Image description

৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদেরকে নতুন ভাবে  পরিচালিত করবে এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গুণগত পরিবর্তন আসবে এই ছিল জনপ্রত্যাশা। যেহেতু বাংলাদেশ দীর্ঘ ১৬ বছর একটি ভয়াবহ  স্বৈরশাসনের অধীনে ছিল, তাই স্বাভাবিকভাবেই ৫ আগস্টের পর এই প্রত্যাশার পারদ চরম পর্যায়ে পৌঁছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিপর্যায়ে বঞ্চিত মানুষগুলো নানান দাবি দাওয়া নিয়ে প্রতিদিন রাস্তায় আন্দোলন করছে যা এখনও চলমান। এর পেছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে; কারণ মানুষ দীর্ঘ দিন অধিকার বঞ্চিত ছিল। 

নানান সময়ই পতিত ফ্যাসিস্ট বিভিন্ন অপকৌশলের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী  সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রথম থেকেই ফ্যাসিস্ট বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে এই অপপ্রয়াসকে রুখে দিয়েছে। যেহেতু গত ১৬ বছরের অবর্ণনীয় স্বৈরশাসনের সময় দেশের সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল; তাই রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়৷ অন্তর্বর্তী সরকার কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে যার মধ্যে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দূর্নীতি দমন কমিশন ও সংবিধান সংস্কার—এই ছয়টি সংস্কার কমিশন নিয়ে ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়। এছাড়াও স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, নারী অধিকার কমিশনও গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। 

প্রত্যেকটি কমিশন আলাদা আলাদাভাবে সব রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে সংস্কার প্রস্তাব লিপিবদ্ধ করে সরকারের কাছে জমা দেয়। ছয়টি সংস্কার কমিশন নিয়ে যে ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়, তারা গত ১৫ ফেব্রুয়ারী থেকে কাজ শুরু করে। ১৭ অক্টোবর ২০২৫, জুলাই সনদ স্বাক্ষর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশন নিরলসভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে।

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য হয় এবং এর মধ্যে ৯টি সাংবিধানিক বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো নোট অব ডিসেন্ট দেয়।  নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো নিয়ে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল তাদের নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা প্রদান করে ঐকমত্য কমিশনে। 

ঐকমত্য কমিশনের সর্বাত্মক প্রয়াস ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদের দূরত্ব কমিয়ে আনা। তারা সেই চেষ্টাটা অব্যাহতভাবে করে গেছে। বিএনপি খুব ঐকান্তিকভাবে প্রথম থেকেই ঐকমত্য কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের নিজস্ব মতামত দিয়ে সহযোগিতা করেছে। এনসিপি এবং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে প্রথম থেকেই আন্তরিকতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। তারা প্রথম থেকেই এমন অনেক প্রস্তাব নিয়ে কথা বলছিল বা এখনও বলছে যা বাংলাদেশের বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একদমই অবাস্তব। যেমন পিআর পদ্ধতি। বাংলাদেশে কখনোই পিআর পদ্ধতি নিয়ে কোনো স্টাডি হয়নি, আর তা ছাড়াও বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন যাবৎ একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ভোট দিয়ে অভ্যস্ত। তারা ভোটকে উৎসব হিসেবে নেয় এবং প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালায়। তাই প্রার্থী না দেখে সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে নির্বাচন প্রক্রিয়া ভোট উৎসব এবং নির্বাচন সবকিছুকেই একটি প্রহসনে পরিণত করত।

এনসিপি ঐকমত্য কমিশনে প্রথম থেকেই নতুন সংবিধানের প্রস্তাবনা করে আসছে আবার গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছে এবং সংবিধান চলমান। সংবিধান স্থগিত হয়নি। সমস্ত কার্যক্রম বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে চলছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের একটা প্রস্তাবনা ছিল, যেই বিষয়গুলো নিয়ে ঐকমত্য হবে শুধুমাত্র সেই ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো নিয়েই জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি হবে। বিএনপি সহ অপরাপর অনেকগুলো রাজনৈতিক দল ও জোট এটাকে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনে এনসিপি খুব জোরেশোরে নতুন সংবিধানের দাবি ক্রমাগত তুলতে থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রস্তাবনা নিয়ে নানান রকম চাপ প্রয়োগ করতে থাকে।

বিএনপির প্রতিনিধি সালাহউদ্দিন আহমেদ একটা পর্যায়ে বলেই ফেলেন—সব বিষয়েই যদি সবাই একমত হয় তাহলে আর ঐকমত্য কমিশনে বসার কি দরকার। এনসিপির রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে মনে হয় তারা স্বিদ্ধান্ত নিয়েছে যে কোনো প্রক্রিয়ায় হোক নির্বাচনকে প্রলম্বিত করা অথবা নির্বাচন হতে না দেওয়া। কারণ বিএনপি তাদের অনেক দাবি থেকে সরে এসেছে শুধুমাত্র ঐক্যের স্বার্থে। যেমন সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন,  এক ব্যক্তির সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা সহ এরকম অনেক বিষয়—যার জন্য বিএনপিকে ৩১ দফার অনেক প্রস্তাবনার সঙ্গেও সেক্রিফাইস করতে হয়েছে। যখনই বিভেদ দেখা দিয়েছে বিএনপি বৃহত্তর স্বার্থে ছাড় দিয়েছে।

একটা বিষয় নিয়ে এনসিপি এবং জামায়াতে ইসলামী জল ঘোলা করছিল আর তা হচ্ছে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন। ঐকমত্য কমিশন থেকে প্রস্তাব ছিল পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ দুই বছরের মধ্যে সংবিধান সংশোধন সম্পন্ন করবে। কিন্তু এনসিপি এবং জামায়াত ঐকমত্য কমিশনের সভায় এ নিয়ে উচ্চবাচ্য না করলেও সভা শেষ হলে এবং জুলাই সনদের খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পর এ নিয়ে আওয়াজ তোলে এবং বিশেষ সাংবাধিনক আদেশ, গণভোট সহ নানান রকমের প্রস্তাবনা করতে থাকে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে যত সাংবিধানিক পরিবর্তন হয়েছে তার সবই হয়েছে মূলত সংসদে। সংসদের সেই Legitimacy থাকে। ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার থেকে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পরবর্তী সংসদই সংবিধানে সন্নিবেশিত করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংসদের মাধ্যমেই সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়। বাংলাদেশের আইন বিশেষজ্ঞরাও বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাবনার পাশাপাশি সংসদকেই সবচেয়ে জোরদার মনে করেছে।

কিন্তু যেহেতু এনসিপি এবং জামায়াত বলছে তাদের অবিশ্বাসের কথা, তাই বিএনপি বৃহত্তর স্বার্থে গণভোটের প্রস্তাবনা মেনে নেয় এবং গণভোট সুন্দর সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য জাতীয় নির্বাচনের দিনকেই উৎকৃষ্ট বলে মনে করে। কারণ এতে খরচ বাঁচবে এবং একই দিনে ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন। এতেও বাধা দেয়  এনসিপি এবং জামায়াত। তার নির্বাচনের আগে নভেম্বরে গণভোট করতে বলে। ইতিমধ্যে ঐকমত্য কমিশন কয়েকদফা সময় বৃদ্ধি করে আলোচনা চালিয়ে যায় আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক ভাবে। 

এনসিপি প্রথম থেকেই ঐক্য প্রক্রিয়ায় এবং সংস্কার প্রক্রিয়ায় নিজেদেরকে আপার এন্ডে রাখার চেষ্টায় মত্ত বলে মনে হচ্ছে। তারা নিজেদেরকে গণঅভ্যুত্থানের একমাত্র স্টেকহোল্ডার মনে করে। যার ফলে তারা তাদের সাংবিধানিক চিন্তাগুলো অন্য দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দিতে চায় যেন। তারা নিজস্ব কর্মসূচি ২৪ দফা দিয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত তরুণ দল হিসেবে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য,  কৃষি বিষয়ক কোনো ডিটেইল পেপার ওয়ার্ক জাতির সামনে হাজির করেনি। হাজির করেছে অনৈক্যের বিষবাষ্প।  বিএনপিকে আক্রমণ করে কথা বলাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে ঐকমত্য কমিশনে বিএনপির প্রতিনিধি সালাহউদ্দিন আহমেদকে কুৎসিত মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেনি তারা।

এনসিপি এখন কিছুটা পথহীন নাবিকের মত।  পরনির্ভরশীল রাজনীতি তাদেরকে এ পথে নিয়ে এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান সব রাজনৈতিক দলকে ডেকে বৃহত্তর স্বার্থে জুলাই সনদে স্বাক্ষরের অনুরোধ জানায়। ১৭ অক্টোবর ২০২৫ দিন ধার্য করা হয়। হঠাৎই মধ্যরাতে এনসিপি জানায় তারা সনদে সই করবে না এবং অনুষ্ঠান বয়কট করবে।

এরপরের ঘটনা সবার জানা। ‘জুলাই যোদ্ধা’ পরিচয়ে এদিন সকাল থেকেই অনুষ্ঠানস্থল দখল করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে থাকে কিছু লোক। তাদের দাবি অনুযায়ী অঙ্গীকারনামায় সংশোধনীর পরও তারা নানান রকম বাধা সৃষ্টি করতে থাকে। 

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে তরুণদের প্রতি মানুষের অগাধ আস্থা ছিল। কিন্তু ক্রমাগত তরুণ উপদেষ্টাদের দুর্নীতির খবর এবং এনসিপি গঠিত হওয়ার পর চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট সংবাদে মানুষ চরমভাবে হতাশ হয়। জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ স্বাক্ষরে এনসিপির আচরণ তাদের রাজনৈতিক শিক্ষা ও পরিপক্বতার অভাবকে প্রকটভাবে তুলে ধরে। এনসিপির রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব দিনে দিনে দলটিকে বাংলাদেশের পরিমন্ডলে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে এবং তরুণদের মাঝ থেকে একটি জনবান্ধব রাজনৈতিক দল গড়ে উঠার সম্ভাবনাকে নিঃশেষ করে দেবে!

লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান