মহানগরী থেকে চার কিলোমিটার দূরত্বে ইটাল্লা গ্রাম। গ্রামে প্রবেশ করলেই নিহত যুবদল নেতা তৌহিদদের বাড়ি। বাড়ির ফটক থেকে ভেতরে যেতেই দেখা যায়, স্বজনরা উঠানে বসে আহাজারি করছেন। প্রতিবেশীরাও আসা-যাওয়া করছেন। শোকের আবহ। তৌহিদের স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ৩১শে জানুয়ারি যৌথবাহিনীর হেফাজতে মারা যান তৌহিদুল ইসলাম। তিনি কুমিল্লা সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক ছিলেন। তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনা এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবারের সদস্যরা দাবি করছেন, যৌথবাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে বেধড়ক পেটায় তৌহিদকে। সেই আঘাতের চিহ্নও ছিল তার শরীর জুড়ে।
কেন তৌহিদুলকে তুলে নেয়া হয়েছিল। কারা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিল। এসব বিষয় নিয়ে এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়েছে মানবজমিন। স্থানীয়দের কাছ থেকে উঠে এসেছে এসব বিষয়ে নানা তথ্য। স্থানীয়রা বলছেন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধের জেরেই তৌহিদকে জীবন দিতে হয়েছে। এ ছাড়া যুবদলের আহ্বায়ক হওয়ায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিষয়টিও সন্দেহে রেখেছে পরিবার।
গ্রামের মানুষ ও পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, পাশের বাড়ির তানজিল নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তৌহিদ পরিবারের দ্বন্দ্ব প্রায় ১৫ বছরের। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সেই দ্বন্দ্ব আরও চরমে উঠে। স্থানীয়রা বলেন, বাড়ির পাশেই মসজিদ ও পারিবারিক কবরস্থানের জন্য জায়গা দিয়েছিলেন তৌহিদের পূর্বপুরুষরা। সেই জায়গার বেশ কিছু অংশের মালিকানা দাবি করে আসছিলেন পাশের বাড়ির তানজিলের পরিবার। এ নিয়ে বরাবরই তাদের মধ্যে বিবাদ লেগে থাকতো। সম্প্রতি তৌহিদের সঙ্গে ওই পক্ষের খানিকটা হাতাহাতিও হয়। তারই জের ধরে মিথ্যা অভিযোগ তুলে যৌথবাহিনীর কাছে গিয়েছিলেন তানজিল। তাকে ক্ষমতাধর কোনো পক্ষ সহযোগিতা করেছে এমনও আলোচনা আছে। স্থানীয়রা আরও জানান, তৌহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়, তার কাছে অস্ত্র রয়েছে। তাই ৩০শে জানুয়ারি রাতে তাকে আটকের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি দল বাড়িতে আসে। সেই দলের সদস্যরা রাতে ঘরে ঢুকে তৌহিদকে তুলে নিয়ে যায়। রাতেই কয়েক দফা মারধর করে। পরদিন আবারো মারধরের পর পুলিশে দেয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন তৌহিদ। পরে তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে দায়িত্বরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
রোববার তৌহিদের বড় ভাই আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমার ভাই তৌহিদ স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সে ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক। তার সঙ্গে কারও কখনো কোনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল না। এখানে আমরা জানি না কেন সেনাবাহিনী তাকে নিয়ে গেছে। আমার ভাইয়ের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না। কখনোই ছিল না। কিন্তু অস্ত্র থাকার অভিযোগে তাকে তুলে নিয়ে যায়। পরে লাশ হয়ে ফিরে আসে।
আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, ঘটনার দিন আমি বাড়িতে ছিলাম। পরদিন বাবার কুলখানি। আমরা সবাই সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। ভাইও আসছে অনেক রাতে। এর মধ্যেই হঠাৎ ২টার পর সেনাবাহিনীর গাড়ি বাড়ির চারপাশে আসে। ঘরে ঢুকেই তারা আমার ভাইকে নিয়ে যাবে। অস্ত্র কোথায় রেখেছে সেই প্রশ্ন বারবার করে। তারাও তল্লাশি চালায়। কিন্তু কোনো অস্ত্র পায়নি। এরপর নিয়ে যায়। সকালেও আবার সেনাবাহিনীর কয়েকটি গাড়ি এসে আমাদের বাড়িতে তল্লাশি চালায়। তখন তৌহিদকে গাড়িতে রাখা হয়। এরপর আবার নিয়ে যায়। সেখান থেকে সেনাবাহিনীর লোকজন আমাদের ফোন দিয়ে বারবার অস্ত্রের কথা বলে। তাদের কথা, আমরা অস্ত্র দিয়ে দিলে আমার ভাইকে ছেড়ে দেবে। পরে জানতে পারি পুলিশের কাছে দিয়ে দিয়েছে। মেডিকেলে নেয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তৌহিদের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলার প্রস্তুতি চলছে জানিয়ে আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা এখনো পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নিইনি। আগে দেখি কী হয়। তবে আমরা একটি হত্যা মামলা করবো।
কার বিরুদ্ধে মামলা করবেন জানতে চাইলে তৌহিদের ভাই বলেন, আমাদের প্রতিবেশী তানজিলসহ চার-পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করবো। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের সঙ্গে কোনো ব্যক্তির রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল না। কিন্তু এবার ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক হওয়ায় কয়েকজনের মন খারাপ হয়েছে। তাদেরও এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে মনে হয়।
তৌহিদুল ইসলামের স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার বলেন, আমার চারটি মেয়ে এখনো ছোট। আমি জানি না কীভাবে তাদের নিয়ে বাঁচবো। আমার স্বামী কোনো অপরাধ করেনি। তাকে কেন নির্যাতন করে হত্যা করা হলো? আমি পুরো ঘটনার সঠিক তদন্ত এবং বিচার চাই।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা মানবজমিনকে জানান, তৌহিদুলের মৃত্যুর কিছুদিন আগে পাশের বাড়ির প্রতিবেশী তানজিলদের সঙ্গে বিবাদ হয়। সেই ঘটনায় তানজিলের পক্ষে কথা বলতে আসেন গ্রামের আরেক ব্যবসায়ী সাইফুল। এই সাইফুল তানজিলের উকিল বোন জামাই বলে পরিচিত। জমির বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য তৌহিদুলের সঙ্গে কথা বলতে আসেন তিনি। এ সময় ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক সাইফুলকে কথা বলতে নিষেধ করেন। এক পর্যায়ে এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। সেখান থেকেই তৌহিদুলের ওপর ক্ষোভ আরও বাড়তে থাকে।
তৌহিদুলের চাচাতো ভাই মামুন মানবজমিনকে বলেন, বাড়ির পাশের কবরস্থানের জমি নিয়ে অনেকদিন থেকেই আমাদের সঙ্গে ওদের ঝামেলা চলছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তারা আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ওই জায়গা তো আমাদের পূর্বপুরুষের। তারা তাদের দাবি করে। সরকার পতনের পর প্রতি সপ্তাহেই একবার করে বিচার বসায় তানজিল। এলাকার লোকজন কেউ বিচারে থাকে না। বাইরে থেকে বিএনপি’র লোকজন পরিচয় দিয়ে নিয়ে আসে। বাড়িতে এসে বসে থাকে। কয়েকদিন আগে সাইফুলকে তাড়িয়ে দেয় আমার ভাই। সেখান থেকেই হয়তো সে সেনাবাহিনীর কাছে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে থাকতে পারে।
গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, তানজিল আর সাইফুলই এই ঘটনার জন্য দায়ী। তারা পরিকল্পনা করে তৌহিদুলকে মারিয়েছে। তৌহিদুলের বিরুদ্ধে কোনো মামলাও ছিল না। কিছুই ছিল না। এলাকার মধ্যে কখনো কোনো খারাপ কথাও শোনা যায়নি।
স্থানীয়রা আরও জানান, যে রাতে তৌহিদুলকে তুলে নিয়ে গেছে সে সময় সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে সাইফুলকে দেখা গেছে। এ ছাড়া তানজিলকেও মুখোশ পরা অবস্থায় দেখা গেছে বলে তারা জানিয়েছেন।
এদিকে তৌহিদুলের মৃত্যুর পর ইটাল্লা গ্রাম থেকে তানজিল পালিয়েছেন বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। সেইসঙ্গে সাইফুলকেও আর দেখেননি কেউ। গতকাল তানজিলের বাড়িতে সরজমিন যান এই প্রতিবেদক। এ সময় তাদের কাউকেই পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনায় স্থানীয় সেনা ক্যাম্পের কমান্ডারকে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহার এবং মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটনে একটি উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে দোষী সাব্যস্তদের বিরুদ্ধে সেনা আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার এ মৃত্যুর ঘটনায় জরুরি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস যেকোনো ধরনের হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে জরুরি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
ওদিকে যৌথবাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়ার পর যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুতে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) উদ্বেগ প্রকাশ করে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
গতকাল সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ উদ্বেগ ও বিচার দাবি করে বলা হয়, তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো অস্ত্র থাকার অভিযোগ ছিল না এবং তাকে অজ্ঞাত কারণে গভীর রাতে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবারের সদস্যরা থানায় যোগাযোগ করেও কোনো খোঁজ পাননি। নিহতের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকায় পরিবারের সদস্যরা এ মৃত্যুকে পরিকল্পিত ও সন্দেহমূলক দাবি করেছেন। আসক মনে করে, এ ধরনের ঘটনা মানবাধিকার ও আইনের শাসনের পরিপন্থি। আটক ব্যক্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আসক এ ঘটনার স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও দ্রুত বিচারিক তদন্ত এবং দায়ীদের যথাযথ আইনি শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছে।