
আবদুল লতিফ মাসুম
‘নাগরিক সমাজ’ শব্দটি ইংরেজি ‘Civil Society’-এর বাংলা পারিভাষিক রূপ। এই শব্দটির উৎস প্রাচীন ত্রিসে। প্রথমে অ্যারিস্টটল তার ‘রাজনীতি’ (Politics) গ্রন্থে গ্রিক শব্দ ‘কইনোনিয়া পলিটিকে’ ব্যবহার করেছিলেন, যার অর্থ ছিল ‘রাজনৈতিক সম্প্রদায়’। এই রাজনৈতিক সম্প্রদায় ছিল মূলত গ্রিক নগররাষ্ট্র বা ‘পলিস’-এর নাগরিকদের সমষ্টিÑযেখানে নাগরিকরা নির্দিষ্ট নিয়ম, নীতি এবং আইনের শাসনের অধীনে জীবনযাপন করতেন। নাগরিক সমাজ ধারণাটি আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বে দীর্ঘ ইতিহাস বহন করে। আধুনিককালে, বিশেষ করে বিশ শতকের শেষভাগে পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় এই শব্দটির পুনর্জাগরণ ঘটে। চেক লেখক ও নেতা ভাক্লাভ হাভেল এবং তার মতো ভিন্নমতাবলম্বীরা ‘নাগরিক সমাজ’ শব্দটি ব্যবহার করেন রাষ্ট্রের বাইরে থাকা এমন একটি সামাজিক বলয় বোঝাতে, যেখানে সাধারণ মানুষ স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ, সংগঠন ও প্রতিবাদ করতে পারে। এটি ছিল কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের আত্মপ্রকাশ ও অধিকার রক্ষার প্রতীক। উত্তরাধুনিক অর্থে ‘নাগরিক সমাজ’ শব্দটির ব্যবহার প্রথম দেখা যায় ১৯৭৮-৭৯ সালে আলেকজান্ডার স্মোলারের লেখায়, যেখানে এটি রাজনৈতিক বিরোধিতা বা প্রতিরোধমূলক রাজনীতির অর্থে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশের ২০২৪-এর গণআন্দোলনে মূলত ছাত্রসমাজই সিভিল সোসাইটির কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করে। এভাবে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সিভিল সোসাইটি, গণতন্ত্র নির্মাণ, সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। সিভিল সোসাইটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে গণতন্ত্র অর্জন। এর অন্য অর্থ ভিন্নতার মধ্যে ঐক্য স্থাপন। সিভিল সোসাইটি সমাজের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা বিভিন্ন গ্রুপের দাবি-দাওয়াকে সমন্বিত করে একটি সামগ্রিক (কম্প্রিহেনসিভ) দাবি উত্থাপন করে। একটি সমাজে বিভিন্ন ধরনের ডিসকোর্স থাকে। যেমন : ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, লিঙ্গ ও সংস্কৃতি ইত্যাদি। সমাজে বিদ্যমান এসব ডিসকোর্সে কীভাবে পুনর্গঠন করা যায়, এ নিয়ে সিভিল সোসাইটি কাজ করে। একটি সমাজে পশ্চাৎপদতা ও আধুনিকতা উভয়ই থাকে। এই পশ্চাৎপদতা ও আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয়ের জন্য সিভিল সোসাইটি সমাজকে পুনর্মূল্যায়নের দিকে ধাবিত করে। এগুলোর মাধ্যমে সিভিল সোসাইটি একটি সাধারণ বয়ান তৈরি করে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়। বাংলাদেশের অভ্যুত্থান পর্বে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের আগে একটি সবল ও সফল সিভিল সোসাইটি তথা বুদ্ধিজীবী শ্রেণি মুক্তির আন্দোলনকে এগিয়ে দেয়। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে শাসক শ্রেণির, বিশেষত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট ক্যারেক্টারের কারণে সিভিল সোসাইটির রাজনৈতিক ভূমিকা ক্রমহ্রাসমান ও সরকার অনুবর্তী হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের জন্মলগ্নে যে সিভিল সোসাইটি ছিল সোচ্চার, কার্যকর ও প্রাধান্যশীল, স্বাধীনতা লাভের পর তারা হয়ে দাঁড়ান নীরব, অকার্যকর ও অপ্রাধান্যশীল। রাষ্ট্রব্যবস্থার কার্যকর নির্মাণে তাদের তেমন কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যায় না। বরং নতুন করে একদল বুদ্ধিজীবী বের হন, যারা আওয়ামী বয়ানকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দান করেন। শাসক শ্রেণির জন্য নয়া বয়ান নির্মাণে তারা ভূমিকা রাখেন। মুজিববাদ গ্রন্থ রচিত হয়। বাকশালের পটভূমি ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা হয়। বাকশাল কায়েম হলে চারদিকে শুধু প্রশংসা ও প্রশস্তি শোনা যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সংগতভাবেই তাদের ভূমিকা নিষ্ক্রিয় ও নিষ্প্রভ হয়ে যায়। জিয়াউর রহমানের শাসন আমলে আদর্শিক শূন্যতা ও নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তায় কিছু বুদ্ধিজীবী সক্রিয় হন। এরা বাঙালি জাতীয়তাবাদীর বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি নির্মাণে সহায়তা করেন। এ সময় ডান ও বামের একটি প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতাও লক্ষ করা যায়। প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি মূল্যবোধকে তার শাসনের ভিত্তিমূল হিসেবে গ্রহণ করেন। সিভিল সোসাইটির একটি বড় অংশ প্রেসিডেন্ট জিয়ার গণমুখী ও প্রগতিশীল ভাবধারাকে তুষ্ট করার জন্য এগিয়ে আসেন। পরে রাষ্ট্রপতি এরশাদের সময় প্রশস্তি রচনায় কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীকে ব্যস্ত দেখা যায়। এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনের সময় বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একটি অংশ সরবভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন দেয়। নব্বইয়ের পর বুদ্ধিজীবীদের একাংশ শাসক শ্রেণিকে বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তায় এগিয়ে এলেও ব্যাপকভাবে এর কার্যকারিতা লক্ষ করা যায় না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় পুনঃস্থাপনের পর আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের যে অংশ এতকাল নীরবে ও নিভৃতে কাজ করছিল, তারা সরব হয়ে ওঠে। ধর্মনিরপেক্ষতার বয়ান নতুন করে রচিত ও অনুরচিত হয়। আবার সংবাদপত্রের ওপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। দৈনিক বাংলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রা শেখ রেহানার কাছে বন্ধক দেওয়া হয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় ফিরে এলে এই বুদ্ধিজীবীদের কার্যক্রমে সাময়িককালের ছেদ ঘটে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এরা আবার সরব হয়ে ওঠে। মানবাধিকারের পক্ষে এরা বড় বড় কথা বললেও ২৮ অক্টোবরের মতো লগি-বইঠা তাণ্ডবের বিপক্ষে এরা টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করেনি। বরং ১/১১-এর পটভূমি তৈরিতে এরা মুখ্য ভূমিকা রাখে। এক এগারোর এর সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে এর প্রকারান্তরে এ সরকারকে সমর্থন জোগায়।
উল্লেখ্য, এক এগারোর সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে তথাকথিত সিভিল সোসাইটির প্রাধান্য ছিল। অবশেষে সেনাবাহিনীর একটি অংশ এবং তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নীলনকশায় একটি প্যাকেজ ডিলের আওতায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসে। ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল পরিকল্পিত। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ একটি বড় ধরনের বশংবদ বুদ্ধিজীবী শ্রেণি তৈরি করতে সক্ষম হয়। শেখ মুজিবকে তথাকথিত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপপ্রয়াস চালায়। মুজিববন্দনা এতটাই প্রকট হয়ে দাঁড়ায় যে, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি অফিস-আদালত এমনকি ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোও মুজিববন্দনার কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। দেশের এক ক্ষুদ্র বুদ্ধিজীবী অংশ যখন শেখ হাসিনা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিলেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বিরাট অংশ সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশ এবং পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য অংশ সরকারের বন্দনায় নিয়োজিত থাকে। নোবেলজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর যখন আওয়ামী খড়গ উত্থিত হয়, তখন বিদেশের শ্রেষ্ঠ মানুষ এর প্রতিবাদ জানান। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সমাজের একটি সক্রিয় অংশ হাসিনা স্বৈরাচারের প্রতিবাদ করে জেল-জুলুম ও নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়। আলেম সমাজের বৃহৎ অংশ আওয়ামী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সবসময় সক্রিয় থাকে। ২০১১ সালে হেফাজতে ইসলামের ওপর গণহত্যা পরিচালিত হয়। প্রতিবাদ করতে গিয়ে অধিকার আন্দোলনের নেতারা কারাবরণ করেন। অথচ দেশের বিবেক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের থেকে তেমন কোনো প্রতিবাদ উত্থিত হয়নি। বরং পুরো আওয়ামী শাসনকাল ধরে এই লেখক-বুদ্ধিজীবীরা মৌলবাদের ভয় দেখিয়ে সরকারের অন্যায় ও অপকর্মকে জায়েজ করেছেন। এমনকি ছাত্র আন্দোলনের সূচনাকাল থেকে জনগণের ওপর যত অত্যাচারের স্ট্রিম রোলার চলছিল, তখন আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা টকশোতে এবং বিবৃতি দিয়ে স্বৈরাচারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলেন। এত যে রক্তক্ষরণ ও নির্মমতা, তাদের হৃদয়ে কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেনি। দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী রক্তপাতের মধ্যেও চিরকাল স্বৈরাচারের সমর্থনের কথা বলছিলেন।
৫ আগস্ট স্বৈরাচারের পতনের পর তারা কিছুটা সময় ঘাপটি মেরে নীরব থাকলেও শেখ সাহেবের বাড়ি ধূলিসাতের জন্য এরা মর্মবেদনা প্রকাশ করেন। দিল্লির বিবৃতির সঙ্গে সংগতি রেখে এরা ৩২ নম্বরের জন্য গণমাধ্যমে হাহাজারি প্রকাশ করতে থাকেন। ভারতীয় বয়ানে যখন তথাকথিত সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের কল্পকাহিনি প্রকাশ করা হয়, তখন এরা তাদের সমর্থনে বিবৃতি দেন। মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করেন। সরকারের বিরোধিতার জন্য তারা সুযোগ খুঁজতে থাকেন। কিছু লোক মাজারে ও ওরস মোবারকের বিরোধিতা করলে তাদের সমর্থনে এরা এগিয়ে আসেন। অধিকারের নামে এরা বিবৃতি দেন। আবার যখন নারী প্রসঙ্গের মতো স্পর্শকাতর বিষয় আসে, তখন তারা নারীদের অধিকার রক্ষায় নামেন। নারী অবমাননাকারী বিষয়কেও সমর্থন দেন। এরা নির্লজ্জের মতো নারী যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষায়ও কথা বলেন। এরা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উসকে দেন। এই সেদিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম তাদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন।
এখন যখন সিভিল সোসাইটি তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে রাষ্ট্র পুনর্নির্মাণ ও রাষ্ট্রের সংস্কারে ব্যস্ত, তখন এই তথাকথিত আওয়ামী বুদ্ধিজীবী শ্রেণি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। মানবাধিকারের পক্ষে মায়াকান্না করছে। অথচ সেদিন অর্থাৎ আওয়ামী আমলে তারা অন্যায়-অত্যাচার, নিপীড়ন-নির্যাতন ও গুম-খুনের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। সুতরাং বোঝা যায়, তাদের দেশপ্রেম অন্য দেশনির্ভর। এই স্বদেশ তাদের দেশ নয়। এর চেয়ে আত্মপ্রতারণা আর কী হতে পারে! সচেতন নাগরিক সাধারণ এই তথাকথিত সিভিল সোসাইটি থেকে দেশ ও জাতির মুক্তি কামনা করে।