বডি শেমিং খুব বাজে একটা ব্যাপার এবং অবশ্যই অগ্রহণযোগ্য। বডি শেমিংয়ের প্রতিবাদ জানিয়েই লেখা শুরু করছি। মাসুদ কামাল, সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি রয়েছে যার। এখনকার পরিচিতি ইউটিউবার। ফ্যাসিস্ট রেজিমের শেষের দিকে খুব উচ্চকণ্ঠ ছিলেন রেজিমের নানাবিধ অপকর্মে বিরুদ্ধে। বিশেষ করে মোস্তফা ফিরোজের সাথে মিলে অনলাইনে ‘টক-শো’র মাধ্যমে তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কেন তিনি এত ভোকাল ছিলেন সে আলাপ পরে করছি, আগে বডি শেমিংয়ের বিষয়টি শেষ করে নিই। মাসুদ কামালের সাদা চুল নিয়ে এক ফেসবুক অ্যাক্টিভিসস্ট টিপ্পনী কাটলেন, ‘চুল সাদা হলেই যদি বড় সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী হওয়া যেতো, তাহলে ভেড়াই সবচেয়ে বড় সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী হতো’। মোটা মাথার এমন তুলনা আপাতদৃষ্টিতে অনেকটাই ঠিক মনে হয়। কিন্তু ঝামেলা বাঁধে তখনই যখন দেখি বর্তমান উপদেষ্টাদের অনেকের মাথার চুলই সাদা। বিশেষ করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের কথা বলতেই হয়, তার সব চুল শ্বেত-শুভ্র। কিন্তু ‘অধিকার’ খ্যাত আদিলুর রহমানকে যদি মাসুদ কামালের সমপর্যায়ে ফেলা হয় তাহলে তো মুশকিল। সুতরাং বডি শেমিং করার সময় সবদিক চিন্তা করে করাই ভালো। আরেকটি কথা, ভেড়ার লোম শুধু সাদাই হয় না, কালোও হয়। সাদার চেয়ে কালো ভেড়ার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। কালো ভেড়ার খ্যাতিও রয়েছে।
মাসুদ কামালকে খ্যাত করেছে কয়েকটি টেলিভিশন তাদের ‘টক-শো’ গেস্ট হিসেবে। আর বিখ্যাত করেছেন মোস্তফা ফিরোজ তার ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে। সম্ভবত এই ভদ্রলোক পপুলিস্ট। হাওয়া বুঝে কাজ করে ফায়দা লুটতে চান। ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধে তার কথা শুনে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছেন। মনে হয়েছিলো তার চেয়ে বড় বিপ্লবী বোধহয় আর কেউ নেই। কেউ ভেবেছিলেন তিনি ভীষণ সাহসী একজন মানুষ। তার সাহসের উৎস ছিল তার আদর্শিক অবস্থান। আওয়ামী লীগের জানা ছিল তিনি তাদের লোক। তাকে ওভাবেই সেট করা হয়েছিল। যাতে তিনি আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে জনপ্রিয়তা পান এবং সময়মতো আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলেন। আওয়ামী লীগের বিপক্ষে বলে এসেছেন, এখন যদি আওয়ামী লীগের পক্ষে বলেন, তাহলে নিরপেক্ষ হিসেবে সে কথার একটা গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হবে এবং সেটা হবে আওয়ামী লীগের ক্যাশ। মাসুদ কামালের ন্যারেটিভ হলো সেই ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’র মাল।
সিরিয়ার দিকে তাকাই। জুলাই বিপ্লবের আদলে সংঘটিত হয়েছে সিরিয়ায় বিপ্লব। কিন্তু পার্থক্য হলো বিপ্লব পরবর্তী অবস্থায়। সিরিয়ার বিপ্লবী সরকার ফ্যাসিস্ট আসাদের দল নিষিদ্ধ করেছে। সংবিধান বাতিল করেছে। ফরাসি বিপ্লবের আদলে আসাদ সমর্থক সরকারি কর্মকর্তাদের শাস্তি দিয়েছে এবং তাও মৃত্যুদণ্ডের মতন কঠোর শাস্তি। সারাবিশ্বের কেউ সিরিয়ার বিপ্লবী সরকারের এহেন কর্মকাণ্ডের কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছেন, কোনো দেশ কঠোর অবস্থানে গিয়েছে, এমন ঘটনা প্রকৃত অর্থে নেই। আমাদের বিপ্লবকে বেহাত বা ব্যর্থ বলা হচ্ছে সম্ভবত এই অর্থেই। অর্থাৎ বিপ্লব পরবর্তীতে আমাদের গঠিত সরকার বিপ্লবী সরকারে রূপ নেয়নি। চলছে প্রচলিত ধারাতেই। কেউ কেউ বলতে চেষ্টা করছেন, এজন্যেই সরকারের বিরুদ্ধে এত সমালোচনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারকে সামাল দিতে হয়েছে দেড়শ’র বেশি আন্দোলন এবং এখনও হচ্ছে। যদি সরকার বিপ্লবী হতো তাহলে এমন কিছু ঘটানোর সাহস কেউ পেতো না। কিন্তু মুশকিল হলো সিরিয়ার বিপ্লবের ধরণ এবং আমাদের বিপ্লবের ধরণ নিয়ে। সিরিয়ায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হয়েছে বিপ্লবীদের। আমাদের বিপ্লবে সেনাবাহিনী ছিল বিপ্লবীদের পক্ষশক্তি। তারা বিপ্লবীদের প্রতি গুলি চালাতে অস্বীকার করেছিলো। আর সে কারণেই বিপ্লব উজ্জীবিত হয়েছিলো, অগ্নিগর্ভ হয়েছিলো। অন্য একটি বড় পার্থক্য হলো দুই দেশের সরকার প্রধানের বৈশ্বিক প্রভাব ও ইমেজের। ড. ইউনূস ও আল-বশির এক কথা নয়। এ বিষয়েও বিশদ আলোচনা করা যাবে আরেক সময়, অন্য লেখায়। এখন শুধু প্রেক্ষাপটের প্রয়োজনে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলাম।
আজকের আলোচনায় ফিরি। পিনাকী ভট্টাচার্য বলার আগেই আমি লিখেছিলাম। সম্ভবত প্রথম আলো, যুক্তরাষ্ট্র ছেপেছিল লেখাটি। বলেছিলাম ভারত ড. ইউনূসের সাথে নেগোশিয়েশনে ব্যর্থ হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি ক্রমেই ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক ইমেজের কাছে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছেন। যেমন ইন্দিরা গান্ধী নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছিলেন জিয়াউর রহমানের কাছে। ফলে জিয়াইর রহমানকে হঠানোর মিশন নিতে হয়েছিলো তাকে। সম্ভবত ড. ইউনূসকে হঠানোর মিশনও নেয়া হয়েছে সেই কায়দায়।
কিন্তু সময়ের ফেরে অ্যাসাসিনেশন হয়তো সম্ভব নয়, তাই প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে প্রোপাগান্ডার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। সে প্রোপাগান্ডার বাহক হলো গণ ও সামাজিকমাধ্যম। আনন্দবাজার, রিপাবলিক টিভি’র সাথে উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন এপারের কেউ কেউ। এই যে মাসুদ কামাল, নবনীতাসহ অন্যান্যরা সেই মিশনেরই অংশ। এই প্রোপাগান্ডা মিশন যে এখন আর ট্রলের ব্যাপার নয় তা আনন্দবাজারের রিপোর্ট দেখলেই বোঝা যায়। আনন্দবাজার লিখলো, ‘সেনা অভ্যুত্থান ঢাকায়? নজর দিল্লির’। ভেবে দেখুন প্রোপাগান্ডা কোন জায়গাতে পৌঁছেছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রতিবাদ জানানো উচিত, তাই জানানো হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র প্রতিবাদই কি শেষ কথা?
সফট্ পাওয়ার নিয়ে লিখেছি কদিন আগেই। সফট্ পাওয়ারের কাজ হলো নানান ন্যারেটিভ তৈরি করে দেয়া। অর্থাৎ পথ তৈরি করে দেয়া। ভারতীয় মিডিয়া এবং এদেশের দোসররা মিলে সেই পথ তৈরির কাজ করে চলেছে। অঞ্জন রায়রা ছিলেন প্রকাশ্যে। এখন যারা উচ্চকিত তারা স্লিপার সেল এর সদস্য হিসেবে ছিলেন। স্লিপার সেল এর কাজ হলে বিপক্ষের পক্ষে থাকা এবং প্রয়োজনে স্বরূপে আবির্ভূত হওয়া। তারা তাই হয়েছেন।
ভারতীয় মিডিয়া এবং তাদের যোগসূত্রটা বুঝতে হবে। এই যোগসূত্রের কারণটা বুঝতে হবে। স্লিপার সেল হলো সর্বশেষ অবলম্বন। মিডিয়া ওয়ারটাও তাই। হিটলারিয় পদ্ধতি, এক মিথ্যাকে বারবার বলে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। অথচ তাদের বোধ-বুদ্ধি এতই ডগমাটিক যে, সতেরো বছর ধরে তৈরি করা ন্যারেটিভ যে ব্যর্থ হয়েছে তা বোঝার ক্ষমতা তাদের রহিত হয়ে গেছে। সতেরো বছর ধরে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচিতে বাধ্যতামূলক সেই ন্যারেটিভ তথা বয়ান পড়ানো হয়েছে। প্রচার করা হয়েছে গণমাধ্যমসহ সব মাধ্যমে তৈরি বয়ান। কিন্তু মানুষ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম সেই বয়ানকে বিশ্বাস করেনি। সেই ন্যারেটিভকে সত্য ভাবেনি। ভাবলে জুলাই বিপ্লব সংগঠিত এবং সংঘটিত হতো না। জুলাই চব্বিশ ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছে। একে অস্বীকার করা কিংবা এর বিপরীতে বিপ্লব বিরোধী শক্তিকে উৎসাহিত করাকে ইতিহাস দেখবে সঙ্গতই বাঁকা চোখে। অথচ কী আশ্চর্য কেউ কেউ জেনেশুনেই ‘মীর জাফর’ হতে চায়।