Image description

স্বপ্ন ছিল প্রকৃতিকে আপন করে নেওয়ার। বিত্ত-বৈভব, বিলাস, সামাজিক কাঠামো—সব কিছু ছুঁড়ে ফেলে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন এক তরুণ। তাঁর নাম ক্রিস্টোফার জনসন ম্যাকক্যান্ডলেস। মাত্র ২৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করলেও তাঁর জীবন আজও বহু ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে এক অনুপ্রেরণা। কারণ, কোটি টাকার সম্পদ উপেক্ষা করে তিনি বেছে নিয়েছিলেন দুরূহ, অনিশ্চিত এক যাযাবর জীবন।

১৯৬৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়ার ইঙ্গলউডে ধনী এক পরিবারে জন্ম নেন ক্রিস্টোফার। তাঁর বাবা ওয়াল্টার ম্যাকক্যান্ডলেস ছিলেন নাসার একজন বিশেষজ্ঞ এবং মা উইলহেলমিনা মারি ছিলেন মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কর্মরত। ছোটবেলা কেটেছে ওয়াশিংটন ডিসিতে, উচ্চমধ্যবিত্ত এলাকায়।

১৯৯০ সালে ‘ইমোরি ইউনিভার্সিটি’ থেকে ইতিহাস ও নৃবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন ক্রিস্টোফার। শিক্ষাজীবনে মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। একাধিক গবেষণামূলক লেখার জন্য সম্মাননা পেয়েছিলেন, বিশেষ করে বর্ণবৈষম্য, আফ্রিকার রাজনীতি ও খাদ্যসঙ্কট নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। পড়াশোনার সময় বিভিন্ন বৃত্তি ও খণ্ডকালীন কাজের মাধ্যমে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকার সমপরিমাণ অর্থ উপার্জন করেন তিনি। তবে স্নাতক শেষ হতেই তাঁর মধ্যে জন্ম নেয় এক অদম্য টান—প্রকৃতি ও অনির্দিষ্টের দিকে। বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করে ভবঘুরে হবার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

নিজের জমানো টাকা দান করে দিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় রাঁধুনি হিসেবে কাজ শুরু করেন ক্রিস্টোফার। পরিবার, অর্থ, এমনকি নিজের নামটিও ছেড়ে দিয়ে ‘অ্যালেক্সান্ডার সুপারট্র্যাম্প’ ছদ্মনামে নতুন জীবনের যাত্রা শুরু করেন। এরপর বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন—নেভাদা, ক্যালিফোর্নিয়া, অ্যারিজোনা, ডাকোটা ও কলোরাডো। মাঝেমধ্যে মজুরি করে কিছু টাকা উপার্জন করলেও আবারও যাত্রা শুরু করতেন।

১৯৯২ সালের এপ্রিলে পৌঁছান আলাস্কার ডেনালি ন্যাশনাল পার্কের পাশে একটি নির্জন অঞ্চলে। সেখানকার গভীর বনে পরিত্যক্ত একটি বাসে তিন মাস একা বসবাস করেন তিনি। বাসটির নাম দেন ‘ম্যাজিক’। দিন কাটে গাছের পাতা, বেরি আর ছোটখাটো শিকার করে। তিন মাস পর ফিরে আসতে চাইলেও টেকলানিকা নদীর জল বাড়ায় পার হতে পারেননি। দীর্ঘ অভুক্ত অবস্থায় শরীর ভেঙে পড়ে। অতি কষ্টে আবার ফিরেন সেই ‘ম্যাজিক’ বাসে। অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ১৯৯২ সালের ১৮ আগস্ট। মাত্র ২৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু ঘটে প্রকৃতিরই কোলেতে। দেহ উদ্ধার হয় ১৯ দিন পর।

মৃত্যুর পর উদ্ধার হয় তাঁর চিঠি ও নোটবুক। তাতে ছিল অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, জীবনবোধ ও আত্মানুভব। জানা যায়, তিনি জানতেন আলাস্কার পথ কতটা কঠিন। তবুও নিজেকে প্রকৃতির হাতে সঁপে দিয়েছিলেন, চেয়েছিলেন মুক্ত জীবনের স্বাদ নিতে। ক্রিস্টোফারের গল্প ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। অনেকে তাঁকে দেখেন এক সাহসী অন্বেষণকারীর প্রতীক হিসেবে, আবার কেউ কেউ বলেন দায়িত্বহীন ‘বখাটে’ ধনীর ছেলে। পরিচালক শন পেন বইটি অবলম্বনে নির্মাণ করেন একই নামে বিখ্যাত চলচ্চিত্র, যা আজও বহু প্রকৃতিপ্রেমী এবং মুক্তচেতা তরুণ-তরুণীর আদর্শ।