ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বৃহৎ জোট গঠনে তৎপর বিএনপি। আসনভিত্তিক দলীয় একক প্রার্থী ঠিক করার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছিল এমন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠনকেই এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। বেশকিছু দল বিএনপির সঙ্গে জোট গঠন করতে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ রাখছে। পর্দার আড়ালে চলছে আলোচনাও। যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত থাকা মিত্র দল ও জোটের বাইরেও বাম-ডান, মধ্যম ও ইসলামপন্থি অনেক দল এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরে দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবেন। তফশিল ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিকভাবে জোটের ঘোষণা আসবে।
এদিকে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির সঙ্গে বিএনপির নির্বাচনি জোট বা কোনো আসন সমঝোতা হয় কিনা, এ নিয়ে আগ্রহ রয়েছে রাজনৈতিক মহলে। তবে এনসিপির বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব বিএনপির। এ নিয়ে এনসিপির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য। ইতোমধ্যে কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। এরই অংশ হিসাবে কয়েকটি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সবুজ সংকেত না দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির নেতৃত্বে একটি বৃহৎ জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এতে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোট ছাড়াও যুগপৎ-এর বাইরে হাসিনা সরকারবিরোধী মনোভাবাপন্ন দলগুলোর সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী ও গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনি জোটে আসতে চাইবে তাদের সবাইকেই এর অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’
এনসিপি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দলটির সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে। তবে জোটবদ্ধ হবো কী হবো না, তারা হবে কী হবে না-সেটি রাজনীতির মাঠে; কোনো কিছুই আগে থেকে বলে দেওয়া যায় না।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এবারের নির্বাচনে জোটই হতে পারে ইতিবাচক ফল নির্ধারণের বড় উপাদান। কারণ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের কিছু নির্বাচনি এলাকায় ভোটের ব্যবধান খুবই কম বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে কয়েকটি ছোট দলের ভোটই ভারসাম্য বদলে দিতে পারে সেসব ক্ষেত্রে। সব মিলে আসন্ন ভোটে জোটের সমীকরণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারা কার সঙ্গে যাবে, কত আসনে ছাড় দেবে, আর শেষ পর্যন্ত কে কাকে ভরসা করবে-সেই হিসাবই এখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি ও তাদের মিত্র উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে একটি জোট হবে। বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। এই দলের নেতৃত্বাধীন জোট হলে সেখানে মিত্র ছাড়াও আরও অনেক দল থাকবে। সেক্ষেত্রে বিএনপির বিরাট চ্যালেঞ্জও রয়েছে। জোটের শরিকদের আসন ছাড় দিলেই হবে না, দলের কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী যেন শরিকদের আসনে প্রার্থী না হয় তাও দেখতে হবে বিএনপির। তবে শরিকদেরও এলাকার জনপ্রিয়তা যাচাই-বাছাই করে আসন ছাড় দেওয়া উচিত। মিত্র অনেক দলে জাতীয় নেতা আছেন, কিন্তু তার নিজ এলাকায় তিনি জনপ্রিয় নন। তাদের অন্যভাবেও মূল্যায়ন করার সুযোগ আছে বিএনপির। সেটা সংসদের উচ্চকক্ষও হতে পারে। তাছাড়া কেবিনেটে নেওয়ার সুযোগ তো থাকছেই।’
ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য ইতোমধ্যেই মাঠে কাজ শুরু করে দিয়েছে বিএনপি। চলতি মাসে ২শ আসনে একক প্রার্থীকে সবুজ সংকেত দেওয়ার কথা জানিয়েছে দলটি। এজন্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করছে। এরই অংশ হিসাবে কাল সোমবার ঢাকা ও বরিশাল বিভাগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বৈঠকে বসবে। সেখানে ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে নানা দিকনির্দেশনা দেবেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলীয় একক প্রার্থী ঠিক করার পাশাপাশি জোটের পরিধি বাড়াতেও এখন ব্যস্ত সময় পার করছে দলটির দায়িত্বশীল নেতারা।
জানা গেছে, যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ছিল এমন সমমনা দল ও জোটসহ অন্যান্য উদার গণতান্ত্রিক, বাম, ইসলামি ও আলেমদের সমন্বয়ে জোট গঠন করা হবে। এ নিয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। মিত্র দল ও জোটের মধ্যে যথাক্রমে গণতন্ত্র মঞ্চ (জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী জনশক্তি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), ১২-দলীয় জোট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), ১১ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, চারদলীয় গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, গণফোরাম, বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি) ও লেবার পার্টি বিএনপির বৃহৎ জোটে থাকছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া এনসিপি, গণঅধিকার পার্টিসহ আরও বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে দলটির। অন্যদিকে দেশের আলেম সমাজ ও তাদের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে পাশে চায় বিএনপি। এজন্য দলটির নেতারা এরই মধ্যে হাটহাজারী মাদরাসা, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির, ছারছীনা পীর, আলিয়া মাদরাসা-ধারার যেসব মুরুব্বি ও আলেম আছেন, তাদের সঙ্গেও দেখা করেছেন।
বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নভেম্বর মাসে দেশে ফিরবেন। তার আগেই জোট নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া অনেকটাই এগিয়ে রাখতে চান দায়িত্বশীল নেতারা। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশে ফিরলে এসব দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এরপর তফশিল ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিকভাবে জোট গঠনের বিষয়ে ঘোষণা করা হবে।
তবে আরেক সমীকরণও রাজনীতিতে আলোচনায় রয়েছে। তরুণদের দল এনসিপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদসহ আরও কয়েকটি দলেরও জোট করার গুঞ্জন রয়েছে। একটি সূত্র বলছে, এই জোট হলে তারা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে এলায়েন্স করতে পারেন। অথবা পৃথক জোটে থেকেই বিএনপির সঙ্গে ‘আসন সমঝোতা’ হতে পারে। তবে এনসিপির দুজন কেন্দ্রীয় নেতা যুগান্তরকে জানান, একাধিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের আলোচনা চলছে। এনসিপি কারও সঙ্গে জোটে যাচ্ছে নাকি এককভাবে নির্বাচন করবে-সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনো হয়নি। তারা পরিস্থিতি বিবেচনা করছেন।
গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না যুগান্তরকে বলেন, ‘জোট গঠনের আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে মাত্র। দেখা যাক সেটি কীভাবে গঠিত হয়। তবে আমরা বিএনপির সঙ্গে শুরু থেকেই আছি।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা চাইব বিএনপির সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য। গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে অন্য এক আলাপ-আলোচনা চলছে। সবার সঙ্গেই আমরা কথাবার্তা বলব।’
১২-দলীয় জোটের প্রধান জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আমরা যুগপৎ আন্দোলনে ছিলাম। আগামী নির্বাচনেও একসঙ্গে অংশগ্রহণ করব।’
গণফোরামের অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপির নেতৃত্বে যে নির্বাচনি জোট হতে যাচ্ছে, তাতে আমরা আছি। এরই মধ্যে আমরা সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকাও জমা দিয়েছি তাদের কাছে।’
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের প্রধান এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে আমাদের জোট ছিল। ভবিষ্যতেও যে কোনো মেরুকরণে বিএনপির সঙ্গে থাকব।’ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান জানান, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি যে জোট করতে যাচ্ছে, তার সঙ্গে তাদের দল রয়েছে।