Image description

মেহেদী হাসান

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছরে ১৩ লাখের বেশি শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক এই উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মেধা প্রয়োগ ও বিকাশের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই দেশে। বিশেষ করে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা মেধাবীদের মেধার বিকাশ ও চর্চার উপযুক্ত ক্ষেত্র নেই বললেই চলে। অথচ এই মেধাবী তরুণদের অনেকে গবেষণা করতে পারত মহাকাশযান নির্মাণ ও উৎক্ষেপণ আর গ্রহ-উপগ্রহে অভিযান বিষয়ে। তারা প্রতিযোগিতা করতে পারত দূরপাল্লার অভেদ্য গাইডেড মিসাইল নির্মাণ বিষয়ে। অনেকে নিজেদের নিবিড় গবেষণায় নিয়োজিত করতে পারত যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন, বিভিন্ন ধরনের ইঞ্জিন তৈরিসহ প্রযুক্তি ও প্রকৌশলগত উৎকর্ষসাধনে। উদ্ভাবন করতে পারত আধুনিক অনেক সমরাস্ত্র। সুযোগ দেওয়া হলে তাদেরই হাত ধরে দেশে নির্মিত হতো কম্পিউটারসহ প্রয়োজনীয় আধুনিক অনেক ইলেকট্রনিক যন্ত্র ও সিস্টেম। চীন, জাপান, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশের যেসব তরুণ এসব ক্ষেত্রে নিজ দেশ ও বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তাদের কারো চেয়ে কোনো অংশে কম মেধাবী নয় বাংলাদেশের তরুণরা। সমরাস্ত্র, প্রযুক্তিসহ যে ক্ষেত্রেই আজ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, সেটি তারা করছে বাংলাদেশের মতো বিভিন্ন দেশের মেধাবীদের মাধ্যমে। বাংলাদেশেরই মতো বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার মেধাবী তরুণ-তরুণী সেখানে গবেষণা আর নিত্যনতুন উদ্ভাবনে রত বিস্ময়কর অনেক কিছুর সঙ্গে, যা আমাদের চিন্তাভাবনারও বাইরে।

অথচ বাংলাদেশের তরুণ মেধাবীদের জন্য এ ধরনের আয়োজন আজও যেন দুঃস্বপ্ন। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ নয়, বরং স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর আজও প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিষয়ক মেধাবীদের জন্য দেশে প্রধান আয়োজন হলো বিসিএস চাকরি। আর সেই চাকরির সুযোগ রয়েছে খুব কম প্রার্থীর জন্য। দেশে বর্তমানে ৯ লাখের বেশি স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার। ফলে প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিষয়ক লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন শেষে মাথায় চাপে একরাশ হতাশার বোঝা। অথচ নামকরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর তাদের নিয়ে গর্ব করেন পরিবার, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও গ্রামের লোকজন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর তাদের অনেকেই সমাজের সামনে বের হতে বিব্রতবোধ করেন। কারণ বেকারত্ব। এখন কী করছেন—এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায় অনেকের। বস্তুত এ লজ্জা আর অপমান তাদের নয়, বরং সমগ্র দেশ ও জাতির। এ লজ্জা তাদের, যাদের হাতে ছিল ৫৪ বছর ধরে দেশ পরিচালনার ভার। এ লজ্জা তাদের, যারা নিজের দেশে শিল্প, গবেষণা, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানুফ্যাকচারিং, সমরাস্ত্রসহ কোনো ক্ষেত্রে বিকাশের ব্যবস্থা না করে কেবল দেশকে বিদেশি পণ্যের বাজার আর ভোক্তা শ্রেণি তৈরি করে নিজেদের আখের গোছানোয় ব্যস্ত ছিলেন।

দেশে মেধা বিকাশ, প্রয়োগ ও উপযুক্ত চর্চার ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষাজীবন শেষে অনেক তরুণ পাড়ি জমান বিদেশে। কিন্তু এ সুযোগও সীমিত। তাই দেখা যায়, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিষয়ে পাস করে অনেকে ব্যাংকারের মতো পেশা বেছে নিতেও বাধ্য হন। অনেকের ভাগ্যে তাও জোটে না।

এসব কারণে বাংলাদেশে লাখ লাখ তরুণ আজ যেখানে হতাশার সাগরে নিমজ্জিত, সেখানে তুরস্কে ঘটেছে তারুণ্যের এক নবজাগরণ।

তুরস্ক একসময় পরিচিত ছিল ‘ইউরোপের রুগ্‌ণ মানব’ হিসেবে। দুই দশক আগেও তুরস্কের তরুণদের অবস্থা ছিল আজকের বাংলাদেশের মতো। উন্নত দেশে পাড়ি জমানোই ছিল তাদের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু ২০০৩ সালে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান দেশটির দায়িত্ব গ্রহণের পর রাতারাতি পাল্টে যেতে থাকে চিত্র। একদা ইউরোপের রুগ্‌ণ মানব আজ বিশ্বব্যাপী আলোচিত সমরাস্ত্র, যোগাযোগ অবকাঠামো, ম্যানুফ্যাকচারিং, বিশেষ করে অটোমোটিভ, টেক্সটাইল, মেশিনারি ও ইলেকট্রনিক্স ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতির জন্য। এছাড়া দেশটি আজ বিশ্বব্যাপী আলোচিত ট্যুরিজম, কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নতির জন্য। টার্কিশ এয়ারলাইনস আজ বিশ্বে ষষ্ঠ এবং তুরস্ক বিশ্বের ষষ্ঠ পর্যটক আকর্ষণকারী দেশ। ২০২৪ সালে ৫ কোটি ২৩ লাখ বিদেশি পর্যটক তুরস্ক ভ্রমণ করেছে।

তুরস্ক আর্মি আজ বিশ্বের নবম শক্তিশালী আর্মি। আর সামরিক ক্ষেত্রে রাতারাতি তুরস্কের বিস্ময়কর অগ্রগতির মূলে রয়েছে সমরাস্ত্র ক্ষেত্রে দেশটির নিত্যনতুন উদ্ভাবন। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তুরস্ক ছিল বিশ্বের সপ্তম সমরাস্ত্র আমদানিকারক দেশ, আর ২০২৪ সালে তুরস্ক পরিণত হয়েছে বিশ্বের ১১তম সমরাস্ত্র রপ্তানিকারক দেশে। দেশটিতে রয়েছে এক ডজনের বেশি সমরাস্ত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, যাদের নাম রয়েছে বিশ্বের সেরা ১০০ সমরাস্ত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের তালিকায়। তুরস্কের নির্মিত ড্রোন আজ গোটা বিশ্বের সমরাঙ্গনে আলোচিত বিষয়। তুরস্ক হলো বর্তমানে বিশ্বে চতুর্থ দেশ, যারা নিজেরা নির্মাণ করছে ফিফ্‌থ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার। নিজেই তৈরি করেছে এর ইঞ্জিন। সর্বশেষ গত জুলাই মাসে তুরস্ক বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করেছে নিজস্ব নির্মিত হাইপারসনিক মিসাইল।

সমরাস্ত্র, ম্যানুফ্যাকচারিংসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তুরস্কের রাতারাতি অগ্রগতি দেশটির মেধাবী তরুণসমাজকে হতাশার অন্ধকার থেকে সম্ভাবনার দিকে ধাবিত করে। বাংলাদেশের একজন মেধাবী তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর যখন হতাশার সাগরে হাবুডুবু খায়, তখন তুরস্কের একজন মেধাবী তরুণ নিবিড় গবেষণায় লিপ্ত ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং হাইপারসনিক মিসাইলের পাল্লা ও গতি বৃদ্ধির উপায় নিয়ে। তারা গবেষণায় লিপ্ত কত দ্রুত তাদের কান (KAAN) নামক ফিফ্‌থ জেনারেশন ফাইটার জেটে নিজস্ব ইঞ্জিন সংযুক্ত করা যায় তা নিয়ে।

ছয় বছর ধরে টেকনোফেস্ট ঘিরে তুরস্কে ঘটেছে তারুণ্যের আরেক নবজাগরণ। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে ইস্তাম্বুলে পাঁচ দিনব্যাপী টেকনোফেস্টে ভিড় জমায় দেশটির লাখ লাখ মেধাবী তরুণ-তরুণী। তুরস্কের টেকনোফেস্ট বিশ্বের সবচেয়ে বড় অ্যারোস্পেস অ্যান্ড টেকনোলজি প্রদর্শনী। এ মেলায় তুরস্ক তাদের নিজস্ব নির্মিত যুদ্ধবিমান, ড্রোনবিমান, মিসাইলসহ গুরুত্বপূর্ণ সব অ্যারোস্পেস টেকনোলজি হাজির করে। মেলায় থাকে ট্যালেন্ট হান্ট, উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতাসহ আরো অনেক আকর্ষণীয় আয়োজন। গোটা তুরস্ক থেকে তরুণ মেধাবীরা অংশ নেয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। তাদের মধ্য থেকে মেধাবী তরুণরা গবেষণার সুযোগ পায় বিভিন্ন সমরাস্ত্র প্রতিষ্ঠান ও উদ্ভাবনী সংস্থায়। তুরস্কের ১১ লাখ তরুণ-তরুণী ৫ লাখ ৬৫ হাজার টিমে বিভক্ত হয়ে সেপ্টেম্বরের ইস্তাম্বুল মেলার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। গবেষণা, উদ্ভাবনী প্রভৃতি ক্ষেত্রে মেধাবীদের বাছাইয়ের জন্য রাখা হয় ৬৪ ধরনের প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বাবদ সরকারিভাবে বরাদ্দ ছিল দুই মিলিয়ন ডলার।

ইস্তাম্বুল টেকনোফেস্ট উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বায়রাক্তার ড্রোনবিমান নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সেলজুক বায়রাক্তার যে বক্তব্য দেন, তা ছিল মাইন্ড ব্লোয়িং। সেলজুক বায়রাক্তার বলেন, ‘আজকের মেধাবী তরুণ প্রজন্ম আর্তনাদ করছে নতুন কিছু একটা উদ্ভাবনের, নতুন কিছু করার। কিন্তু তারা সবাই সে সুযোগ পাচ্ছে না। আমরা তাদের বলতে চাই, আমরা এখানে আছি তোমাদের জন্য। আমরা আমাদের নিজেদের আকাশে উড়তে চাই আমাদের নিজেদের ডানায়। তুরস্কের প্রত্যেকটি দক্ষ হাতকে আমরা একটি করে স্টিল আর প্রতিটি তীক্ষ্ণ মেধাকে আমরা একটি করে কোডে রূপান্তর করতে চাই।’

বাংলাদেশেও তরুণ মেধাবীদের মধ্যে ছিল অফুরন্ত সম্ভাবনা। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেয়নি অতীতের সরকার। ৫৪ বছর হলো দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু আজ অবধি বাংলাদেশের আকাশে ওড়েনি কোনো মিসাইল, ওড়েনি নিজস্ব কোনো যুদ্ধবিমান। নিজস্ব যুদ্ধবিমান দূরের কথা, বিদেশ থেকেও শক্তিশালী কোনো যুদ্ধবিমান আর আধুনিক সমরাস্ত্র কিনতে দেওয়া হয়নি বাংলাদেশকে। গড়তে দেওয়া হয়নি আধুনিক সমরাস্ত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। তাই ৫৪ বছরের স্বাধীন আর ১৮ কোটি মানুষের দেশে আজ হ্যান্ড গ্রেনেড আর রাইফেল ছাড়া নেই কোনো সমরাস্ত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। যুদ্ধবিমান, মিসাইলসহ আধুনিক সমরাস্ত্র নির্মাণের লক্ষ্যে নেই কোনো সুদূরপ্রসারী গবেষণা ও পরিকল্পনা। বাংলাদেশ যখনই সমরাস্ত্র ও সামরিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী হওয়ার কোনো পরিকল্পনা করেছে, তখনই ভারতের বাধার কারণে তা আটকে গেছে। কারণ ভারত কখনোই চায় না বাংলাদেশ সামরিক দিক দিয়ে একটি শক্তিশালী দেশে পরিণত হোক। সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী বাংলাদেশকে ভারত তার নিরাপত্তা আর ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য হুমকি মনে করে। ভারত চেয়েছে বাংলাদেশকে সবসময় তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে। যেমনটি আমরা দেখেছি মাফিয়া শাসক শেখ হাসিনার আমলে। গদি হারানোর ভয়ে অতীতের অনেক সরকার ভারতের চাপ উপেক্ষা করে দেশকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেয়নি। যদি নিত, তাহলে আজ তুরস্কের মতো বাংলাদেশেরও তরুণ মেধাবীরা নিজেরাই মিসাইল, যুদ্ধবিমান, বিমান ও মিসাইলের ইঞ্জিন, রণতরীসহ বিস্ময়কর অনেক কিছু তৈরি করতে সক্ষম হতো। বাংলাদেশের তরুণরাও আজ স্বপ্ন দেখতে পারত মহাকাশে পাড়ি জমানোর।

ভারত এখনো সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ যাতে বিদেশ থেকে আধুনিক যুদ্ধবিমানসহ উন্নত কোনো সমরাস্ত্র সংগ্রহ করতে না পারে। ভারত চাচ্ছে সমরাস্ত্র, প্রযুক্তি ও ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প ঘিরে তুরস্কের মতো বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে যেন কোনো নবজাগরণ না ঘটে। ভারতের এ ধরনের আরো অনেক চাওয়া সফল করার জন্য দেশের মধ্যে রয়েছে তাদের নিয়োজিত বিশাল দালালচক্র।

চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের পরও যদি আমাদের কর্ণধাররা তরুণদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে এ জাতি আর কোনোদিন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে কি না, তা নিয়ে গভীর সংশয় রয়েছে।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, আমার দেশ