বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নয়া দিগন্তের মালিক মীর কাসেম আলী, সালাউদ্দিন কাদেরসহ অনেক আলেম ওলামাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে মিথ্যা মামলায়। এসব এই জাতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়।’
শনিবার (২৪ অক্টোবর) একটি পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অংশ নিয়ে তার এই মন্তব্যকে ঘিরে বিএনপিসহ পুরো রাজনীতিতে তোলপাড় চলছে।
বিএনপির সিনিয়র কয়েকজন নেতার ভাষ্য, মির্জা ফখরুলের মন্তব্যে তারা ‘শকড’। তাদের কারও-কারও প্রশ্ন, জামায়াতের নৈকট্য পাওয়ার চেষ্টা কি-না বিএনপির। কোনও রাজনীতিক অবশ্য মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্যকে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে না দেখার পরামর্শ দিয়েছেন; বলছেন বিভিন্ন সময় পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণেও রাজনীতিকরা মন্তব্য করেন, যা অতিমাত্রায় আলোচনার অংশ হলেও গভীর কোনও অর্থ নেই।
শনিবার জামায়াতের মীর কাসেম আলী প্রতিষ্ঠিত দৈনিক নয়া দিগন্তের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে গিয়ে মির্জা ফখরুল বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রকামী শক্তিগুলোর ওপর ফ্যাসিবাদী সরকারের দমন-পীড়নের কথা জাতি ভুলে যায়নি। ৬০ লাখ কর্মীর নামে মিথ্যা মামলা, ২০ হাজারের বেশি নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ড ও গুমের শিকার হয়েছেন। জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নয়া দিগন্তের মালিক মীর কাসেম আলী, সালাউদ্দিন কাদেরসহ অনেক আলেম ওলামাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে মিথ্যা মামলায়। এসব এই জাতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, তারা মির্জা ফখরুলের বক্তব্যে ‘শকড’। বিশেষ করে যখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে জামায়াতকে দূরে রাখার বিষয়টি দৃশ্যমান এবং এক ধরনের বিরোধিতায় পরিণত হয়েছে, তখন মহাসচিবের এমন মন্তব্য জামায়াতকে মাইলেজ দেবে।
একজন নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মহাসচিবের বক্তব্যে মনে হচ্ছে আমরা জামায়াতের ভার বইতে পারছি না। এজন্য তাদের নৈকট্য দরকার। তার মন্তব্য শীর্ষমহল থেকে বলা হয়েছে কি-না, এমন কোনও সম্ভাবনা নেই। বিশেষ করে যখন জামায়াত আগামী দিনে বিএনপির সঙ্গে সরকার গঠন করতে নানামাত্রিক চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু বিএনপির নেতৃত্ব এখন পর্যন্ত এই কৌশলে নেই। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখনও জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব আছে যোজন। এই পরিস্থিতিতে উনার বক্তব্য আমাদের বিস্মিত করেছে। আমরা শকড।’
একজন কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতার মন্তব্য, ‘মির্জা ফখরুল কি ঐতিহাসিক সত্যটা লুকিয়ে দিতে চেয়েছেন? দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে রায়ের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে জামায়াতের নেতাদের ফাঁসি হয়েছে। এমনকি বিএনপির সাকা চৌধুরীরও। এ ক্ষেত্রে তিনি বিস্ময়ের জন্ম দিলেন।’
এটা কি ভবিষ্যতে দল দুটোকে পাশাপাশি করার অংশ কি-না, সেই প্রশ্নও রাখেন এই নেতা।
তবে গণতন্ত্রমঞ্চের অন্যতম নেতা, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের পর্যবেক্ষণ আলাদা। তিনি বলছেন, ‘একটা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সামরিক সহায়তা, গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকার যেসব অপরাধের বিষয়ে অভিযোগ এসেছিল, দেশবাসীর এসব নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ছিল, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ফরমায়েশি অনেক কিছু যুক্ত ছিল, এটা সত্য। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই জামায়াতের নেতারা তা করেছিলেন।’
‘কিন্তু বিএনপি মহাসচিব যা বলেছেন, এটাকে আমি দেখছি এভাবে-রাজনীতিতে বিভিন্ন সময় নেতারা বিভিন্নরকম মন্তব্য করেন। কখনও পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে স্লিপ অব টাং হয়। এত গুরুত্ব দিয়ে বা আমলে নেওয়ার কিছু নেই।’ বলেন সাইফুল হক।
এই বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। তবে তার ঘনিষ্ঠরা শনিবার রাতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন, বিএনপি মহাসচিব কোনও পূর্ব পরিকল্পনা থেকে মিথ্যা মামলার বিষয়ে বলেননি। পত্রিকাটি জামায়াতের নেতার প্রতিষ্ঠিত এবং দলটির মুখপত্র হিসেবে পরিচিত বলে পরিবেশের কারণেই তিনি ‘কথার কথা’ হিসেবে বক্তব্যে এসেছে। ‘স্লিপ অব টাং’ হিসেবে তার মন্তব্যে এসেছে, বলেও জানান একজন ঘনিষ্ঠ।
একজন প্রভাবশালী শুভানুধ্যায়ী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আপাতমস্তক একজন রাজনীতিক। তিনি সময়ের সেরা রাজনীতিটা বুঝেন এবং করতে পারেন। তিনি দেশের এবং দলের স্বার্থটা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।’
বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে আরেকজন ঘনিষ্ঠ দুই শব্দে উল্লেখ করেন, ‘বুঝি নাই।’
দৈনিক নয়া দিগন্তের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিএনপির মহাসচিবের বক্তব্য ছিল মূলত আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণ ও গ্রহণযোগ্য করার প্রত্যাশাকে ঘিরে। তিনি সেখানে বলেন, ‘ঐক্যের মাধ্যমে আমরা একটি গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই।’ এ সময় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সবাইকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।
এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সংস্কার সনদে স্বাক্ষরিত দলগুলোর ঐক্যের মাধ্যমে আমরা একটি গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সবাইকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। ছোটখাটো সমস্যা দূরে রেখে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে সব রাজনৈতিক দলকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানাই।’
পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ড. আব্দুল মঈন খান, সালাহ উদ্দিন আহমদ, রুহুল কবির রিজভী আহমেদও বক্তব্য রেখেছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘আদর্শ ও মতের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্রের স্বার্থে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সবাইকে এক হতে হবে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তনের সব দরজা বন্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ফ্যাসিবাদে নয়া দিগন্ত গণতন্ত্রের আলো জ্বালিয়ে রেখেছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ মন্তব্য করেন, ‘আমাদের ভরসার জায়গা নয়া দিগন্ত।’
শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) সন্ধ্যায় বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনী কোনও নৈকট্য হচ্ছে কি-না, এমন প্রশ্ন ছিল জামায়াতের অন্যতম নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহেরের কাছে। তিনি বলছিলেন, ‘এ ধরনের কোনও আলোচনা নাই।’