মা নিয়ে কত যে অনুষঙ্গ, কত প্রতীক, সর্বোপরি ব্যক্তিচৈতন্যে বানভাসি আবেগ। এবং তা যেন দেশ নির্বিশেষে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মাতৃপ্রতিমা, মাতৃ-উপাসনার মতো ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় অনুশাসন পেরিয়ে 'মা' জীর্ণ কুটির থেকে দামি মহলে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে স্নেহ-ভালোবাসা-মমতার আদি ও অকৃত্রিম আধার। সেখানে আর সব পিছে পড়ে থাকে। সেই প্রগাঢ় অনুভূতি ও আবেগ তুলনাহীন বলেই বোধ হয় শিল্পে-সাহিত্যে নানারূপে মায়ের প্রকাশ- কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস কোথায় নয়। 'মাতৃরূপেণ সংস্থিতা' থেকে শিল্পে-ভাস্কর্যে মাতৃপ্রতিম 'ম্যাডোনা' যেন প্রতীকেরও ঊর্ধ্বে একজন মমতাময়ী, সৃষ্টির উৎস।
এমনই সব হাজার কারণে আধুনিককালের বিশ-একুশ শতকে পৌঁছে বিশ্ব সন্তানদের মাতৃ আরাধনা, মাতৃপ্রেমে নির্ধারিত হয়েছে মাতৃদিবস, সুস্পষ্টভাবে বলতে আন্তর্জাতিক মা দিবস, ১১ মে। মাতৃবন্দনার জন্য নির্দিষ্ট একটি দিন যাতে আনুষ্ঠানিকতার প্রাধান্য। কিন্তু মাতৃবন্দনা এক পাশে রেখে নাড়ির টানে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসার বিষয়টি তো দিন-বিহীন অর্থাৎ এর প্রকাশ একদিন-প্রতিদিনের।
এমন এক বিশ্বব্যাপী অনুভূতির প্রতীক বলেই বোধ হয় নানা ভাষ্যে এর প্রকাশ। মাতৃভাষা, মাতৃভূমির প্রতীকে-অনুষঙ্গে কত যে লড়াই মাতৃসমদের নিয়ে, কত যে রক্তদান, কত যে আত্মদান তার তো সীমা-পরিসীমা নেই। সেখানে কখনো মাটি ও মা একাকার করে কবিদের স্তবগান : 'তোমার কোলে জনম আমার, মরণ তোমার বুকে/তোমার বুকে খেলা আমার দুঃখে-সুখে।' আবার কেউ তার 'অপরূপ রূপে' মুগ্ধ। এমনটাই সত্য হয়ে ওঠে বিশ্বভুবনে। সে আবেগ এমনই তীব্র যে ওই দ্বিতীয় মা স্বদেশ মুক্তিসংগ্রামের প্রেরণা। মায়ের এ তুলনাহীন রূপে সচেতন মন, আবেগপ্রবণ মন দেখে 'বিশ্বময়ী'র প্রতিফলন এবং তা নানারূপে, নানা ভাষ্যে। তাই তো গোর্কি কর্মময়ী, প্রেরণাদাত্রী মায়ের চিত্রণে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেন।
সত্যই মা তাঁর সন্তানের মুখে ভাষার বুলিই ফোটান না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়ে ওঠেন জীবন গঠনের প্রেরণা, কারো কারো জন্য সুখ-দুঃখের মর্মসঙ্গী। আবার কারো জন্য মা এক জীবনাদর্শ। সে প্রভাবে কেউ সাফল্যের শিখরে উঠে যান, কেউ বা সাদামাটা জীবনযাত্রায় শান্তি খুঁজে নেন। যে সন্তান তার মায়ের পূর্ণ সঙ্গ পেয়েছে, তাঁর শিক্ষা পেয়েছে, জীবনকে যথাযথভাবে বুঝে নেওয়ার দৃষ্টি পেয়েছে, তার জীবনে মা তার সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ- জীবিত বা মৃত দুই অবস্থায়ই।
চির মমতাময়ী মায়ের প্রতীকী রূপ
এ কথা যেমন সত্য বিশ্বখ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের জন্য, তেমনি ভিন্নধারার মানুষের জন্যও। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন তাঁর মায়ের আদর্শ রূপ চিত্রণের ধারায় বলেন, 'আমার জীবনের পুরোটাই আমার মায়ের হাতে গড়া'- তখন আমরা অবাক হই না। শিক্ষিত মায়ের সুশিক্ষার সিঁড়ি বেয়ে তাঁর সন্তান জীবনটাকে নিজের ইচ্ছামতো গড়ে নিতে পারে। সে জন্যই নারী শিক্ষা প্রকৃত মানুষ গঠনে, জাতি গঠনে অপরিহার্য। বিষয়টা বুঝেছিলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন। চেষ্টাও করেছেন যথাসাধ্য।
আদর্শ মা যে আদর্শ সন্তান তৈরির পূর্বশর্ত, এ সত্যটা তাঁর মতো করে আর কে বুঝেছেন? এ নিখাদ সত্য বোঝা বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য। তবু নারী শিক্ষা এ দেশে অনেক পিছিয়ে। তাই সত্য বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সম্ভব বাংলাদেশের প্রকৃত অগ্রযাত্রা। এ সত্য উপলব্ধির কারণে শ্বেতাঙ্গ জননীর কৃষ্ণাঙ্গ সন্তান তাঁর মা সম্পর্কে বলতে পারেন : 'আমার মধ্যে যা কিছু ভালো, সবই তাঁকে দেখে শেখা, তাঁর কাছ থেকে পাওয়া।'
বিদেশ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে ফিরে বন্দিত-নন্দিত ব্যক্তিত্বের মুখেও শুনি একই কথা। তবে স্বাভাবিক নিয়মে কিছুটা ভিন্ন ভাষায়। ভূখণ্ডের স্বভাবধর্মের মিলে আবেগঘন প্রকাশে নন্দিত তারকার বক্তব্য : 'আমার সব মানবিক মূল্যবোধ আমি মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। অনেক কিছু শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। ...মা-ই আমার জীবনের তারকা। আমি যা কিছু পেয়েছি, যা কিছু করেছি, এ সবই তাঁর আশীর্বাদ ছাড়া কিছু নয়। আমি জানি, মা আমাকে কখনো চোখের আড়াল করবেন না।' হারানো মাকে নিয়ে বেদনার্ত শেষ কথাগুলো।
জীবনে সফলকাম অনেকের কাছ থেকেই হয়তো অনুসন্ধানে এমন ভাষ্য উঠে আসবে। আসবে নানা শ্রেণির, নানা পেশার মানুষের কাছ থেকে। আসবে এমন কথাও- 'মা আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু।' যেমন- শাহরুখ খান বলেছেন : 'মা ছিলেন আমার সত্যিকারের বন্ধু।' কথাটা সার্থক মায়ের কন্যাসন্তানের মুখে প্রায়ই শোনা যায়। কারণ আনন্দে-বেদনায় মা হয়ে ওঠেন যাকে বলে তার 'গাইড, ফিলোসোফার এবং বন্ধু, পরামর্শদাতা, এমনকি দুঃখকষ্টের অংশীদার।'
মায়ের সাহচর্যে, তাঁর প্রেরণায় পথ চলে যার বড় হয়ে ওঠা, তেমন কেউ জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর মাকে হারানোর বেদনা বুকে পুষে বলতেই পারেন- 'মা এখনো আমার জীবনে ছায়াসঙ্গী। মাকে সঙ্গে নিয়ে, তাঁর স্মৃতি নিয়ে আমার সফল পথচলা। আমার জীবনে যত সাফল্য, যত প্রাপ্তি আর সে সুবাদে যত আনন্দ- সব কিছু মায়েরই দান।' সত্যি বলতে কি, জীবনে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মায়ের অবদানের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন থেকে সফল মায়েদের প্রতি সম্মাননা জানাতে 'রত্নগর্ভা' অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এবারও অনেকে এ সম্মানে ভূষিত। এমন আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে কি মায়ের অবদান চিহ্নিত করা যায়? এ ছাড়া এ দেশের আনুষ্ঠানিকতায় থাকে পছন্দের নিজস্ব নিয়মনীতি। সেখানে প্রকৃত 'রত্নগর্ভা' সবার দেখা মেলে না। এমন একাধিক মায়ের কথা জানি, যাঁরা সত্যই আনুষ্ঠানিকতার ভাষায় 'রত্নগর্ভা' অথচ সে পরিচিতিতে চিহ্নিত নন। তেমন একজন ঢাকাবাসী 'ইস্কাটন গার্ডেনবাসী মা'কে আমি জানি, যিনি তাঁর দুই মেধাবী সন্তানকে অপরিসীম ধৈর্য, কষ্ট নিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে পেরেছেন। পেরেছেন তাদের জীবনে সুশিক্ষা ও সদাচারের মধ্য দিয়ে আকাঙ্ক্ষিত শীর্ষের পথ ধরিয়ে দিতে। সেই দুই সন্তান যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকতার ব্রতে নিয়োজিত করপোরেট পুঁজির প্রলোভন উপেক্ষা করে। ওই মা কিন্তু রত্নগর্ভার আনুষ্ঠানিকতায় সম্মানিত নন।
কিন্তু আনুষ্ঠানিকতার সম্মানে কী আসে যায়? মায়ের অবদানের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি সন্তানের স্বীকৃতিতে। পূর্বোক্ত মায়ের ক্ষেত্রে কথাটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য চেনা-জানা অনেকের ক্ষেত্রে। সত্য ইতিহাসখ্যাত বহু ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে যা লেখা রয়েছে বইয়ের পাতায়। বিশ্বখ্যাত ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন মাকে দেখতেন মেধাবুদ্ধি, সাহস ও সহিষ্ণুতার প্রতীক হিসেবে এবং যা তাঁর এগিয়ে চলার পাথেয়। তাই ফরাসিদের উদ্দেশে তাঁর অসাধারণ উক্তি : 'আমাকে ভালো মা দাও, আমি তোমাদের ভালো জাতি উপহার দেব।' কথাটি কিন্তু সব দেশের জন্যই সত্য।
বাস্তবিকই যেমন ব্যক্তিত্ব গঠনে, সন্তানের মধ্যে যথার্থ গুণাবলি সঞ্চারিত করতে, সর্বোপরি তেমনি জাতি গঠনের ক্ষেত্রে আদর্শ মায়ের, সুশিক্ষিত মায়ের কোনো তুলনা নেই। যেমন নেই সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনে ও গৃহধর্ম রক্ষায় তাঁর আত্মত্যাগের। সন্তানের জন্য মা পারেন না এমন কাজ নেই। তাই মায়ের নানামাত্রিক অনুভূতি নিয়ে লেখা হয়েছে বহু গাথা, বহু গল্প। মায়ের আত্মোৎসর্গ নিয়ে বহুখ্যাত গল্পটির কথা অনেকেই হয়তো জানেন যে মা তাঁর ছেলের প্রগাঢ় ইচ্ছা পূরণ করতে নিজের হৃৎপিণ্ডটি সেই অধমের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিংবা সেই ফরাসি গল্পটিও স্মরণযোগ্য যে তাঁর সন্তান হত্যার প্রতিশোধে মমতাময়ী মা কী নির্মমতার পরিচয় রেখেছিলেন। অথচ 'মা' শব্দটিই তো এক মমতাময়ীর প্রতীক।
আন্তর্জাতিক 'মা দিবসে'র উৎস আমরা জানি। জানি আনা জারভিস, মারিয়া জারভিসের কথা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের মাতৃদিবস হিসেবে দিনটি ঘোষণার কথা এবং ১৯৬২ সাল থেকে ১১ মে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃদিবস হিসেবে পালনের কথা। অন্তত এ একটি দিন আমাদের মনে করিয়ে দেয় মায়ের কথা। সাহায্য করে পেছন ফিরে তাকাতে, মায়ের কোলে আনন্দিত সময়ের স্মৃতি উসকে দিতে।
কিন্তু যে সন্তান অতি শৈশবে তার মাকে হারিয়েছে তেমন কারো কারো কথা জানি, যাদের মাকে হারানোর স্মৃতি, নিজে সফল-সার্থক মা হওয়ার পরও তাকে কুরে কুরে খায়। কেউ বা হারানো মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে সান্ত্বনা খোঁজে। কারো বা তেমন সুযোগও নেই। সত্যি বলতে হয়, শৈশবে মাকে হারানোর দুর্ভাগ্য যেন কারো না হয়। বাংলাদেশে প্রসূতি মৃত্যুর হার অনেক কমেছে, আমাদের প্রত্যাশা, তা যেন আরো কমে ভবিষ্যতে নিম্নতম পর্যায়ে পৌঁছে গৌরবের স্থানটি অধিকার করতে পারে।
প্রসঙ্গত দুটি সংশ্লিষ্ট ট্র্যাজিক ঘটনা উল্লেখ করে 'মা দিবসে'র আলোচনা শেষ করব। বাংলাদেশে স্বৈরশাসনামলে এক মা ভিকারুননিসা স্কুল থেকে তাঁর শিশুসন্তানকে আনতে গিয়ে যখন সন্ত্রাসী তরুণের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন, তার আগে তাঁর শেষ কথা সন্তানের নিরাপদে বাড়ি ফেরা নিয়ে। ঘটনাটি সে সময় সংবাদপত্রে আলোড়ন তৈরি করেছিল। আর সম্প্রতি রানা প্লাজা ধসে আক্রান্ত মা শাহিনার আগুনে পুড়ে যাওয়ার আগে সনির্বন্ধ অনুরোধ তাঁকে বের করে আনতে; কারণ তা না হলে তাঁর দুধের শিশুটি মাকে হারিয়ে মারা যাবে। এখানে মায়ের আর্তিটাই চির মমতাময়ী মায়ের প্রতীকী রূপ ধারণ করেছে। মা এমনই অসাধারণ।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসৈনিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন