Image description

তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আট মাসের মধ্যে সাফের শিরোপা জেতে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল। পরের সময়টা ছিল বেশ টালমাটাল। তাঁর বিরুদ্ধে ফুটবলারদের বিদ্রোহের ডাক, সিনিয়রদের রেখে নতুন দল গঠন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে হারের তেতো স্বাদ। সেসব পেছনে ফেলে এবার ইতিহাস গড়ে এশিয়ান কাপে জায়গা করে নিয়েছে মেয়েরা। এই আলো–ছায়ার অধ্যায়ের বড় অংশজুড়েই ছিলেন কোচ পিটার বাটলার। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেছেন সেই অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা—

প্রথম আলো

প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপে বাংলাদেশ। এই অর্জনকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

‎পিটার বাটলার: দলের খেলোয়াড়দের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমরা একটি কঠিন সময় পেরিয়ে এসেছি, যাত্রাটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমী মানুষ এবং কিছু তরুণ সম্ভাবনাময়ী খেলোয়াড়ের জন্য আমি এখানে থেকে গেছি। আমরা প্রস্তুতির জন্য সহজ সুন্দর একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিলাম, যেটা মেয়েরা দারুণভাবে বাস্তবায়ন করেছে। রক্ষণভাগে আমরা অনেক উন্নতি করেছি, আর এখন সবার মধ্যে পরিশ্রমের মানসিকতাও তৈরি হয়েছে। আগে তারা কপি-পেস্ট করত, যা মনে আসত তা-ই করত।‎

প্রথম আলো

এত দিন মেয়েরা দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডিতে আটকে ছিল। এখন এশিয়ার অন্যতম সেরা দল। পরিবর্তনটা কীভাবে হয়েছে?

বাটলার: কোনো কিছুই রাতারাতি বদলানো যায় না। ফুটবলে উন্নতির জন্য শর্টকাট কোনো পথ নেই। এটা পুরোপুরি কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ, কষ্ট আর ধৈর্যের ফল। আমরাও সেভাবে এগোচ্ছি।

এশিয়ান কাপে জায়গা করে নেওয়ার পর বাংলাদেশ দলের উচ্ছ্বাস
এশিয়ান কাপে জায়গা করে নেওয়ার পর বাংলাদেশ দলের উচ্ছ্বাসবাফুফে
প্রথম আলো

এশিয়ান কাপে বাংলাদেশকে আরও কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে। সেই পরীক্ষায় ভালো করতে হলে আগামী আট মাসে মেয়েদের প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত?

‎বাটলার: আমি এই প্রতিভাবান দলটির সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করেছি, যেন তারা আগের সরাসরি খেলার ধরন থেকে বেরিয়ে এসে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, সৃজনশীলভাবে এবং কঠোর পরিশ্রম করে খেলতে শেখে। এই পরিবর্তনের ফলাফল আমরা পেয়েছি এবং দল হিসেবে আমরা যা অর্জন করেছি, আমি অত্যন্ত গর্বিত। এটা ব্যক্তিগত নয়, সম্মিলিত সাফল্য। এই ধরন আর ছন্দটা ধরে রাখতে হবে। জানি, আমাদের সামনের পথটা আরও কঠিন। আমার বিশ্বাস, এভাবে পরিশ্রম করলে সেখানেও ইতিবাচক কিছু করা সম্ভব। পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। আমাদের একটা যথাযথ পরিকল্পনা করতে হবে। সে অনুযায়ী অনুশীলন এবং বড় দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত ম্যাচ খেলতে হবে।

 
প্রথম আলো

সব সময় আপনি দলের শৃঙ্খলার ব্যাপারে কঠোর ছিলেন। যে কারণে অনেকে আপনার বিরোধিতাও করে। ফুটবলে শৃঙ্খলা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

বাটলার: শুধু ফুটবল নয়, শৃঙ্খলা সব ক্ষেত্রেই দরকার। এটা সবকিছুর মূল ভিত্তিও। শৃঙ্খলা না থাকলে কোনো কিছুই ঠিক থাকে না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে অনেকেই নিজের মতো করে চলত। এখন আমাদের দলে শৃঙ্খলা এসেছে, আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি।

শৃঙ্খলা ইস্যুতে এক বিন্দুও ছাড় দেন না পিটার বাটলার
শৃঙ্খলা ইস্যুতে এক বিন্দুও ছাড় দেন না পিটার বাটলারছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো

‎বাংলাদেশে নারী ফুটবলের কোনো কাঠামো নেই। নিয়মিত লিগ হয় না। এসব নিয়ে কী বলবেন?

বাটলার: আসলেই একটা কাঠামো দরকার। এভাবে তো চলতে পারে না। এখানকার অবস্থা খুবই বাজে। কোনো লিগ নেই, আর বছরের পর বছর কোনো পরিকল্পনা না থাকায় হঠাৎ করে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোও কোনো কাজে আসেনি। আমি জানি না, তারা এখন কোন পথে যাবে। হয়তো বাফুফের অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে, কিন্তু আমাকে সেটা জানানো হয় না। তাই তাদের ভাবনা কী—সেটা আমার জানা নেই।

প্রথম আলো

ফুটবলাররা প্রায়ই তাঁদের খাবারের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। মেয়েরা কি সঠিক পুষ্টিকর খাবার সত্যিই পাচ্ছেন না?

বাটলার: দেখুন, খাবার শক্তির উৎস। আমি যখন দায়িত্ব নিয়েছিলাম, তখন দেখতাম মেয়েরা পিৎজা আরও এমন অনেক কিছু অর্ডার দিয়ে খেত। এটাতে কি আর পরিপূর্ণ পুষ্টি মেলে? একজন ফুটবলারের জন্য ভালো পুষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি সঠিক খাবার ও ডায়েট অত্যন্ত জরুরি। আমি বুঝতে পারছি না, কেন খেলোয়াড়দের খাবার এবং পুষ্টির ব্যাপারে এতটা অবহেলা করা হচ্ছে।

মেয়েদের খাবার ও পুষ্টির ব্যাপারে অবহেলা করা হচ্ছে বলে মনে করেন পিটার বাটলার
মেয়েদের খাবার ও পুষ্টির ব্যাপারে অবহেলা করা হচ্ছে বলে মনে করেন পিটার বাটলারছবি: এএফসি
প্রথম আলো

এশিয়ান কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলার পথও সুগম করেছে। আপনি কতটা আশাবাদী?

‎বাটলার: আমাদের ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে হবে। যদিও আমরা এখনই অনেক বড় কিছুর আশা করে ফেলছি। আমরা তো মাত্রই কোয়ালিফাই করলাম, এখন বাস্তবমুখী পরিকল্পনা করতে হবে এবং আমাদের প্রত্যাশাগুলো সঠিকভাবে সাজাতে হবে। এখানে বেশি আশা করে কম পাওয়াটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আমি মনে করি, আমাদের পরিকল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে এমন সব প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলতে হবে, যারা আমাদের পরীক্ষা নেবে। মনে রাখবেন, একটা দল বোর্ডরুম বা অফিসে উন্নতি করে না, খেলোয়াড় আর দল শুধু এক জায়গায় উন্নতি করে—সেটা হলো ট্রেনিং গ্রাউন্ড। আমি মিছে স্বপ্ন দেখাতে চাই না, আমি একজন বাস্তববাদী মানুষ।

প্রথম আলো

মেয়েদের এই পারফরম্যান্স ধরে রাখতে এবং উন্নতি করতে আরও কী করা যায়?

বাটলার: কিছু সমস্যার সমাধান দ্রুতই হওয়া উচিত এবং প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করা জরুরি। বছরের পর বছর মেয়েরা এবং কোচরা হতাশ হয়েছেন, তাই প্রথমেই মৌলিক বিষয়গুলো ঠিক করতে হবে। আমরা স্বপ্ন দেখতেই পারি, কিন্তু প্রতিশ্রুতি যদি পূরণ না করি এবং খেলোয়াড় ও কোচদের সহায়তা না করি, তাহলে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা কঠিন। হ্যাঁ, কথা দেওয়া সহজ, কিন্তু কাজ করাই সবচেয়ে বড় কথা। ভুটানে খেলে বাংলাদেশের ফুটবলারদের তেমন উপকার হবে না, এটা শুধু একটি অস্থায়ী সমাধান।

প্রথম আলো

তাহলে স্থায়ী সমাধান কী?

‎বাটলার: আমি মনে করি, দেশে একটি সঠিকভাবে গড়ে ওঠা ছয়টি দল নিয়ে লিগ থাকতে হবে, এর বেশি নয়। জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের সুন্দর ও সমানভাবে এই দলগুলোর মধ্যে খেলার সুযোগ করে দিতে হবে। শেষ লিগটা ছিল একেবারে নিষ্ফলা। ১৭-০ স্কোরে জেতা কোনো অর্জন নয়। আমাদের একটি ছোট লিগ দরকার, যেখানে প্রতিটি দল ১০টি করে ম্যাচ খেলবে। যা ছয় মাসের মধ্যে তিনটি ব্লকে ভাগ করে খেলানো হবে।

গত বছরের মার্চ থেকে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের প্রধান কোচের দায়িত্বে আছেন পিটার বাটলার
গত বছরের মার্চ থেকে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের প্রধান কোচের দায়িত্বে আছেন পিটার বাটলারছবি: শামসুল হক
প্রথম আলো

আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক মেয়ে আপনার চিন্তাভাবনা আর নিয়মকানুন পছন্দ করেননি, তাঁরা বিদ্রোহ করেছিলেন। এই দলের সবাই কীভাবে সেগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন?

‎বাটলার: শৃঙ্খলাপরায়ণ ও ন্যায়সংগত থাকা—আমি আমার কোচিংয়ের এত দিনের অভিজ্ঞতায় এ দুটি বিষয়ে কখনো ছাড় দিইনি। সব সময় খেলোয়াড়দের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিই। কখনো পক্ষপাত করি না এবং কপি-পেস্ট কোচিংয়ে বিশ্বাস করি না। আমি একজন টেকনিক্যাল কোচ, যে কিনা নিজের খেলোয়াড়ি ও কোচিং ক্যারিয়ারে অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা খেলোয়াড়দের সঙ্গে ভাগ করে নিই। আমি খেলোয়াড়দের সব সময় বিনয় ও শ্রদ্ধার গুরুত্ব বোঝাই। কারণ, এ গুণগুলো ছাড়া আমরা কোথাও যেতে পারব না। হিংসা ও তিক্ততা কঠিন অনুভূতি, কিন্তু খেলোয়াড়দের এগুলো সামলানো শিখতে হবে।