
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরা তখনও রাজপথে; কোটা সংস্কারের দাবিতে উত্তাল আন্দোলন চলছে। চোখে আগুন, কণ্ঠে শপথ—অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর দৃপ্ত ঘোষণা। ঠিক সেই দিন রাজশাহীর আলুপট্টি এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে সন্ত্রাসীরা। জনতার সামনে একজন তরুণ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
মাথায় রক্তের দাগ নিয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তিনি মোঃ রায়হান আলী। তিন দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ৮ আগস্ট শহীদ হন তিনি। সেই দিনটি যেন রাজশাহী কলেজের সময়কে থমকে দেয়। আকাশ ভারী হয়ে ওঠে কান্নায়। কলেজ প্রাঙ্গণ আজও স্তব্ধ হয়ে যায় সেই স্মৃতিতে। ৮ আগস্ট হয়ে ওঠে রাজশাহী কলেজের ইতিহাসে এক অশ্রুসিক্ত দিন।
মো. রায়হান আলী ছিলেন হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। রাজনীতিতে ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত। ছিলেন রাজশাহী কলেজ শাখার সাবেক সভাপতি এবং মৃত্যুর আগপর্যন্ত রাজশাহী মহানগরীর ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক।
শহীদ রায়হান আলী এই প্রজন্মের ছাত্ররাজনীতিতে আদর্শের এক অনন্য বাতিঘর হয়ে উঠেছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের উত্তাল সময়টায়, যেখানে অনেকেই পেছনে ছিলেন—সেখানে তিনি সামনে এসে ছাত্রসমাজের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন; এক মুহূর্তের জন্যও পিছু হটেননি। সেই দাঁড়িয়ে যাওয়ার সাহসিকতার মধ্য দিয়েই তিনি পরিণত হন একটি আন্দোলনের প্রাণে।
কলেজের শিক্ষার্থীরা আজও বলেন, রায়হান ভাইয়ের ভালোবাসা, ব্যবহার, নেতৃত্ব—সবই ছিল নিঃস্বার্থ ও অকৃত্রিম। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী মোঃ কায়েস আহমেদ বলেন, ‘ভাই আমাদের মাঝে একজন স্বর্ণ ছিলেন। ভাই বলতেন ‘আমি আছি, তোমরা আসো।’ তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন, আড়াল থেকে নয়।’
তার মৃত্যু কেবল একটি আন্দোলনের বলিদান নয়, তা ছাত্ররাজনীতির এক নতুন অধ্যায়। ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাত বৃষ্টি বলেন, ‘আমি চাই রাজশাহী কলেজে শহীদ মোঃ রায়হান আলীর নামে একটি চত্বর হোক, যেখানে নতুন প্রজন্ম জানবে কীভাবে একজন তরুণ বুক দিয়ে নেতৃত্ব দেয়।’
তাঁর বিভাগেরই বর্তমান শিক্ষার্থী মোঃ ইমরান বলেন, ‘রায়হান ভাইয়ের গুলি খাওয়ার দৃশ্য দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। কিন্তু সেই দৃশ্যই আমাদের সাহস দেয়, আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার শক্তি দেয়। তিনি আমাদের সাহস, তিনি আমাদের আত্মা।’
এই আত্মত্যাগ কেবল রাজশাহী কলেজ নয়, পুরো জাতির জন্য গৌরবের। বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইসমত আরা বেগম বলেন, ‘রায়হান আলীর নেতৃত্ব ও সংগ্রাম ছিল একেবারে ব্যতিক্রম। রাজশাহী কলেজ থেকেই যে এমন একটি আন্দোলনের ঢেউ শুরু হবে তা ভাবিনি। কিন্তু তার মতো একজন সংগঠকের কারণেই তা সম্ভব হয়েছিল।’
শুধু শিক্ষক বা সহপাঠী নয়, কলেজ প্রশাসনও শহীদ রায়হানের অবদানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানায়। কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মুঃ যহুর আলী বলেন, ‘তিনি কেবল একজন শিক্ষার্থী ছিলেন না, ছিলেন একজন সংগঠক, একজন সাহসী যোদ্ধা। ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি ৮ আগস্ট মারা যান। কিন্তু তিনি অমর—কারণ তার রক্ত এই প্রজন্মকে জাগিয়ে তুলেছে। এই রক্তের ঋণ আমরা কোনোদিন ভুলতে পারি না।’
আজ রাজশাহী কলেজের আঙিনায় চলতে চলতে হঠাৎ যেন মনে হয়—রায়হান এখনো আছেন। পাঠাগারের করিডোরে, প্রশাসনিক ভবনের সিঁড়িতে, রাজশাহীর কোনো চত্বরে কিংবা আন্দোলনের প্রতিটি মিছিলে যেন তার পদচারণা টের পাওয়া যায়। শহীদ মোঃ রায়হান আলী আমাদের শিক্ষা দেন—কেবল দাবি নয়, নেতৃত্বের দায়িত্বও নিতে হয়। জীবন দিয়ে হলেও আদর্শের প্রতি অটল থাকতে হয়। এই প্রজন্মের কাছে তিনি কেবল একজন শহীদ নন, তিনি এক জীবন্ত প্রেরণা।