকে পাওয়া অনাপত্তি এবং ইমিগ্রেশন ফরট্র্যাক সিস্টেমে কোনো বিরূপ মন্তব্য না থাকায় ভিআইপি টার্মিনালে কর্তব্যরত ইনচার্জকে ইমিগ্রেশন করার নির্দেশ দেন। টার্মিনাল ইনচার্জ এরপর ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেন।
সাধারণ ডায়েরিতে বলা হয়েছে, আবদুল হামিদের সঙ্গে তার ছেলে রিয়াদ আহমেদ ও শ্যালক ডা. এ এন এম নওশাদ খান ব্যাংকক গেছেন।