Image description

সেলিম রেজা নিউটন

সমস্ত সমাজ অন্তঃসারশূন্য বোমার অন্তর—

শাসকের শাস্ত্রবোধ শাসানোর শূন্যতায় ভারী;

আজকের জঙ্গনামা জটিল স্প্লিন্টারে বিদ্ধ পাখির কবর—

জঙ্গি কিন্তু ‘সামরিক’, জঙ্গি মানে র‌্যাব-মিলিটারি। 

(নিউটন, ২০১৫-ক : ২০) 

রাষ্ট্রীয় ফিকশনের সাথে যখন গুলিয়ে যায় কর্পোরেট রিপোর্টিংয়ের পার্থক্য, তখন উদ্ভব ঘটে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের। যখন যুদ্ধ, অথবা জেহাদ, অথবা জঙ্গ্‌ ঘোষণা করে বসে রাষ্ট্র তার নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধে, তখন মৃত্যু ঘটে সাংবাদিকতার, আর রাষ্ট্র হয়ে ওঠে অবাধ বাজার এবং কেন্দ্রীভূত বন্দুকের একচেটিয়া বলপ্রয়োগমূলক বুলেটিন। এমনকি ফিকশন হয়ে উঠতে শুরু করে রাষ্ট্র নিজেই। ফলে, মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে যেদিন চাঁদে দেখা গেল অন্তত সেদিন থেকে নাগরিকেরা টের পেতে শুরু করলেন, গণতন্ত্র নিজেই একটা গুজব, জঙ্গনামাও গুজব। অথচ রাষ্ট্রীয় পরিসরে গুজব নিজেই হয়ে উঠতে পারে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ঘটনা (দ্রষ্টব্য নিউটন, ২০১৪)। 

রাষ্ট্রীয় এবং বিরাষ্ট্রীয় যুদ্ধের ভেতরে এবং বাইরে জঙ্গি বহুবিধ। গুটিকয় আত্মঘাতী বোমাহামলাকারীও জঙ্গি, কাশ্মীরের মুক্তিযোদ্ধারাও জঙ্গি, রাষ্ট্রের সামরিক বিমানও জঙ্গি বিমান। বিগত শতকের আশির দশকে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মিছিলকে পত্রিকায় লিখত জঙ্গি মিছিল। আদতে জঙ্গি এসেছে জঙ্গ্‌ থেকে। জঙ্গ্‌ মানে যুদ্ধ, সমর। জঙ্গি বাহিনী বলতে সামরিক বাহিনী। অন্তত শব্দার্থগত দিক থেকে। যুদ্ধ করে আদতে রাষ্ট্র এবং তার সামরিক বাহিনীগুলো। প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র তাই জঙ্গি প্রতিষ্ঠান। 

যাবতীয় বিরোধীমত স্তব্ধ করার লক্ষ্যে জঙ্গি দমনকে উসিলা বানিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে রাষ্ট্রের পক্ষ অবলম্বন করে চার পদের রাষ্ট্রীয় এলিট। প্রথমত, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কর্পোরেট মিডিয়া। তার পত্রপত্রিকা টেলিভিশন রেডিও সিনেমা প্রকাশনা। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। রাষ্ট্রের বেসরকারি শাখা হিসেবে, তৃতীয়ত, কর্পোরেট বিজনেস ক্লাস। এবং চতুর্থত, এনজিও ইত্যাদি। এরা সমস্বরে আমাদেরকে জানাতে থাকে যে, রাষ্ট্র জঙ্গিদের জেহাদে আক্রান্ত। আত্মরক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করতে হবে। 

রাষ্ট্রীয় এই যুদ্ধের বা জঙ্গের আত্মপক্ষ-রাষ্ট্রপক্ষ হিসেবে সাংবাদিকতার নামে কর্পোরেট মিডিয়া যেটা করে সেটাকে ‘সাংবাদিকতা’ বলা যায় না। যেহেতু জঙ্গে অংশগ্রহণকারী দুই পক্ষই, আক্ষরিক অর্থে, জঙ্গি নামের অন্তর্গত, এটা ‘জঙ্গি সাংবাদিকতা’। জঙ্গি জার্নালিজম বলতে তাই রাষ্ট্রের প্রেস রিলিজ, প্রেসনোট, গোপন সূত্রে প্রাপ্ত গোয়েন্দা-গুজব, এবং র‌্যাব ডিবি সিটিটিসির প্রকাশ্য গোয়েন্দা-ব্রিফিং। রাষ্ট্রীয় বৈধ পাইকারি বন্দুক এবং জেলখানা-গুমখানার শিকার লোকজন সেখানে অনুপস্থিত। তারা স্রেফ ‘জঙ্গি’ নামক ঘৃণিত উপাধির নাম এবং ছবি। ঠিক মানুষ-পদবাচ্য কিছু নন।

সুলিখিত এবং অফিসিয়ালি প্রেরিত কর্পোরেট প্রেস বিজ্ঞপ্তি যখন গুলিয়ে যায় সংবাদ এবং বিজ্ঞাপনের সঙ্গে, তখন শুরু হয় ‘মুক্তবাজার সাংবাদিকতা’র যুগ (নিউটন, ১৯৯৯)। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন গভীর রাতে আবু সুফিয়ানের মতো ক্রাইম-সাংবাদিককে ফোন করে নিজেদের দপ্তরে ডেকে এনে আনঅফিসিয়াল ‘প্রেস বিজ্ঞপ্তি’ হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিউজ করতে বলেন, তখন সূত্রপাত ঘটে ‘রাষ্ট্র-কর্পোরেট’ সাংবাদিকতা, তথা জঙ্গি জার্নালিজমের। (রাষ্ট্র-কর্পোরেট কমপ্লেক্সের ধারণার জন্য দ্রষ্টব্য (Chomsky, 2011.) প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তাঁর কাছ থেকে আমরা জানলাম, ডকুমেন্টেড হয়ে থাকল এই কথা যে, এই যুগে বড়ো বড়ো কর্পোরেট পত্রিকা-অফিসে ‘বেড়াতে’ আসতেন র‌্যাব নামক রাষ্ট্রীয় ‘জল্লাদ-বাহিনী’র ব্যাটালিয়ন-অধিকর্তাবৃন্দ (জল্লাদ-বাহিনীর ধারণা ও ইতিহাসের জন্য দ্রষ্টব্য Khalil, 2016)। এভাবে, আপামর জনগণের অগোচরে ‘বাজারের যুগে’র কর্পোরেট-সাংবাদিকতা (নিউটন, ২০০২) বা ‘মার্কেট জার্নালিজম’ (McManus, 1994) পেরিয়ে আমাদের সাংবাদিকতা ঢোকে এমন এক নবতর যুগে যখন রাষ্ট্র তার কাছে দাবি করে বসে একচেটিয়া ও প্রশ্নাতীত আনুগত্য। শুরু হলো রাষ্ট্র-কর্পোরেট জঙ্গি জার্নালিজম। 

আবু সুফিয়ান আমাদের ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি’ গত সাংবাদিকতার ইতিহাসের সেই ধারার অংশ, যা মার্কিনী ইরাক-যুদ্ধের যুগে আবিষ্কৃত ‘এমবেডেড সাংবাদিকতা’র (Paul and Kim, 2004) রাষ্ট্র-কর্পোরেট আনুগত্যে সমাহিত হয় নি। বরং প্রকৃত সাংবাদিকের চোখে মানুষকে দেখেছেন তিনি ‘মানুষ’ হিসেবে, পুলিশের চোখে দেখা ‘অপরাধী’ হিসেবে নয়। খোঁজ করেছেন ক্রসফায়ার-কেচ্ছার রাষ্ট্রীয় ভিক্টিমদের ও তাঁদের পরিবার-পরিজনের উপেক্ষিত বয়ান। 

জঙ্গি জার্নালিজম বিষয়ে আমার জরুরি একাডেমিক কৌতূহলের পরোক্ষ একটা উত্তরও পাওয়া গেল প্রকৃত জার্নালিস্ট আবু সুফিয়ানের ক্রসফায়ারের নীলনকশা বইয়ে: জঙ্গি জার্নালিজমের সুনির্দিষ্ট সূত্রপাত আদতে ২০০৪ সালে। র‌্যাবের সূচনা এবং জঙ্গি জার্নালিজমের চলন একটা প্যারালাল রিয়ালিটি। বাংলাদেশে এটা মুক্তবাজার সাংবাদিকতার পরবর্তী পর্ব। একাধারে আফগানিস্তান ইরাক সিরিয়া সোমালিয়া প্যালেস্টাইনে, এবং হলিউডের সুপারহিরো সিনেমায়, প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের” (Schmid, 2000: 87) মতোই বাংলাদেশের এই পর্বটাকে মনে হচ্ছিল যেন এক অন্তহীন পর্ব। কিন্তু জুলাই-বিপ্লবের স্বাধীনতার স্পৃহা তার রাশ টেনে ধরেছে। আবু সুফিয়ানের মতো সাংবাদিকের হাত ধরেই নতুন করে দাঁড়াচ্ছে প্রকৃত সাংবাদিকতা যেটা জঙ্গি জার্নালিজমের প্রতি ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জের রেফারেন্স পয়েন্ট হয়ে থাকবে। পয়েন্ট অব ডিপারচার হয়ে থাকবে। 

আবু সুফিয়ানের সাংবাদিকতাকে অনুসরণ করে জুলাই-পরবর্তী আমার দেশ পত্রিকা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ফ্যাসিস্ট হাসিনার “সর্বাত্মক স্বৈরতন্ত্রী” রাষ্ট্রের জঙ্গি দমনের নাটকীয় জঙ্গনামা উন্মোচনের লিগেসি, অন্য যত সমালোচনাই তার থাক না কেন। (সর্বাত্মক স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রপ্রণালী প্রসঙ্গ দ্রষ্টব্য নিউটন, ২০১৫-খ: ৩০, ১২১, ১৭৩, ২১২, ২১৪, ২২৩, ২৮০, ২৮১, ৩১৯, ৩৩৪, ৩৫০, ৪২০।) দৈনিক আমার দেশের কল্যাণে রাষ্ট্র-কর্পোরেট জঙ্গি জার্নালিজমের একচেটিয়ে প্রচারণার বিপরীতে এতদিনে আমরা পাচ্ছি প্রকৃত সাংবাদিকতার স্বাদ, এমনকি  যদি তা ক্ষেত্র বিশেষে আরো খানিকটা সুসম্পাদিত হওয়ার দাবি রাখেও। এছাড়া আমরা কি সপ্রমাণ জানতে পারতাম যে, ২০১৬ সালের ১৬ই জুলাই তারিখে পুলিশ, সোয়াট এবং ডিবি-র সম্মিলিত অভিযানে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গি হিসেবে যে ৯ জন নিহত হয়েছিলেন কল্যাণপুরের জাহাজবাড়ি নামক অতি ঘিঞ্জি এক ভবনে, সেটা ছিল মর্মান্তিকভাবে সাজানো একটা রাষ্ট্রীয় নাটক? তারা সবাই আসলে ডিবি-র হেফাজতে ছিলেন অনেক আগে থেকেই। ডিবি-ই তাদেরকে আইএসের কালো পোশাক পরিয়ে, কলেমা লেখা কালো পতাকা দিয়ে সাজিয়ে নিজেদের গাড়িতে করে মধ্যরাতে ঐ ভবনে নিয়ে যায়, এবং ভোরের দিকে দ্বিপাক্ষিক গোলাগুলির অভিনয় করে সবাইকে খুন করে। প্রত্যেকের শরীর পেছন থেকে ৬-৭টা করে গুলিতে বিদ্ধ ছিল। (আবু সুফিয়ান, “ডিবি থেকে নিয়ে ৯ তরুণ খুন: রাজধানীর জাহাজবাড়ি হত্যাযজ্ঞ ছিল শেখ হাসিনার ইসলামি জঙ্গিকার্ড”, আমার দেশ, প্রথম পাতা, ২৩শে ডিসেম্বর ২০২৪।) রাষ্ট্রের এই ভয়াবহ রকমের বানোয়াট গল্পকে সত্যিকারের ‘ঘটনা’ হিসেবে বিরাটভাবে ফলাও করে প্রচার করেছিল তখন সমস্ত কর্পোরেট পত্রপত্রিকা। জঙ্গি জার্নালিজমের ‘ধ্রুপদি’ দৃষ্টান্ত। সে সময় বছরের পর বছর ধরে এরকম একের পর এক দৃষ্টান্ত নিয়ে ক্লাসরুমের কাঠগড়ায় আমি বিদ্যায়তনিক বিচারবিশ্লেষণ করে গেছি শিক্ষার্থীদেরকে সঙ্গে নিয়ে। সেখান থেকেই দাঁড়িয়েছে আমার জঙ্গি জার্নালিজমের বিদ্যায়তনিক গবেষণা-প্রকল্প। এরকম বেশ কিছু রিপোর্ট নিয়মিত প্রকাশ পেয়ে চলেছে এই এক মাসের আমার দেশ পত্রিকায়। যেমন আবু সুফিয়ানেরই প্রথম পাতার লিড রিপোর্টে জানা গেল, ২০১৬ সালে গুলশানের হোলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সন্দেহভাজন যে আটজনকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছিল তাদের মধ্যকার চারজন আগে থেকেই ডিবি হেফাজতে ছিলেন (আমার দেশ, ১৩ই জানুয়ারি ২০২৪)। 

“ক্রসফায়ারের নীলনকশা” বইয়ে র‍্যাবের সূচনা-পর্ব প্রসঙ্গে আবু সুফিয়ানের জবানবন্দি পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল দৈনিক ‘প্রথম আলো’র প্রথম পাতার সেই বিশেষভাবে পরিবেশিত সচিত্র প্রতিবেদন। স্মৃতি থেকে বলছি, এখন আবার চেক করতে পারলে ভালো হতো, ২০০৪ সালে ২৬শে মার্চ র‌্যাবের আত্মপ্রকাশের পরের দিনের পত্রিকায়, সম্ভবত, হলিউডের দুই নায়কের মতো দুজন র‌্যাব-কর্মকর্তা দুই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি-সজ্জিত মোটরবাইক নিয়ে ঢাকার রাস্তায় টহল দিচ্ছেন। রীতিমতো রাষ্ট্র-গৌরবের মাহাত্ম্যে মণ্ডিত সংবাদ প্রতিবেদন। মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের প্রতিদিনের নিরাপত্তা নিয়ে আর কোনো চিন্তা নাই, এসে গেছে সর্বময় ত্রাণকর্তা, চৌকস এলিট ফোর্স। র‌্যাবকে পরবর্তী কুড়ি বছর ধরে বলতে গেলে এরকম একচেটিয়াভাবে গ্লোরিফাই করে গেছে বাংলাদেশের রাষ্ট্র-কর্পোরেট মিডিয়া। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে মিডিয়া এবং র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের ঢাক-পেটানো প্রচারণা দৃষ্টি এড়ায় নি তাঁর। 

বিপরীতে আবু সুফিয়ানের বর্ণনা নিষ্পৃহ। ক্রাইম থ্রিলারের মতো উত্তেজনাময় পরিস্থিতির বিবরণ দেন তিনি আপাত-নিষ্ক্রিয় ভাষায়: “রাতে ফোন করলে কি র‌্যাব-৪ অফিসে আসতে পারবেন? ভয় পাবেন না তো?” তাঁর বর্ণনা সরলতার মতো শক্তিশালী। নিজের দুর্বলতার স্বীকারোক্তি তাঁকে অথেনটিসিটি দেয়। সাধারণতম পরিবেশের সাধারণতম বর্ণনাও সময়ের গুণে, সময়ের কেমিস্ট্রিতে, রূপান্তরিত হয় অনন্ত আলকেমিতে। ঘটনা ঘটে পাঠকের মনের ভেতরে—বর্ণনায় কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। সেখানে তিনি স্ট্রেইট-জ্যাকেট বাক্য-রচয়িতা মাত্র। 

পাঠককে টাইম-ট্রাভেল করিয়ে নিয়ে এসেছেন তিনি তাঁর বইয়ে। র‌্যাব গঠনের অপরাধ-জাগতিক পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেছেন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড এবং দেশের অন্যান্য জায়গার, বিশেষত উত্তর-বঙ্গ ও দক্ষিণ-বঙ্গের অপরাধ-পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে। এ সম্পর্কিত গোটা নব্বই দশককে তিনি তুলে এনেছেন মাত্র কয়েক পাতার মধ্যে। মিথের মতো সব ক্রিমিনাল-কর্মকাণ্ড, পুলিশি পদক্ষেপের ব্যর্থতা এবং বিচারকদের অসহায়ত্বের দিকগুলো তিনি তুলে ধরেছেন চুম্বক-বর্ণনায়।

ভয়াবহ সব ফৌজদারি ক্রাইমের সাথে রাজনৈতিক গডফাদারদের সম্পর্কের সম্ভাব্য সকল প্রমাণ যে আসলে মুছে ফেলে ‘ক্রসফায়ার’, তা বলতে ভোলেন নি আবু সুফিয়ান। অপরাধী বলে ধরে নেওয়া মানুষদেরকে ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে মেরে ফেলার মধ্য দিয়ে তাঁদের মূল মদদদাতা ও সুবিধাভোগী রাজনীতিবিদদের সংশ্লিষ্টতার সমস্ত জীবিত তথ্যপ্রমাণ ধ্বংস হয়ে যায়। রাজনৈতিক গডফাদার নামক ‘বড়ো অপরাধী’র কর্মকাণ্ড নিয়ে আদালতে বা মিডিয়ায় বা অন্য কোনো আকারে সাক্ষ্য দেওয়ার মতো কোনো ‘ছোটো অপরাধী’ আর বেঁচে থাকেন না। তাতে করে সুরক্ষিত হয় খোদ অপরাধচক্র এবং তা বাড়তে থাকে অধিক নিরাপদে, চক্রবৃদ্ধি-হারে। 

আদতে র‌্যাব প্রতিষ্ঠার উপলক্ষ্য ছিল খুচরা অপরাধ দমন, লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক ভিন্নমত-দমন। যেমন ধরা যাক, আবু সুফিয়ানের বইয়ের পরিশিষ্টে দেখা যাচ্ছে, ২০০৪ সালের মার্চ মাসে যাত্রা শুরু করার পর ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে আন্ডারগ্রাউন্ড, সশস্ত্র চরমপন্থী, মাওবাদী ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর পাক্কা ৬০ জন নেতাকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করেছে র‌্যাব (এই ধারার রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত নানা দিকের জন্য দ্রষ্টব্য আহমেদ, ২০০৯)।

আবু সুফিয়ানের ক্রসফায়ার-সাহিত্য স্রেফ বন্দুকের নয়—বাগানেরও। র‌্যাব অফিসের বাগান।  “উঁচু পাঁচিল দিয়ে ... নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে ঘেরা ব্যাটালিয়নটির সামনে সুপ্রশস্ত বাগান। দিনের বেলায় এলে দেখা যায় বাগানটিতে ফুটে আছে বিভিন্ন রঙের থোকা থোকা ফুল। তবে, চারদিকে গাড়ির আনাগোনা, ...শরীরচর্চা, প্যারেড, অস্ত্রের ঝনঝনানি আর আসামিদের ভীত মুখের মাঝে বাগানটিকে কখনো কখনো উপহাসের মতোই” লাগে তাঁর। আর ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক পরিতৃপ্তির সাথে তাঁকে জানান,  “এতো ফুলের গাছ লাগিয়েছি যে দেখবেন বসন্তে ফুলে ফুলে ভরে যাবে পুরো চত্বর”। 

একদিন, সেই ২০০৪ সালেই, র‌্যাব-৪ অধিনায়কের দপ্তরে ভোর রাতে ফোন করে ডেকে আনা আবু সুফিয়ানকে কফি পেশ করে তিন অপরাধী “এলিমিনেট” করার “খবর” দিচ্ছেন অফিসাররা। সুফিয়ান দেখছেন, “সবার চোখেমুখে কেমন এক তৃপ্তির ঝিলিক, কণ্ঠেও উচ্ছ্বাস। হাসিমুখে কথা বলছেন একে-অপরের সাথে।” এমন সময় সুফিয়ানের “হঠাৎ মনে পড়ল র‌্যাব কম্পাউন্ডে অধিনায়কের বাগান করার কথা। বসন্ত আসতে আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। তখন ফুলে ফুলে ভরে উঠবে আঙিনা” অথচ এই তিন অপরাধীর আর বসন্ত দেখা হবে না। 

বই জুড়ে এইসব বাগান ও বসন্তের বিভিন্ন লেয়ারের অর্থ পাঠ করতে করতে সেমিওটিক অ্যানালিস্ট হয়ে উঠতে বাধ্য হন পাঠক। হয়ে ওঠেন সাহিত্য- ও রূপকথা-বিশেষজ্ঞ। তার জন্য তাঁকে তত্ত্বকথা পড়তে হয় না, উপন্যাস লেখার কথাও ভাবতে হয় না। আগে-পরে সুনির্দিষ্ট কারণ বর্ণনা করে ভেঙেচুরে কিছু না বললেও যখন আবু সুফিয়ান লেখেন, “জোনাকের আলোকেও এমন কেনো লাগছে? ... ভয় কী আমাকে জেকে ধরেছে?” তখন পাঠক সত্যিসত্যি সেমিওটিক বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠতে পারেন, গোটা ভয়ের পরিবেশে তাঁর গলা শুকিয়ে আসতে পারে বৈকি।

আবু সুফিয়ানের বইয়ের ঔপন্যাসিক জাদুবাস্তবতা আমাদের শেখাবে এই দার্শনিক সত্য যে, যত রকম স্থির অনড় খুপরিবদ্ধ ক্যাটেগরিওয়ালা ধারণা আমরা শিখেছি তার কোনোটাই আসলে স্থির না। একটা অন্যটার মধ্যে যাওয়া-আসা করে অবলীলায়। বিশেষ করে গোটা দেশ যখন রাক্ষসী ডাইনির একচ্ছত্র অধিকারে অধঃপতিত হয়, ‘জাদু’ চলে যায় বাস্তবতার পেটে, আর ‘বাস্তবতা’ হয়ে ওঠে জাদুময় রূপকথা। যেন অশরীরী দাদি ও দিদিমারা নাগরিক-শিশুদেরকে সুর করে পড়ে শোনাতে থাকেন: “রূপ দেখতে তরাস লাগে, বলতে করে ভয়, কেমন করে রাক্ষসীরা মানুষ হয়ে রয়” (মজুমদার, ১৯০৭)।  

অনেক বছর হলো, “অধ্যাপক আব্দুর রহমানের যৌন অভিজ্ঞতা” নামে একটা সর্বগ্রাসী উপন্যাস আমার মাথায় ঘুরঘুর করে। মনে মনে লিখতে গেলে সেটা প্রবন্ধের মতো হয়ে যেতে চায়। আর আমি ভাবতে থাকি উপন্যাস জিনিসটা আদৌ লেখে কেমন করে। এই ব্যাপারে আবু সুফিয়ানের ক্রসফায়ার-স্মৃতিকথা অমূল্য ইঙ্গিত দিয়ে গেল আমাকে। নিষ্পৃহভাবে শুধু বলে যাও। যা দেখেছ, যা শুনেছ, যা জেনেছ, যা ঘটেছে, যাকে তুমি সত্য বলে জানো। ব্যস! হয়ে গেল উপন্যাস অথবা ক্রাইম-রিপোর্টিং অথবা ব্যক্তির রাষ্ট্র-সামাজিক সন্দর্ভ। যা-ই হোক, অধ্যাপক আব্দুর রহমানের সাথে আমার আদি পরিচয় কিন্তু গুলশানে ‘জঙ্গি হামলা’র সময়। ৩৬শে জুলাইয়ের পর এখন যেহেতু ক্রসফায়ার উঠে গেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, আশা করি তিনি বেঁচে থাকবেন এবং তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হবে তাঁকে নিয়েই রচিত উপন্যাসের শহরে। 

সুফিয়ানের ক্রসফায়ারের নীলনকশা উপন্যাস নয়। কিন্তু উপন্যাস হিসেবে এটাকে গ্রহণ না করলে পাঠকের মাথায় চাপ পড়তে পারে। আমাদের রাষ্ট্র-পৌরাণিক রূপকথা যতখানি না জাদু, তার চেয়ে বেশি বাস্তব, এবং যতখানি না বাস্তব, তার চাইতে বেশি জাদু। জুয়েল আইচের মনোতোষ জাদু নয়, রাষ্ট্রীয় কালা জাদু। রাষ্ট্রীয় ব্ল্যাক ম্যাজিকের কালো পোশাকধারী কাল্ট নিয়ে বই লিখেছেন আবু সুফিয়ান। এরকম বই লিখতে এক্সট্রা একটা কলিজা দরকার পড়ে মানুষের। আল্লাহ তাঁকে সেটা দিয়েছেন। তিনি তাঁর নেক হায়াত দারাজ করুন।

কাজলা, রাজশাহী
২৮শে জানুয়ারি ২০২৫

 

বইপত্রের হদিস
আহমেদ, নেসার (২০০৯)। ক্রসফায়ার: রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। ঐতিহ্য, ঢাকা।

নিউটন, সেলিম রেজা (১৯৯৯)। “পাঠক লক্ষ করুন, ইহা হইল মুক্তবাজার সাংবাদিকতার যুগ”। সাহসী ঠিকানা। যুব উৎসব ‘৯৯ স্মারক সংকলন, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম।

নিউটন, সেলিম রেজা (২০০২)।  “ইয়ে হ্যায় মিডিয়া, মেরে ইয়ার! বাজারের যুগে সাহিত্য ও সাংবাদিকতার আম্ম-আব্বু সমাচার”। নিসর্গ । বর্ষ ১৭, সংখ্যা ১, আগস্ট।

নিউটন, সেলিম রেজা (২০১৪)।  “গুজবের গণতন্ত্রে যোগাযো।গ গেরিলা: যোগাযোগ-বার্তার অর্থ নির্ধারণ প্রসঙ্গে একটি উস্কানিমূলক আলোচনা”,  ‘কাউন্টারফটো’র প্রতিষ্ঠা-বার্ষিকীতে প্রদত্ত বক্তৃতা, ঢাকা। অপ্রকাশিত, যন্ত্রস্থ।

নিউটন, সেলিম রেজা (২০১৫-ক)। পরিস্থিতির বিবরণ, উলুখড়, ঢাকা। এই কাব্যগ্রন্থে গ্রথিত ২০০৫ সালে রচিত “জঙ্গনামা” কবিতা দ্রষ্টব্য।

নিউটন, সেলিম রেজা (২০১৫-খ)। অচেনা দাগ: সম্পর্ক স্বাধীনতা সংগঠন । আগামী প্রকাশনী, ঢাকা। 

মজুমদার, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র (১৯০৭)। ঠাকুরমার ঝুলি । ভট্টাচার্য অ্যান্ড সন্স, কলকাতা।

Chomsky, Noam (2011). “The State-Corporate Complex: A Threat to Freedom and Survival”. Text of lecture given at The University of Toronto. Archived link: archive.ph/HnvJ8. 

Khalil, Tasneem (2016). Jallad: Death Squads and State Terror in South Asia. London: Pluto Press.

McManus, John H. (1994). Market-Driven Journalism: Let the Citizen Beware? SAGE Publications.

Paul, Christopher and Kim, James (2004). Reporters on the Battlefield: The Embedded Press System in Historical Context, RAND Corporation, Santa Monica, CA.

Schmid, Julian (2000). “Reading post-‘9/11’ US Security Discourses through Superhero Films”. A thesis submitted to the University of Warwick for the degree of Doctor of Philosophy (PhD). Department of Politics and International Studies, University of Warwick, September.