Image description

রাজধানীর পুরান ঢাকা যেন পুরোটাই কেমিক্যালের গোডাউন। যে কারণে মাঝেমাঝেই ঘটছে দুর্ঘটনা। গুরুতর দগ্ধের পাশাপাশি মারাও গেছেন বহু মানুষ। আইন অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় এসব কারখানা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। পুরানো ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদতো দূরের কথা, চাইলে কেমিক্যালের নতুন ব্যবসায়ীরাও জায়গা করতে পারছেন পুরান ঢাকায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নগরী থেকে এখনই এসব কারখানা না সরালে আবারও কোনো মারাত্মক অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী হতে হবে পুরান ঢাকার মানুষকে।

লালবাগের ঢাকেশ্বরী রোড। যার একপাশে উপ-পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়; অন্যপাশে ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন। একটু সামনে এগোলেই দেখা মিলবে চলছে প্লাস্টিক তৈরির মহাকর্মযজ্ঞ। প্রশাসনের ঠিক নাকের ডগায় আবাসিক এলাকার পেটের ভেতর গড়ে ওঠা এই কারখানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্লাস্টিক, আছে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ। বিভিন্ন কারখানার কর্মচারীরা বলছেন, আবাসিক এলাকায় এরকম কারখানা দেয়া যায় না। তবে লালবাগ প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে কারখানা আছে।

 
একই এলাকার হরিনাথ ঘোষ রোডে এবার সময় সংবাদ। ক‍েমিক‍্যাল কারখানার জন্য একটি গোডাউন ভাড়া নিতে টু-লেইটে দেয়া নাম্বারে কল করতেই রাজি বাড়ির মালিক। ভাড়া চান ১৭ হাজার টাকা। এরপর সরাসরি সেই মালিকের সঙ্গে কথা বলে সময় সংবাদ। তবে তিনি সুর পালটে জানান, শুধু রঙের জন্য কারখানা ভাড়া দিতে চেয়েছেন তিনি।
 
নজর দেয়া যাক টিকাটুলির মামুন প্লাজার দিকেও। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে একই ভবনের উপরে আবাসিক এবং নিচে কেমিক্যালের বাণিজ্যিক কার্যক্রম। শুধু এই এক ভবন নয়; পুরান ঢাকার প্রায় সব ভবনেরই একটি দশা। এই বিষয়ে কথা বলতে গেলে সেখানকার ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে পরতে হয় সময় সংবাদকে। তারা বলেন, এখানে বাইরের মানুষ আসে না। কেমিক্যাল আসে, আবার বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
 
সবশেষ লালবাগের বাষপট্টি এলাকায় সময় সংবাদ; যেখানে কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠেছে বহু প্লাস্টিক কারখানা। যাদের নেই কোনো ট্রেড লাইসেন্স, নেই পরিবেশ ছাড়পত্র। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘আল্লাহ না চাইলে এসব দ্রব্য জ্বলবে না। তবে এটি নিষিদ্ধ হওয়ায় সরকার থেকে ট্রেড লাইসেন্স দেয় না।’
 
বাড়ির পাশেই এমন অবৈধ প্রাণঘাতী কর্মযজ্ঞে আতঙ্কিত এলাকাবাসী। কিন্তু নিরাপায় তারা। এলাকাবাসী জানান, কর্তৃপক্ষের কাছে বলা হলেও কোনো সমাধান মিলছে না। যাদের এসবের ব্যাবসা করছে তাদের তোপে কিছু বলাও যায় না। সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয়।
 
এসব প্লাস্টিক ও কেমিক‍্যাল গোডাউন উচ্ছেদে ফায়ার সার্ভিসের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললে সচেতনতার তাগিদ দিয়ে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা জানালেন সংস্থাটির মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল। তিনি বলেন, ‘আমাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নেই। কোনো জায়গায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে চাইলে ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজন হয়। সচেতন করে মানুষকে নিয়েই আইনের প্রয়োগ করতে হবে।’
 
 
আর নগরবিদরা বলছেন, এখনই আবাসিক এলাকা থেকে এই প্রাণঘাতী ব‍্যবসা সরানো না গেলে পরবর্তী ট্র্যাজেডির জন্য প্রস্তুত থাকা ছাড়া উপায় নেই।
 
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘যদি কেউ বেআইনিভাবে কোনো আবাসিক এলাকায় অনুমোদনবিহীনভাবে গোডাউন রাখে, তাহলে তার শাস্তি অনেক বাড়াতে হবে। কারণ এটি সরাসরি গণহত্যার ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। এ ধরনের স্থাপনাকে সাধারণ একটি গোডাউন হিসেবে না দেখে বড় ধরনের বিস্ফোরণের সম্ভাব্যতা বিবেচনায় আইনের সংশোধন প্রয়োজন। এ সংক্রান্ত নীতি ও নতুন আইন তৈরি করা জরুরি।’
 
নিমতলী, চুড়িহাট্টা কিংবা গাজীপুর। একেকটি অগ্নিকাণ্ড যেন একেকটি হত‍্যাযজ্ঞ। সেই দুর্বিষহ স্মৃতি এখনও দগদগে মানুষের মনে। তবুও প্রশাসনের নাকের ডগায় খোদ ঢাকাতেই চলছে অবৈধ সেই কেমিক্যাল কারখানা ও গুদামের রমরমা ব্যাবসা।
 
আইন অনুযায়ী এ ধরনের কেমিক্যাল কারখানা ও গুদাম আবাসিক এলাকায় স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। প্রতিটি ভয়াবহ ট্র্যাজেডির পর এসব উচ্ছেদে টনক নড়ে প্রশাসনের। কিন্তু সময় গড়ালে সবকিছু আবার ফিকে হয়ে যায়। আর কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়া না গেলে এই গুদামগুলোর একটিই হবে পরবর্তী বিপর্যয়ের নাম।