|
এ এম এম শওকত আলী
|
|
সহিংস ঘটনাপ্রবাহ ও পরবর্তী নির্বাচন
08 Dec, 2013
আগামী নির্বাচন ঘিরে ভয়ংকর সহিংস ঘটনাপ্রবাহের দৃশ্যপট অধিকতর ভয়ংকর হচ্ছে। শান্তির কথা সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়তই বলছে। টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে এ কথা শোনা গেলেও শান্তি এখনো আসেনি। কবে আসবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রথম পর্যায়ে সাত দিনের বা ৭১ ঘণ্টার অবরোধ। ওই সময়ে গত মাসের শেষ পর্যায়ে তিন দিনে ২২ জনের প্রাণহানি হয়। বর্ধিত হয় অবরোধ। অনেকটা আকস্মিকভাবে, যা শান্তিপ্রিয় জনগণের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। ৩০ নভেম্বর থেকে তিন ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ২৯ জনের প্রাণহানি হয়। আহতের সংখ্যা অনেক বেশি। এর কোনো সার্বিক চিত্র এখনো পাওয়া যায়নি। এ দুই পর্যায়ে নিহতদের সংখ্যা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দ্বিতীয় দফায় প্রাণহানির সংখ্যা প্রথম দফার তুলনায় সামান্য কম হলেও প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছে, তারা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। তাদের প্রধানত কয়েকটি ভাগে শ্রেণীবিন্যাস করা সম্ভব। সাধারণ পথচারী, ট্রেনের ও বাসের যাত্রী এবং অবরোধ সমর্থক ও অবরোধবিরোধীদের মৃত্যু। টেলিভিশনের পর্দায় রাজধানী ঢাকা শহর প্রায় স্বাভাবিক বলে বলছে কিছু চ্যানেল। তবে এ কথাও স্বীকার করা হচ্ছে যে যানবাহনের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। অন্যদিকে ঢাকার বাইরের জেলা শহরগুলোতে প্রতিদিনই হরতাল হচ্ছে। একটি দৈনিকের মতে, সংখ্যা ৩০। এ মূল্যায়ন যদি সত্যি হয়, তাহলে বলা যায়, দেশের প্রায় অর্ধেক এখন অচল। টানা অবরোধের কারণে জেলা শহর থেকে কোনো বাস ঢাকায় আসতে পারছে না। অন্যদিকে ঢাকা থেকেও কোনো বাস জেলা শহরে যেতে পারছে না। এ নিয়ে কারো সন্দেহ নেই। রেলপথে চলার ক্ষেত্রেও রয়েছে যথেষ্ট শূন্যতা। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ট্রেন সার্ভিস রেলওয়ের ফিশপ্লেট তুলে ফেলায় চলাচল স্বাভাবিকভাবে করতে পারছে না। এ ছাড়া রয়েছে যাত্রীদের আতঙ্ক। কারণ চলন্ত রেলে অগ্নিসংযোগ বা ককটেল বিস্ফোরণ। ট্রেনের যাত্রীও কমে গেছে। ট্রেনলাইন উপড়ে ফেলার কারণে ও যাত্রীসংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় রেলওয়ের আয় প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে প্রায় ছয় মাসের প্রয়োজন হবে। নৌপথেও চলাচল স্বাভাবিক নয়। প্রথমে শোনা গিয়েছিল, অন্য দুটি পথের তুলনায় নৌপথ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। এখন পর্যন্ত কোনো নৌপথের ওপর আক্রমণ হয়নি। তা সত্ত্বেও টেলিভিশন সূত্রে জানা যায়, যাত্রীর সংখ্যা আগের তুলনায় কমে গেছে। আন্তজেলা সড়কব্যবস্থাও অবরোধের কারণে অনেক স্থানেই আঘাতপ্রাপ্ত। কারণ অগ্নিসংযোগ অথবা সড়কের পাশের বড় বড় গাছ কেটে রাস্তা বন্ধ করার ঘটনা।
পুলিশসহ বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। এ দৃশ্যই টেলিভিশনে দেখা গেছে। কিন্তু এ দৃশ্য রাজধানী ঢাকায় যতটা দৃশ্যমান, জেলা শহরগুলোতে অতটা নয়। তা ছাড়া রেলপথসহ মহাসড়কের বিস্তৃতি এমন যে সব জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করা সম্ভব নয়। অবরোধের পক্ষের ব্যক্তিরা এক জায়গায় নাশকতার চেষ্টা করলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়। তবে তখনই অবরোধকারীরা পালিয়ে যায়। স্বল্পসংখ্যক লোক ধরাও পড়ে। ধৃত ব্যক্তিদের লাঠিপেটা করে পুলিশ অথবা ক্রমাগত লাথি মারে। এ দৃশ্যও টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেছে। শত শত লোকের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। এর জন্য আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশ নেই বলে মনে হয়। কারণ ঢাকার প্রায় প্রতিটি মামলায় প্রধান বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের আসামি করা হয়। এ ছাড়া এসব ঘটনার আগেও তাঁদের অনেককেই কিছু মামলায় গ্রেপ্তার করে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছিল। কিছু নেতা এখন জামিনে মুক্ত হয়ে গোপনে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মাধ্যম হয় ভিডিওবার্তা অথবা লিখিত বিবৃতি। এ নিয়ে টেলিভিশনে প্রায়ই এ কথা বলা হয় যে নেতা-কর্মীদের রাজপথে দেখা যায়নি। তাঁদের কিছু আছেন কারাগারে আর কিছু আত্মগোপনে। এর পরও ঢাকাসহ বাইরের অধিকাংশ জেলায় বিরোধী জোটের কর্মতৎপরতা বন্ধ হয়নি। সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ দলীয় নেতা-কর্মীদের দিয়ে আন্দোলনবিরোধী তৎপরতায় ব্যস্ত। কিন্তু তা যে খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি তা বোঝা যায়। চলমান ঘটনা বা বিরামহীন অবরোধের কারণে প্রধান বিরোধী দল বলছে হামলা-মামলা ও নির্যাতন-অত্যাচার করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। আজ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করলে কাল আবার আরো কিছু ব্যক্তি আন্দোলনে অংশ নেবে। এ কথা অনেকাংশে সত্যি।
বেশি সত্যি প্রধান বিরোধী দলের অন্যতম অংশীদার জামায়াতের ক্ষেত্রে। নাশকতার ঘটনায় তাদের কর্মীরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এ কথাই মিডিয়া বারবার বলছে। ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা সংলাপের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বসে নেই। তারাও প্রথম থেকেই সংলাপের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ খুঁজে বের করার কথা বলছে। সুশীল সমাজের নেতারাও একই সুরে কথা বলছেন। তাঁদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়টি উত্থাপন করেছেন। কিন্তু কোনো পক্ষই শুভবুদ্ধির পরিচয় দেয়নি। বরং সংলাপকে কেন্দ্র করে একটি ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। অবরোধের দ্বিতীয় পর্যায়ে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর এরশাদের জাপাসহ ক্ষমতাসীন দলের কিছু প্রার্থীর বাড়িতেও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট আন্দোলনখ্যাত এক ব্যক্তি। তিনি ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। এ ছাড়া চাঁদপুর জেলায়ও এ ধরনের ঘটনার কথা শোনা গেছে। এ থেকে অনুমান করা যায়, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সম্পদও এখন নিরাপদ নয়। এর সঙ্গে যোগ করা যায় দলীয় অফিস। দুই পক্ষেরই কিছু অফিসে আগুন দেওয়া হয়েছে। এগুলো সব ঢাকার বাইরে। আর রয়েছে বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। পুলিশের যানও রক্ষা পায়নি। আক্রমণের ভয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহও যথেষ্ট বিঘ্নিত। বাজারে এসব পণ্যের দাম স্বভাবতই চড়া। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষ।
রাজপথ ও রেলপথে সহিংস ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। টানা অবরোধের পঞ্চম দিনে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, খুলনা ও গাইবান্ধায় ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়েছে। কারণ রেললাইনের ক্ষতি সাধন করেছে অবরোধকারীরা। এর এক কি দুই দিন আগে প্রধান বিরোধী দলের নেতা আন্দোলনকারীদের কারো জানমালের ক্ষতি না করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। এটা কেউ মানেনি। কয়েকটি জায়গায় ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ায় একটি দুর্ঘটনায় পাঁচজন মারা গেছে। তারা সবাই যাত্রী। রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়। কিন্তু দূষিত রাজনীতির ফলে তাদের প্রাণহানি হয়েছে। ভেঙে পড়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। একের পর এক পরীক্ষা পিছিয়ে যাচ্ছে। আগে শোনা গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জট। এখন প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সেশন জটের স্বাক্ষর দেখা যাচ্ছে।
প্রধান বিরোধী দল সব সময়ই বলে আসছিল একতরফা নির্বাচন তারা হতে দেবে না। নির্বাচনী প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা শেষ হওয়ার পর শুরু হলো আরেকটি নাটক। এর মূল নায়ক জাতীয় পার্টির প্রধান। তাঁর ঘন ঘন মত পরিবর্তনের ফলে নির্বাচন ঘিরে এখন নতুন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তথাকথিত সর্বদলীয় সরকারের কিছু নেতা জাতীয় পার্টিপ্রধানের নির্বাচন বর্জনের কথা শুনে কোনো গুরুত্ব দেননি। কারণ মত পরিবর্তনে জাতীয় পার্টির নেতার অনেক উদাহরণই অতীতে রয়েছে। সব বিতর্কের অবসান ঘটল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। ওই সময়ও একটি নাটকীয় দৃশ্য এরশাদের বারিধারার বাসভবনের সামনে দেখা যায়। জাতীয় পার্টির শীর্ষ কয়েকজন নেতা, যার মধ্যে এ দলের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপদেষ্টাও ছিলেন, তাঁরা সবাই এরশাদের বাসভবনের সামনে হাজির হন। তাঁদের সঙ্গে বিপুলসংখ্যক দলীয় কর্মীও উপস্থিত ছিল। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলীয় নেতারা বলেন, তাঁরা মন্ত্রীদের পদত্যাগের বিষয়ে এরশাদের পরবর্তী নির্দেশ কী তা জানতে এসেছেন। এরপর বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় এরশাদ ঘোষণা করেন, সবাই মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করবেন। দলীয় মহাসচিবও এ নির্দেশ কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। সবার মতে, এরশাদের ঘোষণায় দৃঢ় প্রত্যয়ের স্বাক্ষর পাওয়া যায়।
সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে এরশাদ যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এর পরই শুরু হয় আরো কিছু অতিনাটকীয় দৃশ্য। প্রথমে দলীয় মন্ত্রীদের সর্বদলীয় সরকার থেকে ডিসেম্বর, ২০১৩ পদত্যাগ, পরে কিছু মন্ত্রীর বিদ্যমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও সাক্ষাৎ শেষে এরশাদের সঙ্গে আলোচনা। গত শনিবার পর্যন্ত জানা খবর অনুযায়ী এরশাদের দাবি হলো, দুই শর্তে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে। এক. নির্বাচনী তফসিল ১০ দিন পিছিয়ে দেওয়া এবং সব দলের অংশগ্রহণ। প্রথম শর্তটি আপাতদৃষ্টিতে কঠিন না হলেও এ নিয়ে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য আইনি জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ এরই মধ্যে দাখিল করা মনোনয়নপত্রের বাছাই পর্ব শেষ। অন্তত এক আসনে আওয়ামী লীগের একজন প্রার্থী বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন বলে ঘোষণা। ৩৩টি আসনে ১০ জন মন্ত্রীসহ একক প্রার্থী। মোট বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা ৮৪৭। মিডিয়ার মতে, 'চড়া দর হাঁকছেন এরশাদ, আশাবাদী আওয়ামী লীগ।' শনিবার প্রকাশিত কালের কণ্ঠের এ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শনিবার জাতীয় পার্টির সব মন্ত্রী ও এক উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। নাটকের শেষ অঙ্ক দেখার অপেক্ষায় দেশবাসী, বিশেষ করে বিরোধী দল। প্রধান বিরোধী দলের তৃতীয় দফা অবরোধ চলছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রবিবার ঢাকা ও বুধবার সিলেট মহানগরীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। এত দিন নৌযান অক্ষত ছিল। শনিবার জানা যায়, মাওয়া ঘাটে তিনটি লঞ্চে ভাঙচুর করা হয়েছে। দুই প্রধান দলের সমঝোতা ছাড়া শান্তি আসবে কি না সেটাই হচ্ছে বড় প্রশ্ন।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন