|
মুহাম্মদ রুহুল আমীন
|
|
মোদিকে নিয়ে প্রতিবেশীদের উদ্বেগ দূর হবে কি?
05 Jun, 2014
কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে বিজেপি বিশ্বব্যাপী নানা উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে সেখানে রামমন্দির নির্মাণের নীলনকশা বাস্তবায়নের তৎপরতা, ভয়াবহ গুজরাট দাঙ্গায় অসংখ্য মুসলিম নর-নারী হত্যা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতামূলক আচরণ ইত্যাদি কারণে এতদিন বিজেপি দেশের ভেতরে ও বাইরে নানা উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। ২০০২ সালের ভয়াবহ গুজরাট দাঙ্গার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিজেপিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল এবং ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভিসা বাতিল করেছিল। এমনকি ভারতের সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিভিন্ন নেতার সম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তব্য, প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জনগণের প্রতি বৈরিতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ এবং নির্বাচনী ইশতিহারে কতিপয় বিতর্কিত ইস্যু সংযোজিত করে বিজেপি দক্ষিণ এশিয়াসহ আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে দেয়।
কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে নজিরবিহীন সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দিল্লির মসনদে আরোহণ করার পর থেকে বিজেপির নীতি-আদর্শ ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, নির্বাচনে জয়লাভ করার উদ্দেশ্যেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণকে ধর্মীয়ভাবে ব্যবহার করার কৌশল অবলম্বন করেছিল বিজেপি। নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের অব্যবহিত পর থেকে দলটি কৌশল পরিবর্তন করতে থাকে। এ ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মোদি বিজেপির দীর্ঘদিনের নেতিবাচক বৈশ্বিক ইমেজ সংশোধনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ দূর করতে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সব রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান উপস্থিত থেকে তার নেতৃত্বের প্রতি তাদের আস্থার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পূর্বনির্ধারিত জাপান সফরে থাকায় স্পিকার তার প্রতিনিধিত্ব করেন শপথ অনুষ্ঠানে। শপথ অনুষ্ঠানে ভারতের চিরবৈরী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের উপস্থিতির খবর ভারতের পত্রিকাগুলো এত গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে যেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের দীর্ঘশত্র“তা আজ মিত্রতায় পরিবর্তিত হতে চলেছে! ভারতের আরেক বৈরী প্রতিবেশী চীনের প্রেসিডেন্টকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে নরেন্দ্র মোদি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছেন। বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষার প্রতিশ্র“তি পুনর্ব্যক্ত করে মোদি বিজেপিকে নিয়ে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক উদ্বেগ দূর করতে সক্ষম হচ্ছেন বলেই মনে হয়।
নেতিবাচক আন্তর্জাতিক ইমেজ সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি ভারতীয় ভোটারদের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছেন ৬০ বছর ধরে কংগ্রেসের বিভিন্ন ব্যর্থতার চিত্র জনসমক্ষে তুলে ধরে। বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, প্রবৃদ্ধি হ্রাস ইত্যাদি মৌলিক অর্থনৈতিক বিষয়কে বিজেপি ব্যবহার করেছে প্রচারণার কৌশল হিসেবে। যেসব ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে বারাক ওবামার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে প্রযুক্তির ব্যবহারে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছিলেন, তাদের বিজেপির প্রচারকার্যে শতভাগ ব্যবহার করে কংগ্রেসের দুর্নীতি, অদক্ষ শাসন ও ব্যর্থতাগুলো তুলে ধরে নির্বাচনী রায় বিজেপির পক্ষে আনতে সক্ষম হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। নিখিল ভারতের জনগণের ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে হিন্দু ধর্মের চেতনা লুক্কায়িত আছে, তাকে রাজনৈতিক প্রচারণায় জাগরিত করে মোদি ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণকে আশ্বস্ত করেছিলেন- বিজেপি ভারতীয়দের স্বীয় মূল্যবোধে বেঁধে রাখতে পারবে। এ ক্ষেত্রে কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর বিদেশিনী পরিচয় বিজেপির জন্য মোক্ষম সুযোগ সৃষ্টি করতে পেরেছে। অর্থাৎ ধর্মকে প্রচারের কৌশল হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। সম্ভবত আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিজেপির ধর্মকার্ড তেমন গুরুত্ব পাবে না। এতদসত্ত্বেও প্রতিবেশীদের মনোজগতে বিজেপি বেশ অস্বস্তির একটি বীজ বপন করেছে অনেক আগেই। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সম্পর্কে ভারতের বৃহৎ শক্তির ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে আস্থা অর্জন ছাড়া বিজেপি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তেমন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বিজেপি বা নরেন্দ্র মোদি এ চ্যালেঞ্জের মুখেই দিল্লির মসনদে বসেছেন।
বোধকরি ক্ষমতায় আরোহণের পর এখন বিশ্বরাজনীতির আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আন্তঃক্রিয়ায় বিজেপির ধর্মবাদী চরিত্র লুক্কায়িত রাখায় কৌশল অবলম্বন করা হবে। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচনী প্রচারণায় নরেন্দ্র মোদি ভারতে বসবাসরত বাংলাদেশী মুসলমানদের বিতাড়নের হুংকার ছেড়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদি নিশ্চয়ই তাদের ভারত ছাড়ার ব্যাপারে তেমন কঠোর নীতি গ্রহণ করবেন না। তার বিবেচনায় অবশ্যই বাংলাদেশে চাকরিরত প্রায় ২০ হাজার ভারতীয়র বিষয়টি গুরুত্ব পাবে এবং তখনই দাও এবং লও নীতিতে আঞ্চলিক সহিষ্ণুতাই প্রকাশ পাবে। পাকিস্তানকে উদ্দেশ করে মোদির সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তব্যও নিশ্চয়ই ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তার কাছে গুরুত্বহীন হয়ে যাবে। নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের অংশগ্রহণের খবর ভারতীয় পত্রিকায় ঘটা করে ছাপার ঘটনা থেকে এটা অনুধাবন করা যায়। তাছাড়া কংগ্রেসের তরুণ নেতা রাহুল গান্ধী যেভাবে মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ভবিষ্যৎ চিত্র অংকন করেছিলেন, রাহুলের সেই বক্তব্যকে মিথ্যা প্রমাণ করে ভারত ও প্রতিবেশীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নতুন বন্ধন তৈরির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সচেষ্ট থাকবেন মোদি। চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মোদি সরকারের সহযোগিতামূলক নীতি বিজেপির শান্তিপ্রিয়তার নির্দেশন। তাদের ধর্মকেন্দ্রিক বক্তব্য যে ভারতের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিতে সীমিতভাবে ব্যবহৃত হবে, তা বোঝা যায় বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংয়ের সাম্প্রতিক বক্তব্যে : দেশের সব শ্রেণীর, সব ভাষার, সব সম্প্রদায়ের মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। এই জয় ভারতের সাধারণ মানুষের। এ জয়ের উল্লাসে ভেদাভেদের রাজনীতি যেন প্রশ্রয় না পায়। এ জয় যেন মুছে দেয় জাত-পাত আর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের তফাৎ। রাজনাথের এ বক্তব্য বিজেপির ভবিষ্যৎ নীতির প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিজয়ের নিয়ামক হল মূলত গুজরাট মডেলে ভারতকে সাজানোর প্রতিশ্র“তি। ভারতের নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয়ই এ বাস্তবতা মনে রাখবেন যে, কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উন্নতি আঞ্চলিক সম্পর্কের সুদৃঢ় কাঠামোর ওপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্র“নাইসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ব্যঘ্র অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার মূলে রয়েছে আসিয়ানের সুদৃঢ় জোটবদ্ধতা। আসিয়ানের বাইরেও এর বিস্তৃতি। ভারতের উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হল সার্কের উন্নয়নমূলক কার্যাবলীকে এগিয়ে নিতে ভারতের নেতৃত্বের সঠিক ব্যবহার। সার্ক শক্তিশালী হলে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের মধ্যে ভারতের বিষয়ে যে দাদাসুলভ অভিজ্ঞতা রয়েছে, তা তিরোহিত হবে।
ভারতের রাজনীতিতে বিজেপিকে স্থায়িত্ব পেতে হবে। এ এক বড় চ্যালেঞ্জ, যা কখনও আঞ্চলিক সহযোগিতাকে উপেক্ষা করে অর্জন করা সম্ভব নয়। বিজেপিকে বিস্মৃত হলে চলবে না, ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের ১৩ দিন পর তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। ১৯৯৮ সালে আবার সরকার গঠন করলেও বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ মাত্র ১৩ মাস ভারত শাসনের সুযোগ পায়। এরপর ১৯৯৯ সালে সরকার গঠনে সক্ষম হয় বিজেপি। কিন্তু ৯৯-এর বিজয় আর ২০১৪-এর বিজয় এক পাল্লায় মাপা যাবে না। সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন বিজেপিকে বৃহত্তর ভারতের সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যৎ রচনার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার ম্যান্ডেট দিয়েছে। বিজেপিকে জনগণের এ অকুণ্ঠ সমর্থন ধরে রাখতে হলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রতি ভারতীয় নীতির সর্বজনীনতার প্রমাণ রাখতে হবে। আর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এতদিনের সৃষ্ট উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করে বিজেপিকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভারতীয় জনগণের হৃদয়ে দীর্ঘ ভালোবাসার মন্দির গড়তে হবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে অনিষ্পন্ন তিস্তা ইস্যু, ফারাক্কা ইস্যু, সীমানা ইস্যু, ট্রানজিট ইস্যু ইত্যাদি পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষার ভিত্তিতে সমাধান করে ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী বাংলাদেশের মানুষের মাঝে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সহযোগী ভারতের কাছ থেকে উপর্যুপরি বঞ্চনা পেতে পেতে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যে ভারত-বিমুখতা সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সহযোগিতার নতুন যুগের সূচনা ঘটাতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আধিপত্যবাদী নীতি পরিহার করে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বজনীনতার চেতনায় রাজনৈতিক আদর্শবাদের নতুন নীতি অনুসরণ করতে হবে বিজেপিকে।
মুহাম্মদ রুহুল আমীন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন