টাঙ্গাইলের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক হত্যা মামলায় খালাস পেলেন টাঙ্গাইল-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) আমানুর রহমান খান রানা, তাঁর তিন ভাই সহিদুর রহমান খান মুক্তি, জাহিদুর রহমান খান কাকন, সানিয়াত রহমান খান বাপ্পাসহ ১০ জন। তবে এই মামলায় কবির উদ্দিন এবং মোহাম্মদ আলী নামের দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক মো. মাহমুদুল হাসান এই রায় ঘোষণা করেন।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত দুজন হচ্ছেন মোহাম্মদ আলী ও কবির হোসেন। মোহাম্মদ আলী ২০১৪ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ফারুক হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। তাঁর জবানবন্দিতে এই হত্যার সঙ্গে আমানুর রহমান ও তাঁর ভাইদের জড়িত থাকার বিষয়টি বের হয়ে আসে। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর তিনি পলাতক। অপর দণ্ডিত কবির হোসেন ২০১৪ সাল থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন।
রানা ও তাঁর তিন ভাই ছাড়া বেকসুর খালাসপ্রাপ্ত অন্যরা হচ্ছেন সানোয়ার হোসেন সানু, নূরু, বাবু, ফরিদ হোসেন, মাসুদুর রহমান, আলমগীর হোসেন চাঁন।
মামলায় ১৪ জন আসামি ছিলেন। মামলা চলাকালে দুই আসামি আনিসুল ইসলাম রাজা ও মো. সমীর কারাগারে মারা যান।
রায় ঘোষণার সময় কারাগার থেকে সহিদুর রহমানকে হাজির করা হয়। এ ছাড়া জামিনে থাকা আসামি বাবু ও নূরু হাজির হন। তবে রানা ও অন্য দুই ভাই পলাতক।
এরপর পৃষ্ঠা ৭ কলাম ৩
আসামিপক্ষের আইনজীবী নাসির উদ্দিন খান বলেন, এই মামলায় ২৭ জনের সাক্ষ্য রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপন করেছিল। আসামিদের নাম কেউ প্রমাণ করতে পারেননি যে তাঁরা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যে সময় ঘটনা ঘটেছে বলা হয়েছে; তখন সহিদুর রহমান খান মুক্তি সস্ত্রীক ভারতে ছিলেন চিকিৎসার জন্য, তাঁর ভাই কাকন মালয়েশিয়াতে ছিলেন, সাবেক এমপি রানা ঘাটাইলে একটি অনুষ্ঠানে এবং তাঁদের ছোট ভাই বাপ্পা ঢাকায় ছাত্রলীগের অফিসে ছিলেন।
অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান আরও বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে তাঁদের (আসামি) মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছিল। এই রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পেয়েছি।’
রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাইদুর রহমান ওরফে স্বপন বলেন, দণ্ডিত দুজনকে ৫ লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য তাঁরা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় নিহত ফারুক আহমেদের ছেলে আহমেদ মজিদ সুমন মোবাইল ফোনে বলেন, মামলা দায়ের থেকে তদন্ত, আদালতে অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্য গ্রহণ বিভিন্ন পর্যায়ে আসামিরা বিচারপ্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। তা ছাড়া এই মামলার আসামিদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবী নেতারা। তাঁরা ৫ আগস্টের পর আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এসব আইন কর্মকর্তা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। এর আগেও আসামিদের ভয়ে ওই আইনজীবীরা স্বাভাবিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি বলে মন্তব্য করেন সুমন।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয় কলেজপাড়া এলাকায় তাঁর বাসার কাছ থেকে। ঘটনার তিন দিন পর তাঁর স্ত্রী নাহার আহমেদ বাদী হয়ে টাঙ্গাইল সদর থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন। ২০১৪ সালের আগস্টে এই হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আনিসুল ইসলাম রাজা ও মোহাম্মদ আলী নামের দুজনকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাঁরা আদালতে জবানবন্দি দেন। তাঁদের জবানবন্দিতে আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক এমপি আমানুর রহমান খান রানা, তাঁর ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার তৎকালীন মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি, ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সানিয়াত রহমান খান বাপ্পার নাম উঠে আসে। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ওয়াহেদ, আবদুল খালেক ও সনি আদালতে জবানবন্দি দেন। এরপর চার ভাই আত্মগোপনে চলে যান। এক পর্যায়ে আমানুর রাহমান খান রানা আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তিন বছর হাজতে থাকার পর জামিন পান। ৫ আগস্টের পর তিনি আবার আত্মগোপনে চলে যান। অপর দুই ভাই ২০১৪ সাল থেকে বিদেশে অবস্থান করছেন বলে তাঁদের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন।
গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম মাহফিজুর রহমান ২০১৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রানা ও তাঁর তিন ভাইসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। বিচার চলাকালে দুই আসামি আনিসুল ইসলাম রাজা ও মো. সমীর কারাগারে মারা যান। গত ২৬ জানুয়ারি ফারুক হত্যা মামলার যুক্তিতর্ক শেষ হয়।