Image description
 
 

দীর্ঘ সতেরো বছর পর ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বিমানবন্দরে অবতরণ থেকে শুরু করে জুলাই ৩৬ এক্সপ্রেসওয়েতে দেওয়া তাঁর ভাষণ পর্যন্ত- সবকিছুই এখন জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে। রাজনীতি, সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক পরিসরে এই প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে নানা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন চলছে, যা স্বাভাবিকভাবেই একটি দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে অনিবার্য।
এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে একটি বাক্য বিশেষভাবে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে আলোড়ন তুলেছে। সেটি হলো তাঁর উচ্চারিত ঘোষণা- ‘আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান।’ একটি সাধারণ ইংরেজি বাক্য হলেও এর রাজনৈতিক তাৎপর্য মোটেও সাধারণ নয়। বরং এই বক্তব্য নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে নেতৃত্ব, জনগণ এবং রাষ্ট্রচিন্তার সম্পর্ক নিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এই পরিকল্পনা কী? তার আগে প্রশ্ন ওঠে- এই পরিকল্পনা কোন্ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য? তারও আগে যে প্রশ্নটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো- এই স্বপ্নটি কার?
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে একটি বহুল প্রচলিত ধারণা হলো- নেতা স্বপ্ন দেখেন, আর জনগণ সেই স্বপ্ন অনুসরণ করে। নেতা নির্ধারণ করেন রাষ্ট্রের দিকনির্দেশনা, ভবিষ্যৎ কাঠামো এবং জাতির গন্তব্য। এই ধারণার পেছনে একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতাও রয়েছে। সভ্যতার প্রাথমিক ও মধ্যবর্তী পর্যায়ে সাধারণ মানুষ শিক্ষা, তথ্য ও রাজনৈতিক সচেতনতার দিক থেকে আজকের মতো সক্ষম ছিল না। ফলে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ভার তুলে দিয়েছিল এমন একজন ব্যক্তির ওপর, যাঁকে তারা বিশ্বাস করত।
এই বিশ্বাসের প্রতিফলন দেখা গেছে রাজা, বিপ্লবী কিংবা জাতির পিতা- এই ধরনের রাজনৈতিক চরিত্রের মধ্যে। অর্থাৎ, জনগণ তাঁদের কাছে প্রত্যাশা করত দিকনির্দেশনা, স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের মানচিত্র। রাষ্ট্রচিন্তা ছিল অনেকাংশেই একমুখী, ওপর থেকে নিচে নামা একটি ধারণা। জনগণ ছিল অনুসারী, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নয়। এই ঐতিহাসিক বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই এবং অনেক সমাজেই এই ধারা দীর্ঘকাল বজায় ছিল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেও এই ধারণা গভীরভাবে প্রোথিত। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা সাম্প্রতিক ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান- প্রতিটি ঐতিহাসিক মুহূর্তেই আমরা ‘স্বপ্ন’-এর কথা শুনেছি। কখনো একজন নেতার স্বপ্ন, কখনো একটি সরকারের স্বপ্ন, কখনোবা একটি রাজনৈতিক দলের কল্পিত ভবিষ্যৎ। জনগণকে বলা হয়েছে- এই স্বপ্নই তোমাদের স্বপ্ন, এই লক্ষ্যই তোমাদের লক্ষ্য।
এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের ‘আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান’ উচ্চারণটি নিছক একটি রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটি একটি স্পষ্ট দার্শনিক অবস্থান। আমরা সাধারণত রাজনীতিতে শুনে অভ্যস্ত- ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম।’ অর্থাৎ স্বপ্ন আগে, পরিকল্পনা পরে। কিন্তু এখানে তিনি স্বপ্নের কথা বলেননি, বলেছেন পরিকল্পনার কথা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে- তিনি কি স্বপ্ন দেখেননি, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবেই স্বপ্নের কথা এড়িয়ে গেছেন?
অনেকের ব্যাখ্যা হলো, তারেক রহমান দীর্ঘ সতেরো বছর ধরে সরাসরি কিংবা ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে দেশের মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। নানা বক্তব্য, সাক্ষাৎকার ও রাজনৈতিক প্রস্তাবে তিনি রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা প্রকাশ করেছেন। যদিও বিগত সরকার আইনি ও প্রশাসনিক নানা কৌশলে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ সীমিত করার চেষ্টা করেছে, তবু তিনি দলীয় কাঠামোর মাধ্যমে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ছিলেন সংযুক্ত। আবার এই তৃণমূল নেতা-কর্মীরা সংযুক্ত ছিলেন নিজ নিজ এলাকার মানুষের সঙ্গে। ফলে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন গণমানুষের কাছে অজানা নয়। 
এই যুক্তি অনুযায়ী বলা হচ্ছে, তিনি নতুন করে স্বপ্নের কথা বলেননি। কারণ সেই স্বপ্ন ইতোমধ্যে জনগণের কাছে পৌঁছে গেছে। তাই এবার তিনি স্বপ্ন বাস্তবায়নের পরিকল্পনার কথা বলেছেন। এই ব্যাখ্যার একটি যৌক্তিকতা আছে। তবে বিশ্লেষণ এখানেই থেমে গেলে আমাদের কাছে রাজনীতির একটি মৌলিক বিষয় অধরা থেকে যায়, যা এই ভাষণের গভীরতর তাৎপর্যকে সুস্পষ্ট করে।
বর্তমান লেখকের পর্যবেক্ষণ হলো- আমরা হয়ত তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণের একটি কেন্দ্রীয় দিক উপেক্ষা করছি। সেটি হলো- এই স্বপ্নটি আদৌ তারেক রহমানের নয়। তিনি নিজেকে কোনো স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে উপস্থাপন করেননি। বরং তিনি পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন- স্বপ্ন দেখেছে এ দেশের মানুষ। তিনি সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা করেছেন। অর্থাৎ, আমরা বুঝতে পারি- ‘হি হ্যাজ অ্যা প্ল্যান টু ফুলফিল দ্য ড্রিম অফ দ্য পিপল অফ বাংলাদেশ।’
এই অবস্থান রাজনীতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। এখানে স্বপ্নের মালিকানা জনগণের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। তিনি ধরে নিয়েছেন- এই দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারে, স্বপ্ন দেখতে সক্ষম। জনগণ জানে, কিসে তার কল্যাণ এবং কিসে তার ক্ষতি। তিনি জনগণকে অক্ষম, অজ্ঞ কিংবা রাজনৈতিকভাবে অপরিপক্ব হিসেবে বিবেচনা করেননি। বরং জনগণের স্বপ্নকে স্বীকৃতি দিয়ে নিজেকে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের একজন সংগঠক হিসেবে স্থাপন করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিরই একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশ তাঁর ঘোষিত ৩১ দফা। যদিও তাঁর দল থেকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে- এটি চূড়ান্ত বা শেষ কথা নয়। জনগণের চাহিদা, অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশা অনুযায়ী এই পরিকল্পনা পরিবর্তিত, পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত হতে পারে। অর্থাৎ পরিকল্পনাও জনগণের মতামতের ঊর্ধ্বে নয়। এটি একটি চলমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।
রাজনীতিতে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ের ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ থেকে তারেক রহমানের ‘আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান’- এই রূপান্তর কেবল শব্দগত নয়; এটি গভীর দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি মিথ প্রচলিত ছিল- জনগণ বোঝে না, জনগণ জানে না। তাই একজন নেতা বা একটি পরিবারই ঠিক করে দেবে জনগণের ভবিষ্যৎ। এই মিথই বহু রাজনৈতিক বিকৃতির জন্ম দিয়েছে।
তারেক রহমান এই মিথকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, এই মিথকে ভেঙে দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেছেন- এবং কার্যত স্বীকার করেছেন- জনগণ বোঝে, জনগণ জানে। এই দেশ নিয়ে জনগণ ইতোমধ্যে তাদের স্বপ্ন দেখে ফেলেছে। এখন প্রয়োজন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য একটি কার্যকর, অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক পরিকল্পনা। তাঁর বক্তব্য সেই দিকেই ইঙ্গিত করে। ১৯৪৭, ১৯৭১ কিংবা ২০২৪- প্রতিটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের পর আমরা শুনেছি- ‘অমুকের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য দেশ এগোচ্ছে।’ অর্থাৎ একজন মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নের ভার চাপানো হয়েছে কোটি মানুষের ওপর। এটি ছিল রাজনৈতিকভাবে এক ধরনের বেইনসাফি। নিছক একজনের কল্পনাকে জাতির ভবিষ্যৎ হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে দীর্ঘকাল।
তারেক রহমান এই রাজনৈতিক শৃঙ্খল ভাঙার কথা বলছেন। তিনি উল্টো প্রস্তাব দিচ্ছেন- ১৮ কোটি মানুষ একজনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে না; বরং ১৮ কোটি মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য একজন মানুষ পরিকল্পনা করবে এবং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অংশীদার করবে জনগণকেই। এখানে ক্ষমতার উৎস ও গন্তব্য- দুটিই জনগণ। এই অবস্থানই প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের মৌল দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জনতাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী- এটি কেবল সংবিধানের একটি বাক্য নয়। এটি যদি বাস্তবে কার্যকর হয়, তবে রাজনীতির ভাষা, দর্শন ও কাঠামো আমূল বদলে যেতে বাধ্য। এই বক্তব্য সেই পরিবর্তনের দিকেই ইঙ্গিত দেয়। এবং এই ইঙ্গিত দেন তারেক রহমান ‘স্টেটসম্যান’ হিসেবে।
তারেক রহমানের ‘আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান’ তাই নিছক একটি রাজনৈতিক ঘোষণা নয়; এটি একটি দিকনির্দেশনা। এটি বলছে- স্বপ্ন নেতৃত্বের একক সম্পত্তি নয়। স্বপ্ন জনগণের। আর রাজনীতি এবং একজন নেতার প্রকৃত কাজ হলো- সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সৎ, যুক্তিসঙ্গত ও অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করা। এই ধারণা যদি বাস্তবে রূপ পায়, তবে তা কেবল একটি দলের নয়- সমগ্র রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক, অ্যামাজন-তালিকাভুক্ত ‘হোয়াট ডু সিটিজেন্স থিঙ্ক’ 

 

 

নজরুল রাসেল

[email protected]