Image description
এম আবদুল্লাহ

দুটি পৃথক ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই। সরাসরি ভিকটিমদের মুখে শোনা। প্রথমটি বছর-পাঁচেক আগের। পোশাকশিল্প খাতের সফল উদ্যোক্তা তিনি। একটি শিল্প গ্রুপের কর্ণধার। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। শীর্ষ দুই নেতার সঙ্গে ভালো যোগাযোগ। দলীয় কার্যক্রমে আর্থিক সহায়তা করতেন। একদিন তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। পরিবার ও স্বজনদের জানানো হয়—জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হবে। হুঁশিয়ার করে বলা হলো—কাউকে জানালে ইলিয়াস আলীর পরিণতি। লাশও মিলবে না। পক্ষকাল ধরে আয়নাঘরে বন্দি রেখে নির্মম নির্যাতন চলল। জানতে চাওয়া হলো বিএনপিকে কত টাকা দিয়েছে, তার কত টাকা কোথায় আছে ইত্যাদি।

সবচেয়ে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত বাহিনীপ্রধানের সঙ্গে বোঝাপড়ায় জীবনের মূল্য নির্ধারিত হলো ২০ কোটি টাকা। পরিশোধ করে আয়নাঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ হলো। তুলে আনার অভিযানে যে কর্মকর্তা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি সুবিধাজনক স্থানে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে গাড়িতে তুললেন। চোখ বাঁধা অবস্থায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরিয়ে গভীর রাতে একটি নদীর তীরে নিয়ে নামালেন। একটি বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে আরেক দফা নির্যাতন করা হলো। বলা হলো—বড় স্যারকে ২০ কোটি দিয়েছিস, এখন আমারটা দেয়। নইলে বস্তাবন্দি করে, গুলি করে নদীতে ভাসিয়ে দেব। আরো ৫ কোটি টাকায় দফারফা করে জীবনভিক্ষা পেলেন। এখনো সেই ট্রমা থেকে মুক্ত হতে পারেননি পোশাক রপ্তানি খাতের সফল এই ব্যবসায়ী।

দ্বিতীয়টি ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়ের। একটি শীর্ষস্থানীয় কেমিক্যাল কোম্পানির কর্ণধারকে তুলে নেওয়া হলো। অভিযোগ, তাদের গ্রুপের অন্য একটি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্মিত ঢাকার একটি বড় অবকাঠামোতে দুর্নীতি হয়েছে। মাসাধিককাল আয়নাঘরে বন্দি রেখে নিষ্ঠুর সব কায়দায় নির্যাতন চলল। জীবনভিক্ষা চাইলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সেই ২০ কোটিতেই ফয়সালা। কঙ্কালসার হয়ে নিভু নিভু জীবনটা নিয়ে ফেরেন। তারপর নীরবে নিভৃতে ব্যবসা করছেন। কোনো ঝুটঝামেলা বা রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতা এড়িয়ে চলছেন। এক দিনের জন্যও তাকে আর জনসম্মুখে দেখা যায়নি। সেই বিভীষিকাময় দিনগুলো এখনো তার কাছে ভয়ানক আতঙ্কের।

গা শিউরে ওঠার মতো এমন বহু ঘটনা তুলে ধরা যায়। বর্ণিত দুটি ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন উচ্চপর্যায়ের কোনো নির্দেশনা ছিল না। দুর্বিনীত হয়ে ওঠা প্রভাবশালী সংস্থার কর্তারা নিয়মিত এভাবে একেকজন ধনাঢ্য ‘মুরগা’ ধরেছেন আর নিজেরা বড় অঙ্কের অর্থ আদায় করে দেশ-বিদেশে অঢেল বিত্তবৈভব গড়েছেন। জনগণের ভোটের পরিবর্তে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার কারণে স্বৈরশাসক এসব ঘটনা জানলেও কিছু করার ছিল না। প্রশ্রয় ও আশকারা দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে শতকোটি দিয়েও জীবনভিক্ষা নিতে হয়েছে ভুক্তভোগীদের। কমন অভিযোগ ছিল—‘জঙ্গি অর্থায়ন’ বা ‘দেশকে অস্থিতিশীল করতে অর্থের জোগানদাতা’।

Amar-Desh-Disappearance-and-murder

 

ইসরাইল থেকে সর্বাধুনিক ট্র্যাকিং যন্ত্রপাতি পেগাসাস আনার পর এই প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। যখন-তখন যাকে-তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অলিখিত লাইসেন্স পেয়ে বসে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, র‌্যাব, ডিবি, এনএসআইসহ বিভিন্ন সংস্থা ও বাহিনীর কর্মকর্তারা। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গুম, খুন করে আতঙ্ক ছড়ানো হতো আর বিত্তশালীদের তুলে নিয়ে মোটাদাগে অর্থ আদায় করা হতো। ফলে ওপরের নির্দেশ পালন করার কারণে কেন বাহিনী কর্মকর্তারা অপরাধী হয়ে বিচারের মুখোমুখি হবেন—এমন যুক্তি ধোপে টেকে না।

গত বুধবার ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম-নির্যাতনের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দুটি মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। অভিযোগ দুটি আমলে নিয়ে সব আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।

গুমের প্রথম মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে ১৭ জন আসামির নাম রয়েছে। দ্বিতীয় মামলায় ১৩ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। দুটি মামলার ভিকটিম ভিন্ন। ২২ অক্টোবরের মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করার দিন ধার্য করে ট্রাইব্যুনাল। বৃহস্পতিবার ২৮ জনের ৩০টি পরোয়ানা তামিলের জন্য পুলিশের আইজির দপ্তর ছাড়াও সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থার ১২টি দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

অভিযুক্তদের মধ্যে ভারতে পলাতক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক দুটি মামলাতেই আসামি। অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, র‌্যাবের সাবেক তিনজন মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ (সাবেক আইজিপি), এম খুরশিদ হোসেন ও মো. হারুন-অর-রশিদ। অন্য আসামিদের মধ্যে ২৩ জনই সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে পাঁচজন প্রতিরক্ষা গোয়ান্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক রয়েছেন। অন্যদের মধ্যে অন্তত ১২ জন বর্তমানে সেনাবাহিনীতে কর্মরত কর্মকর্তা রয়েছেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, ব্লগার এবং ভিন্নচিন্তার যারা ধারণ করতেন, যারা সরকারের কর্মকাণ্ডের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, সেসব লোককে গোপন কারাগারে (আয়নাঘরে) আটক রেখে নির্যাতন করতেন র‌্যাব ও ডিজিএফআইয়ের কিছুসংখ্যক বিপথগামী সদস্য। রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক বন্দিদের ক্ষেত্রবিশেষে হত্যা করেছিলেন তারা।

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, সংশোধিত আইন অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হওয়া মাত্রই অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে থাকতে পারবেন না। সুতরাং যারা সার্ভিসে (চাকরিতে) আছেন, তারা সার্ভিসে আছেন বলে আর গণ্য হবেন না। বিভিন্ন বাহিনীতে যারা চাকরিরত আছেন, সেই অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত ট্রাইব্যুনালে সোপর্দ করার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছে।

৩০ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তার গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর দেশে এক ধরনের গুমোট পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। অনেকে উশখুশ করছেন। এতে নাকি জাতীয় নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। আবার ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমের দৃঢ়তা ও সাহসিকতার প্রশংসা করে অবিলম্বে গুম-খুনে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে বিচারের জন্য সোপর্দ করারও আহ্বান জানিয়েছেন অনেকে। বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সন্তোষ প্রকাশ করে অভিযোগপত্র দাখিলকে ন্যায়বিচারের পথে অগ্রগতি হিসেবে বর্ণনা করেছে। জাতিসংঘের ঢাকা মিশনের প্রতিনিধি অভিযোগপত্র দাখিলের সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত থেকে তাদের সমর্থন জানান দিয়েছেন।

তবে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল এ ক্ষেত্রে দুর্বোধ্য কৌশল নিয়েছে। ১৫ বছরে গুম, খুন, নির্যাতনের শিকার ভিকটিমদের অধিকাংশ বিএনপি ও জামায়াতের। ফ্যাসিবাদী শাসনে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গুরুত্বপূর্ণ এই অগ্রগতি বিএনপি ও জামায়াতকে যেন স্পর্শ করতে পারেনি। দৃশ্যত, তারা অজানা আতঙ্কে কুঁকড়ে গেছেন। ডান-বামের সবাই বোবার ভূমিকায়। সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাও হতাশাজনক। আমার দেশ ছাড়া কোনো সংবাদপত্র যথাযথ মর্যাদায় সংবাদটি প্রকাশ করেনি। সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখে সমর্থন জানায়নি। রাজনীতিকদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম তরুণদের দল এনসিপিপ্রধান নাহিদ ইসলাম। তিনি নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় সমর্থন জানিয়ে অবিলম্বে তাদের গ্রেপ্তার ও বিচারের জন্য সোপর্দ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম নিজের ফেসবুকে ট্রাইব্যুনালের ঐতিহাসিক আদেশের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।

 

অভিযোগপত্রের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা আইনগতভাবে ও আনুষ্ঠানিকভাবে অপরাধে অভিযুক্ত হলেও দেড় দশক ধরে হিম আতঙ্ক ছড়ানো গুম, খুন ও ক্রসফায়ারের নামে নৃশংসভাবে রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং নাগরিকদের হত্যার সঙ্গে কারা যুক্ত ছিল, তা কমবেশি সবাই জানেন। আড্ডা-আলোচনায় নামগুলো উচ্চারিত হয়েছে। কাছে থেকে দেখা সাবেক সেনা কর্মকর্তারা টকশোতে এসব নাম উল্লেখ করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানিয়ে আসছেন অনেক দিন ধরেই। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমের পক্ষ থেকে তদন্ত চলাকালেই সংশ্লিষ্টদের চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর বা বরখাস্ত করে তদন্তে সহযোগিতার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রসিকিউশন টিম সে ক্ষেত্রে সহযোগিতা পায়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে।

 

যারা কর্মরত সামরিক কর্মকর্তা ও বাহিনীর সাবেক প্রধানদের বিরুদ্ধে চার্জশিট ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করছেন, তারা ভুলে গেছেন, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার ও বেসামরিক আদালতে বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার দৃষ্টান্ত শেখ হাসিনা সরকারই স্থাপন করে গেছেন। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আবদুর রহিম, পরিচালক উইং কমান্ডার সাহাব উদ্দিন আহাম্মদের বিচারও বেসামরিক আইনে সাধারণ আদালতে করেছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। প্রতিবেশী দেশ ভারতকে তুষ্ট করতে ফরমায়েশি রায়ে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

 

আবার একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সম্পূরক চার্জশিট দিয়ে গোয়েন্দাপ্রধান মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম, ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, মেজর জেনারেল এটিএম আমিন, খালেদা জিয়ার ভাগনে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সাইফুল ইসলাম ডিউক, দুই আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা ও শহিদুল হক, তৎকালীন অতিরিক্ত আইজিপি (সিআইডি) খোদাবক্স চৌধুরীকে মামলায় অভিযুক্ত ও প্রচলিত আদালতে বিচার করা হয়। ব্রি. জেনারেল আবদুর রহীম কনডেম সেলে কারা নির্যাতন ও বিনাচিকিৎসায় ২০২১ সালের আগস্টে মৃত্যুবরণ করেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সমর্থনে প্রত্যক্ষ ও চাক্ষুষ প্রমাণ ছিল না, যেমনটি গুম-খুনের ক্ষেত্রে রয়েছে। তখন কেউ উশখুশ ও অস্বস্তি প্রকাশ করেননি, প্রশ্ন তুলেননি।

 

এছাড়া নারায়াণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের মামলায় র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদের বিচারও বেসামরিক আদালতেই হয়েছে। আইনজ্ঞরা বলছেন, কোনো সামরিক কর্মকর্তা পেশাগত বিধিবিধান লঙ্ঘন করে বাহিনীর ভেতরে অপরাধ করলে বাহিনীর আইনে তার বিচার হয়। সাধারণ নাগরিকের বিরুদ্ধে অপরাধ করলে তার বিচার প্রচলিত বেসামরিক আদালতেই করার সুযোগ ও দৃষ্টান্ত রয়েছে।

 

অভিযোগপত্র দাখিলের পর ব্রিফিংয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম প্রেক্ষাপট তুলে ধরে যথার্থভাবেই বলেছেন, যারা অপরাধ করবেন, তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। বিচার করার সময় কখনোই দেখা হয় না অপরাধী কত উঁচুস্তরের, কত ক্ষমতাশালী। বিভিন্ন বাহিনীতে যারা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাষ্ট্র, সংবিধান ও আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, অপরাধ করেছিলেন, তাদের অপরাধের দায় শুধু ব্যক্তিদেরই; রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, তাদের অর্গানাইজেশন (সংস্থা) দায় গ্রহণ করবে না। তার এ বক্তব্যে পরিষ্কার করা হয়েছে, সাবেক-বর্তমান ২৩ কর্মকর্তার দায় পুরো সেনাবাহিনীর নয়। বরং ক্ষমতার অপচর্চা ও অর্থবিত্তের লোভে অতি-উৎসাহী গুটিকয় কর্মকর্তার দ্বারা বাহিনীর শত শত কর্মকর্তা ও সদস্য নিগ্রহ ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। শুধু ভিন্ন মতাদর্শের সন্দেহে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন বহু কর্মকর্তা ও সদস্য। সহকর্মীদের গুম, নির্যাতন করতেও তাদের বুক কাঁপেনি। হাতেগোনা কজন দলবাজ ও ক্ষমতান্ধ কর্মকর্তার কারণে কলঙ্কিত হয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন পুরো বাহিনীর সদস্যরা। কয়েকজনের বিচারের মধ্য দিয়ে সেই কলঙ্ক মোচনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাহিনীর সিংহভাগ সদস্য দায়ীদের বিচারের মাধ্যমে কলঙ্ক থেকে মুক্তি চান।

 

গুম হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধ। অভিযুক্তদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও দরদি হওয়ার আগে যাদের পরিবারের সদস্যরা গুম হয়েছেন, এখনো ফিরে আসেননি, তাদের কথা কি একবারও ভেবেছেন? শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে কমপক্ষে ১৮০০ মানুষকে গুমের অভিযোগ পেয়েছে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। তার মানে প্রতিবছর গড়ে ১২৫ জনের অধিক মানুষকে গুম করেছে পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বিভিন্ন বাহিনী। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) রক্ষণশীল হিসেবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ নামে অন্তত ১ হাজার ৯২৬ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। পুলিশের বিশেষ শাখাকে (এসবি) উদ্ধৃত করে সংবাদপত্রে প্রকাশিত আরেক রিপোর্ট বলছে, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাত বছরে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ১ হাজার ২৯৩ জন। মানে প্রতিবছর ১৮৫ জনকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করেছে। প্রতি মাসে গড়ে ১৫ জন বা প্রতি দুদিনে একজন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে।

 

দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্রপ্রহরী সশস্ত্র বাহিনী আমাদের আস্থা, নির্ভরতা ও গর্বের প্রতিষ্ঠান। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে যে যত ক্রেডিটবাজিই করুক না কেন, সেনাবাহিনী শেখ হাসিনার গণহত্যার মাধ্যমে গদি টেকানোর নির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করে ছাত্র-জনতার পাশে না দাঁড়ালে জীবন ও রক্ত ঝরত আরো কয়েকগুণ। অবিস্মরণীয় বিজয়ের বন্দরে এত সহসা নোঙর করা যেত কি না, সে সংশয় প্রকাশেরও সুযোগ আছে। বিশেষ করে, মধ্যম সারির তরুণ কর্মকর্তা ও সাধারণ সিপাহিরা ফ্যাসিবাদের পতন ও পলায়নে যেভাবে রাজপথে উল্লাস-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, ফ্যাসিবাদের আইকন মুজিবের মূর্তি ভাঙায় অংশ নিয়েছেন, তাতে প্রমাণিত হয় ১৫ বছর তারা দুঃসহ-দমবন্ধ সময় পার করেছেন। আম-জনতার মতো তারাও নিপীড়িত ছিলেন।

 

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান স্বতঃস্ফূর্তভাবে না বাধ্য হয়ে জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, সেই বিতর্ক অবান্তর। বাস্তবতা হলো, তিনি আত্মীয়তার সম্পর্ক ও নিয়োগকর্তার বিপরীতে জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এটি সহজ ছিল না। একটি বাহিনীর অভিভাবক হিসেবে তিনি চাপে বা দায়িত্বের দায় থেকে সদস্যদের রক্ষায় চেষ্টা করবেন—এটিও দূষণীয় নয়। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি গুম-খুনের শিকার পরিবারের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে ৫ আগস্টের মতোই মানবতার পক্ষে দাঁড়াবেন এবং অভিযুক্তদের আইনের কাছে সোপর্দ করে বিচারে সহযোগিতা করবেন—এটাই সবার প্রত্যাশা।

 

সম্প্রতি আইএসপিআর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, সেনাপ্রধান গুম-খুনে জড়িতদের দায়মুক্তির কথা বলেননি। মানুষ সেটাই বিশ্বাস করতে চায়। আদালতের মাধ্যমে প্রমাণিত হোক অভিযুক্তরা বেআইনি ও অন্যায় হুকুম তামিলে বাধ্য হয়েছেন, নাকি পদ-পদোন্নতি ও অর্থ-বিত্তের মোহে অতি-উৎসাহীও ছিলেন। বরখাস্ত মেজর জে. জিয়াউল আহসানের মতো সিরিয়াল কিলারদের প্রিজনভ্যানে দেখতে কষ্ট লাগা মানবতাবিরুদ্ধ। রেজ্জাকুল হায়দার ও আবদুর রহীমদের সময় যেহেতু কষ্ট পাননি, এখনো পাওয়া সমীচীন হবে না। আর প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে অবস্থান পরিষ্কার করে জানান দিতে হবে যে, তারা ক্ষমতায় গেলেও গুম, খুন, নিপীড়নের বিচার কোনো প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপ বা প্রভাবে বাধাগ্রস্ত হবে না। ভয়কে তারা জয় করতে পারবে।

 

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক