শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক হিসেবে যেমন প্রশংসিত হন, তেমনই যারা রাজনীতিতে ধর্মের অবস্থান দেখতে চান না- তাদের সমালোচনার শিকার হন। এ কথা নিশ্চয় অন্যান্য দলের সঙ্গে জামায়াতও জানে। তাই, বারবার ‘সফট কর্নার’ থেকে বিএনপির সঙ্গে দলটির জোট করা স্বাভাবিক। আবার দুই দলের রাজনৈতিক আদর্শ যেহেতু আলাদা, তাই তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়াও অস্বাভাবিক না।জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিএনপির হাল ধরেন তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। যিনি ‘আপোষহীন নেত্রী’ হিসেবে রাজনীতিতে পরিচিতি পেয়েছেন। তার এই আপোষহীন মানসিকতা থেকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অধীনে তিনি কোনো নির্বাচনে যেতে চাননি। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। তবে আওয়ামী লীগের পপাশাপাশি জামায়াতও এরশাদের অধীনে সে নির্বাচনে অংশ নেয়। অর্থাৎ নির্বাচন বর্জনে জামায়াতকে পাশে পায়নি বিএনপি। তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অবশ্য শুধু জামায়াত নয়, আওয়ামী লীগকেও নির্বাচন বর্জনের কাতারে পাওয়ার কথা ছিল বিএনপির।এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অবশ্য আওয়ামী লীগ ও জামায়াতকে পাশে পেতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি বিএনপির। এক বছর পরই শেখ হাসিনার সঙ্গে এরশাদের দূরত্ব বাড়ে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সামরিক আইন জারি করেন এরশাদ। এরপর ১৯৮৮ সালে তিনি ফের জাতীয় নির্বাচন দেন। তাতে আর অংশ নেয়নি আওয়ামী লীগ, অংশ নেয়নি জামায়াতও। অর্থাৎ রাজনৈতিক ঘুরপাক শেষে, অভিন্ন লক্ষ্যে বিএনপি, আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতও এক কাতারে আসে। তাদের সঙ্গে তখন অবশ্য বামদলগুলোও ছিল।
বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের গভীরতা দেখা যায় এরশাদ পতনের পর। এরশাদ পতনের পর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৪০টি আসন পায় বিএনপি। তবুও সরকার গঠনে ন্যুনতম যে ১৫১ আসন পেতে হয়, তা তারা অর্জনে ব্যর্থ হয়। সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে ‘বন্ধু’র পরিচয় দেয় জামায়াত।বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের এ সম্পর্ক বেশি দিনের হয়নি। নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সংসদে দাবি তোলে জামায়াত। একই দাবি তোলে আওয়ামী লীগও। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সংসদের বাইরেও একসঙ্গে আন্দোলন চালিয়ে যায় এ দুই দল। সব সময়ের জন্য বিপরীতে মেরুতে অবস্থান করা আওয়ামী লীগ-জামায়াত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আন্দোলনের সঙ্গী হয়।তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন চলমান থাকা অবস্থায় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার অধীনে ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ সব দলই এ নির্বাচন বর্জন করে।
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচেন ১৪৬টি আসন পায় আওয়ামী লীগ। ৩২টি আসন পাওয়া জাতীয় পার্টির সমর্থনে সরকার গঠন করে তারা। এ নির্বাচনের সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে পঞ্চম জাতীয় নির্বাচনে ১৮টি আসন পাওয়া জামায়াতের আসন কমে ঠেকেছে মাত্র তিনটিতে! এ আসন কমায় ভূমিকা রেখেছে তাদের আন্দোলনের সঙ্গী আওয়ামী লীগই। শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি জনতার মঞ্চে জামায়াতের তৎকালীন আমির অধ্যাপক গোলাম আজমের ফাঁসির রায় ঘোষণা করে। এ সংগঠনের মদদে আওয়ামী লীগ ও তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র এক দেশ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।আওয়ামী লীগ সরকার আমলেই ফের একসঙ্গে রাজনীতি করার ঐক্যমতে পৌঁছায় বিএনপি-জামায়াত। ১৯৯৯ সালে গঠিত হয় চারদলীয় ঐক্যজোট। বিএনপি-জামায়াত ছাড়াও এ জোটের সঙ্গী হয় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ও ইসলামী ঐক্যজোট।২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় জোটের সঙ্গীদের মধ্যে একক দল হিসেবে বিএনপি পায় ১৯৩টি আসন, জামায়াত পায় ১৭টি, বিজেপি চারটি ও ইসলামী ঐক্যজোট দুটি। জোটবদ্ধ রাজনীতিতে অংশ নিয়ে এক লাফে তিন আসন থেকে ১৭ আসনে চলে যায় জামায়াত। শুধু তাই নয়, প্রথমবারের মতো অংশ হয় সরকারেরও। জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী পান শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব, আর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ হন সমাজকল্যাণমন্ত্রী।চারদলীয় ঐক্যজোট এক যুগের বেশি স্থায়ী ছিল। এ জোট থেকে নবম জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ৩০টি, জামায়াত দুটি ও বিজেপি একটি আসন পায়। ইসলামী ঐক্যজোট আসন পেতে ব্যর্থ হয়। ভোটের রাজনীতিতে পিছিয়ে গেলেও চারদলীয় ঐক্যজোটের ঐক্যে ফাঁটল ধরেনি। ২০১২ সালে এসে বরং তার কলেবর বৃদ্ধি করা হয়। চারদলীয় ঐক্যজোট হয়ে যায় ২০ দলীয় জোট।
তবে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আন্দোলনসহ নানা ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব বাড়ে বলে লক্ষ্য করা যায়। ২০১৮ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে ২০ দলীয় ঐক্যজোটের অংশ নেওয়াকে ভালোভাবে নেয়নি জামায়াত। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি ও জামায়াতের জোটবদ্ধ রাজনীতিতে ভাঁটা পড়ে। ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে দেখা যেত না জামায়াত নেতাদের। তখন থেকেই কানাঘুঁষা চলছিল, বিএনপির সঙ্গে জামায়াত আর জোটে নাই। অর্থাৎ ২০ দলীয় জোট আর কাজ করছে না। ২০২২ সালে এসে এ জোট বিলুপ্ত হয়ে যায়।জোটে না থাকলেও শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ইস্যুতে এক থেকেছে বিএনপি-জামায়াত। এমনকি একই দিনে, একই দাবিতে পৃথক কর্মসূচি দিয়েছে তারা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও দল দুটির নেতাকর্মীরা সর্বাত্বকভাবে মাঠে থেকেছে। উভয় দলেরেই অসংখ্য নেতাকর্মী নিহত, আহত হয়েছেন।তবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্বটা খুবই লক্ষ্যণীয়। দল দুটির নেতারা পরস্পরের বিরুদ্ধে বক্তব্যও দিচ্ছেন। জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান নিজেদের ও সেনাবাহিনীকে ‘দেশপ্রেমিক শক্তি’ হিসেবে দাবি করলে তার বিরোধিতা করেন বিএনপি নেতারা। জামায়াতের অনেক নেতাও বিএনপির কর্মকাণ্ড ও নেতাদের সমালোচনা করছেন। এর কিছুটা নাম উল্লেখসহ, কিছুটা আকার-ইঙ্গিতে।
এখন অনেকেই বিএনপি-জামায়াতের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যকে ‘পলিটিক্যাল গেম’ হিসেবে দেখছেন। তাদের দাবি, দুই দল নিজেদের সম্মতিতে পরস্পরের সমালোচনায় লিপ্ত হয়েছে। এতে করে দেশে চলমান রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ হবে। আওয়ামী লীগ কিংবা তাদের দোসররা আর ফিরে আসার সুযোগ পাবে না। আর এভাবে চলার পর বিএনপি যদি ক্ষতায় যেতে পারে, তবে নিশ্চিতভাবেই বিরোধীদলের আসনে থাকবে জামায়াত। তবে আমার ধারণা, তাদের বিপরীত। অর্থাৎ কোনো ‘গেম’ নয়, সত্যিকার অর্থেই পরস্পরের বিরোধিতা করছে দুটি দল।স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা। আর তা নিয়ে কথা বলা মানে তাদের দিকে সবচেয়ে শক্তিশালী তির ছুড়ে মারা। আর সেই তিরটি ছুড়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহসচিব রুহুল কবির রিজভী। জামায়াত আমিরের ‘দেশপ্রেমিক’ দাবি করার পর তিনি দলটির কাছে প্রশ্ন তোলেন,‘একাত্তরে আপনাদের ভূমিকা কী ছিল? আপনারা কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন? আপনারা কোন সেক্টর কমান্ডারের আন্ডারে যুদ্ধ করেছেন?’অন্যদিকে, জামায়াতও বিএনপিকে চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ, সংসস্কারবিরোধী ও নির্বাচনের জন্য মরিয়া দল হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে। জামায়াত নিজেরাও অবশ্য দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে।আবার আসি, আসলেই কি বিএনপি-জামায়াত পারস্পরিক সম্মতিতে পরস্পরের বিরোধিতায় নেমেছে? যেমনটি করেছিল আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি। এখন, আওয়ামী সম্মতির বিরোধীদল জাতীয় পার্টি বলে, আর অন্য দলটি জামায়াত বলে ‘গেম তত্ত্বে’ আমার বিশ্বাস হয় না। ভোটের রাজনীতিতে জামায়াতের অবস্থান কেমন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে, তবে তারা আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করে। সে আদর্শ আমার, আপনার পছন্দ না-ই হতে পারে। তাই এই দলটিকে জাতীয় পার্টির মতো গৃহপালিত বিরোধীদল বানানো যেতে পারে বা তারা তাই হবে এমন ধারণা করা অত্যন্ত বোকামি।
বিএনপি-জামায়াতের বিরোধিতা আমরা প্রকাশ্যে যতটা দেখি, আমার মনে হয় তাদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া দূরত্ব আরও বেশি। বিএনপি এখন এককভাবে নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাওয়ার মতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে আছে। যদিও তারা তাদের আন্দোলনের সঙ্গীদের মূল্যায়ন করবে অর্থাৎ তাদেরকে আসন ছেড়ে দেবে।অন্যদিকে, জামায়াত ইসলামীও ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এ জন্য জামায়াত আমিরসহ দলের অন্য নেতাদের মুখে শোনা যায়, তারা ক্ষমতায় গেলে কী কী করবেন আর কী কী করবেন না তা তুলে ধরতে। এর আগে কখনো শুনেছেন যে জামায়াত নেতারা ক্ষমতায় যাওয়ার কথা বলছেন?ক্ষমতায় যেতে ইসলামী ভোট বাক্স বাড়ানোর চিন্তা করছে জামায়াত। এক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাসের চেয়ে রাজনীতিই প্রাধান্য পাবে। সম্প্রতি বরিশালে চরমোনাই দরবারে গিয়ে সে কথার জানান দিয়েছেন জামায়াত আমির। চরমোনাই পীর ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সঙ্গে করা যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সে কথার জানিয়েছেন তিনি।অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হতে যাওয়া রাজনৈতিক দল নিয়েও হয়তো আশাবাদী জামায়াত। তারা বড় ধরনের ভোট কাটতে পারলে জামায়াত তাদের নির্দিষ্ট ভোট পেয়ে আসনটি নিজেদের করতে পারবে বলে মনে করে।এখন যে দলটি ক্ষমতায় যেতে চায়, সেই দলকে বিএনপির কথা মতো গৃহপালিত বিরোধীদল হতে যাওয়ার মতো দল ভাবার কোনো কারণ নেই। যদিও জাতীয় পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান, প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রায়ই বলতেন, ‘এবার সরকার গঠন করবে জাতীয় পার্টি’। এরশাদের মৃত্যুর পর দলের হাল ধরা তার ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের মুখেও এমন কথা শোনা গেছে বারবার। তবে, আবারও বলছি, জাতীয় পার্টি আর জামায়াত এক না। জাতীয় পার্টির কথা আপনি যতটা হাস্যকরভাবে নেবেন, জামায়াতের কথা ততটাই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
লেখক: সংবাদকর্মী