মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মাতৃভূমির প্রতি মানুষের এ দুর্নিবার আকর্ষণ বা ভালোবাসা, গভীর আবেগ-অনুভূতি ও মমত্ববোধকে বলে দেশপ্রেম। দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষায় স্বদেশপ্রেম অত্যাবশ্যক। ইসলাম বরাবরই মানুষকে জন্মভূমির প্রতি প্রেম-ভালোবাসা পোষণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। নবি করিম (সা.) ও সাহাবিদের জীবনে এর অসংখ্য উদাহরণ বিদ্যমান। মহানবি (সা.) দেশকে খুব ভালোবাসতেন। মক্কার কাফেরদের নির্মম নির্যাতনে যখন জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করছিলেন, তখন তিনি বারবার মক্কার দিকে ফিরে তাকাচ্ছিলেন আর কাতর কণ্ঠে আফসোস করে বলছিলেন, ‘হে মক্কার ভূমি! তুমি কতই না সুন্দর! আমি তোমাকে কতই না ভালোবাসি। আমার আপন গোত্রের লোকেরা যদি বের করে না দিত, আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’
শেষ নবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আদর্শে উজ্জীবিত সব যুগের ওলামায়েকেরাম মাতৃভূমি ও মাটির জন্য সংগ্রাম করেছেন। ইসলাম ও মানবতাবিরোধি সব অপশক্তির মোকাবিলায় আমৃত্যু লড়াই করেছেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে জুলাই বিপ্লব পর্যন্ত আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি সংকট, সমস্যা ও দুর্দিনে এ দেশের আলেমসমাজ অগ্রসৈনিকের ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের আলেমরা সবসময়ই ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায়ের বিপক্ষে। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান অনেকটাই অন্তরালে থাকার কারণে বিগত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার দোসররা আলেমদের স্বাধীনতাবিরোধী হিসাবে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করেছে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের স্বাধীনতাবিরোধী স্লোগানটি মূলত দেশ থেকে ইসলাম ও সত্যিকার দেশপ্রেমিক আলেমদের প্রতিহত করার অপকৌশল ছিল। ইসলাম ও আলেমদের বিরুদ্ধে যখনই যারা ষড়যন্ত্র করেছে, আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাদের কখনো কখনো ছাড় দিয়েছেন কিন্তু ছেড়ে দেননি। ফেরাউন, নমরুদ, কারুন, শাদ্দাদ, আবু জাহেল, আবু লাহাবের মর্মান্তিক পতনের কথা আমাদের সবার জানা। ৩৬ জুলাই শেখ হাসিনা ও তার অনুগত ফ্যাসিস্টদের পতন ছিল মূলত তারই ধারাবাহিকতা। আল্লাহ বলেন, তারা আল্লাহর নুর ফুঁৎকারে নেভাতে চায়, আর আল্লাহ্ তাঁর নুরকে পূর্ণতাদানকারী, যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে। (সুরা সফ-৮)।
শেখ হাসিনা ও তার ফ্যাসিবাদী রাজনীতির পতনের ঘণ্টা বেজেছিল মূলত ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। আল্লাহ ও রাসুল এবং পবিত্র কুরআন-হাদিসের অবমাননাকারীদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম অবরোধপরবর্তী যে সমাবেশ করেছিল, সেটি ছিল ফ্যাসিবাদের প্রথম পতনধ্বনি।
সম্প্রতি ৩৬ জুলাই ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে এর সফল ও চূড়ান্ত সমাপ্তি হয়। কতিপয় নাস্তিক-ব্লগার, আল্লাহ ও রাসুল, পবিত্র কুরআন-হাদিস অবমাননাসহ ইসলাম, মুসলমান এবং আলেম-ওলামাদের হেয়প্রতিপন্ন করার হীন চেষ্টা চালিয়েছিল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে হরদম মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে জাতিকে বিভক্ত করার অপতৎপরতা চালিয়েছিল, তখনই এদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম শান্তিপূর্ণভাবে রাজধানী ঢাকা অবরোধ করে। বাংলাদেশের হক্কানি ওলামা-পির-মাশায়েখ, আশেকে রাসুল (সা.) ও দেশপ্রেমিক ইমানদার জনতার জন্য সেটি ছিল রক্তঝরা এক ঐতিহাসিক দিন। কেননা ওই দিনের ট্র্যাজেডি মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত মর্মন্তুদ ও বেদনাদায়ক। সারা দিন অবরোধে অবস্থান নেওয়া হেফাজত কর্মীরা যখন ক্ষুধা, পিপাসায় ক্লান্ত তখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের জন্য সরবরাহকৃত খাবার ও পানির গাড়ি বন্ধ করে দেয়। সন্ধ্যা থেকেই বন্ধ করে দেয় রাস্তার লাইট। মতিঝিলের আশপাশের বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে বিটঘুটে অন্ধকার তৈরি করে নিরস্ত্র নবিপ্রেমিক ইমানদার সৈনিকদের ওপর ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে।
যুগান্তর পত্রিকার রিপোর্ট মতে ১ লাখ ৫৪ হাজার গুলি, রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস, পিপার গান, বৃষ্টির মতো সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়েছে পুলিশ-র্যাব-বিজিবির যৌথবাহিনী। নিরীহ, নিরপরাধ, তাহাজ্জুদ গুজার, জিকিররত আলেম হাফেজ ও আশেকে রাসুলদের ওপর। এই নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে হানাদার বাহিনীর বর্বরতার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে গণহত্যা চালিয়ে যৌথ বাহিনী ইতিহাসে এক নতুন কারবালা সৃষ্টি করেছিল। ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে যারা রক্ত দিয়েছেন, যারা আহত হয়েছেন, তারা কেবল মহান আল্লাহ ও প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ভালোবাসা নিয়ে ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস ছিল শাপলার শহিদদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না।
মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে ইমানি আন্দোলন বন্ধ করার নানা চক্রান্ত করেছে বিগত সরকার। এ দেশের আলেম সমাজকে সত্য-ন্যায়ের আন্দোলন থেকে একমুহূর্তের জন্য নিবৃত্ত করা যায়নি।
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে রাজপথে রক্তের স্রোত প্রবাহিত করে দেশের আলেম সমাজ এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা। কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার পাশে আলেমরা ধারাবাহিকভাবে সক্রিয় ছিলেন। জুলাই বিপ্লবে ৭০ জনের বেশি হাফেজ, আলেম শাহাদতবরণ করেছেন। এ আন্দোলনে ইসলামপন্থিদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া দেশের আলেম সমাজ গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনে সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা ছিল পুরোদস্তুর রণক্ষেত্র। সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার সঙ্গে রাজপথে নেমে এসেছিল আলেমসমাজও।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সুযোগ নিয়ে পতিত সরকারের কতিপয় দুষ্কৃতকারী সংখ্যালঘুদের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে দেয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে মাদ্রাসার ছাত্ররা দেশের বিভিন্ন মন্দির প্রাঙ্গণে অবস্থান নিয়ে পাহারা দেন। এভাবে বিশ্ববাসীর সামনে সাম্য ও সম্প্রীতির এক বিরল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেন আলেম-ওলামা এবং মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা, যা বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমের খবরেও প্রকাশিত হয়েছে।
এ গণ-অভ্যুত্থান শুধু গণ-আন্দোলন ছিল না; বরং এটি ছিল বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘ শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি ঐতিহাসিক ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পুনর্জাগরণ। এ বিপ্লবের ফসল ঘরে তুলতে হলে জাতীয় মতৈক্যের ভিত্তিতে জরুরি সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা খুবই জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ ও অকার্যকর হতে দেওয়া যাবে না।
লেখক : যুগ্ম মহাসচিব, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ও আমির, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস