বিভিন্ন দাবিতে গতকাল রোববার রাজধানীর চারটি স্থানে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেছেন শিক্ষার্থী, জুলাই অভ্যুত্থানের আহত ছাত্র-জনতা এবং চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যরা। এতে মহানগরীর বড় এলাকাজুড়ে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়।
দিনভর বিশেষ করে শিশু, নারী, বৃদ্ধ, অসুস্থ মানুষ ও ইজতেমাফেরত মুসল্লিদের পড়তে হয়েছে ভোগান্তিতে। কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সময়ে-অসময়ে নানা দাবিদাওয়া নিয়ে রাজপথ দখল করায় ভুগছেন নগরবাসী।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে মিরপুর রোডের শ্যামলী আশা ইউনিভার্সিটির
সামনে সড়ক অবরোধ করেন জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা। এতে সড়কের উভয় পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আটকে পড়া গাড়িতে যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে বাধ্য হন। অনেকে হেঁটেই গন্তব্যে রওনা দেন। আসাদ গেট থেকে গাবতলীর পথে হাজারো মানুষকে হেঁটে যেতে দেখা যায়। কেউ কেউ রিকশা বা অটোরিকশায় বেশি ভাড়ায় গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে জায়গায় জায়গায় পথ বন্ধ থাকায় রিকশাও ছিল প্রয়োজনের তুলনায় কম।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পথচারীদের মধ্যে বেশি বেকায়দায় পড়েন বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা। তাদের নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফুটপাতে বসেই বিশ্রাম নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এ সময় অনেককেই দুর্ভোগের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। রোকেয়া নামের এক সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ বাসে সাভার থেকে ফেরার পথে কল্যাণপুরে আটকা পড়েন। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর বাস ছেড়ে লাঠিতে ভর দিয়ে ফুটপাত ধরে তিনি শ্যামলী পর্যন্ত হেঁটে আসেন। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটায় তিনি হাঁপাচ্ছিলেন। কয়েকজন পথচারী তাঁকে আন্দোলনকারীদের ব্যারিকেড পার করে অটোরিকশা ভাড়া করে দেন।
আমজাদ আলী নামের এক ব্যক্তি পরিবার নিয়ে বাসে চড়ে যাত্রাবাড়ী থেকে গাবতলীর উদ্দেশে বেরিয়েছিলেন। রাস্তা আটকা থাকায় মানিকমিয়া অ্যাভিনিউতে বাস থেকে নেমে যান। সেখান থেকে তিনি হাঁটা শুরু করেন। আমজাদের চূড়ান্ত গন্তব্য মানিকগঞ্জ। তাঁর কোলে ছোট্ট দুই শিশু, মাথায় ব্যাগ, পেছনে স্ত্রী জুতা হাতে নিয়ে হাঁটছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে আমজাদ আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সাধারণ মানুষকে এ কষ্ট সহ্য করতে হবে কেন? রাস্তা ছেড়ে সরাসরি সরকারের কাছে গিয়ে দাবি জানানো উচিত।’
কল্যাণপুর-শ্যামলী এলাকায় জাতীয় প্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ ৮-৯টি হাসপাতাল থাকায় বহু রোগী ভোগান্তির শিকার হন। যানজট এবং সড়ক বন্ধ থাকার কারণে অনেক অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালের দিকে যেতেই পারেনি। কর্মসূচির সামনে পৌঁছাতে পারলে অবশ্য অ্যাম্বুলেন্সকে যেতে দেওয়া হয়েছে। নিরূপায় অনেক রোগী দীর্ঘ পথ হেঁটে হাসপাতালে গেছেন। কেউ কেউ পথ চলছিলেন স্বজনদের কাঁধে ভর দিয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে টানা সড়ক অবরোধ করে যাচ্ছেন মহাখালী এলাকার তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। গতকালও তাঁরা মহাখালী-গুলশান সড়ক অবরোধ করেন। এতে ময়মনসিংহ সড়ক ও বাড্ডা লিংক রোডে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানীর উত্তরাংশের প্রধান দুটি সড়কে অবরোধ থাকায় সাধারণ পথচারী ও যানবাহনের আরোহীদের পাশাপাশি ইজতেমা শেষে ঘরফেরত মুসল্লিরা ভোগান্তিতে পড়েন। তাঁরা ভারী বিছানাপত্র নিয়ে হাঁটতে বাধ্য হন।
শরীফুল নামের এক মুসল্লি বলেন, উত্তরা থেকে কুর্মিটোলা পর্যন্ত তাঁরা গাড়িতে আসেন। পরে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে মহাখালী পর্যন্ত আসেন। যাবেন পুরান ঢাকার সদরঘাটে। মহাখালী থেকে তাঁরা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে রওনা দিচ্ছেন। জানেন না সামনে পথের কী অবস্থা!
গতকালই জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ‘সেফ এক্সিট দেওয়ার’ (নিরাপদে পালানোর সুযোগ) প্রতিবাদে ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগসহ চার দফা দাবিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে ইনকিলাব মঞ্চ। বেলা আড়াইটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে জমায়েত হয়ে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দিকে মিছিল নিয়ে রওনা হন। পুলিশ শিক্ষাভবনের সামনে ব্যারিকেড দিয়ে মিছিলটি আটকে দিলে হাইকোর্ট, বঙ্গবাজার ও সচিবালয়ের সামনে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চাকরি হারানো পুলিশ সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে হাইকোর্টের সামনের সড়কে বিক্ষোভ করেন। এর আগেও কয়েক দফায় রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নিয়ে তাঁরা বিক্ষোভ করেছেন। চাকরিচ্যুত ওই পুলিশ সদস্যদের পরিবারের সদস্যরা গতকাল দুপুর ১২টার পর থেকে হাইকোর্ট মাজার চত্বরে জড়ো হতে শুরু করেন। ওই পুলিশ সদস্যদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক কারণে তাঁদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল।
পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আলম বলেন, আন্দোলনরত পুলিশ সদস্যদের দাবির বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য পুলিশ সদর দপ্তর একটি কমিটি গঠন করেছে। সে কমিটি কাজ করছে।
গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কিছুদিন পর থেকে রাজধানীতে কার্যত যখন-তখন সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে বিভিন্ন পক্ষের এ ধরনের কর্মসূচি চলে আসছে। নগরবাসী প্রায়ই ভোগান্তির শিকার হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও এ চিত্রের পরিবর্তন নেই। শাহবাগ মোড় ও জাতীয় প্রেসক্লাবসহ ব্যস্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রায়ই বন্ধ হচ্ছে দাবিদাওয়া প্রতিবাদ-বিক্ষোভে। গুরুত্বপূর্ণ মোড় শাহবাগ অচল করা থেকে বিরত থাকার জন্য প্রশাসনের আহ্বান হচ্ছে উপেক্ষিত। পর্যবেক্ষকদের মতে, আন্দোলনকারীরা দৃশ্যত দাবি পূরণের একটি কার্যকর উপায় হিসেবে বেছে নিচ্ছেন রাজপথ দখল করাকে।